সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

সুখী ও সুস্থ থাকার কৌশল

অক্সিটোসিন হরমোনের প্রভাবে যেমন শরীর এবং মনে সুখের সৃষ্টি হয়, তেমনই শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুখী হলেই অক্সিটোসিন সক্রিয় হয়। তাই নিজেকে ভালো রাখতে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনুন। ইতিবাচক কাজই জীবনকে সুখী সুন্দর করে তোলে। ইতিবাচক কাজে উৎসাহ দেয়। তাই জীবনটা ভালো কাজের জন্যই ব্যবহার করুন। দেখবেন আপনি যেমন ভালো থাকবেন তেমনই ভালো থাকবেন তেমনই ভালো থাকবে আপনার শরীর এবং মন। সক্রিয় হবে পিটুইটারি গ্রন্থির গুরুত্বপূর্ণ হরমোন অক্সিটেসিন।
নতুনধারা
  ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

বোডে এবং কুশনিক ২০২১ সালে জৈবিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রেম বা ভালোবাসার একটি জৈবিক সংজ্ঞা প্রস্তাব করেছেন:'কল্পনাপ্রবণ ভালোবাসা একটি অনুপ্রেরণামূলক অবস্থা যা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি মিলনের আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে যুক্ত। এটি জীবনকাল জুড়ে ঘটে এবং উভয় লিঙ্গের মধ্যে স্বতন্ত্র জ্ঞানীয়, মানসিক, আচরণগত, সামাজিক, জেনেটিক, নিউরাল এবং অন্তঃস্রাবী কার্যকলাপের সঙ্গে যুক্ত। জীবনের বেশিরভাগ সময় জুড়ে এটি সঙ্গী পছন্দ, প্রীতি, যৌনতা এবং জোড়া-বন্ধন ক্রিয়ার পরিবেশন। এটি একটি অভিযোজন এবং উপজাত একটি রূপ যা মানুষের সাম্প্রতিক বিবর্তনীয় ইতিহাসের সময়কালে উদ্ভূত আচরণ।'

ভালোবাসার সংজ্ঞা বিতর্ক, অনুমান এবং অন্তর্দর্শনের ওপর প্রতিষ্ঠিত। সাধারণ মতে, ভালোবাসাকে একটি ব্যক্তিগত অনুভূতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যেটা একজন মানুষ অপর আরেকজন মানুষের প্রতি অনুভব করে। কারো প্রতি অতিরিক্ত যত্নশীলতা কিংবা প্রতিক্ষেত্রে কারো উপস্থিতি অনুভব করা ভালোবাসার সঙ্গেই সম্পর্কযুক্ত। অধিকাংশ প্রচলিত ধারণায় ভালোবাসা নিঃস্বার্থতা, স্বার্থপরতা, বন্ধুত্ব, মিলন, পরিবার এবং পারিবারিক বন্ধনের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। ভালোবাসার সাধারণ এবং বিপরীত ধারণার তুলনা করে ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভালোবাসাকে জটিলভাবে বিচার করা যায়। ধনাত্মক অনুভূতির কথা বিবেচনা করে ভালোবাসাকে ঘৃণার বিপরীতে স্থান দেওয়া হয়। ভালোবাসায় যৌনকামনা কিংবা শারীরিক লিপ্সা অপেক্ষাকৃত গৌণ বিষয়। এখানে মানবিক আবেগটাই বেশি গুরুত্ব বহন করে। কল্পনাবিলাসিতার একটি বিশেষ ক্ষেত্র হচ্ছে এই ভালোবাসা। ভালোবাসা যদিও কেবল বন্ধুত্ব নয়- তবে কিছু সম্পর্ককে অন্তরঙ্গ বন্ধুত্ব বলেও অভিহিত করা হয়।

সাধারণত, ভালোবাসা বলতে একটি তীব্র আকর্ষণ এবং মানসিক সংযুক্তির অনুভূতিকে বোঝায়। ভালোবাসা একটি মানবিক অনুভূতি এবং আবেগকেন্দ্রিক একটি অভিজ্ঞতা। বিশেষ কোনো মানুষের জন্য স্নেহের শক্তিশালী বহিঃপ্রকাশ হচ্ছে ভালোবাসা। ভালোবাসাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে ভাগ করা যায়। যেমন একজন মায়ের ভালোবাসা একজন সঙ্গীর ভালোবাসা থেকে আলাদা- যা আবার খাবারের প্রতি ভালোবাসা থেকে ভিন্ন।

প্রাচীন গ্রিক দার্শনিকরা ভালোবাসার ছয়টি রূপ শনাক্ত করেছিলেন: ১) পারিবারিক ভালোবাসা, ২) বন্ধুত্বপূর্ণ ভালোবাসা বা পেস্নটোনিক ভালোবাসা, ৩) রোমান্টিক ভালোবাসা, ৪) নিজেকে-ভালোবাসা, ৫) অতিথিকে ভালোবাসা এবং ৬) ঐশ্বরিক বা নিঃশর্ত ভালোবাসা। আধুনিক লেখকরা ভালোবাসার আরও কিছু রূপ শনাক্ত করেছেন; যেমন: প্রতিদানহীন ভালোবাসা, শূন্য ভালোবাসা, মুগ্ধ ভালোবাসা, পরিপূর্ণ ভালোবাসা, দরদি ভালোবাসা, আত্মভালোবাসা এবং সৌজন্যমূলক ভালোবাসা।

আবেগকে সংজ্ঞায়িত করা কঠিন। আবেগকে অনেকে অনুভূতির সমার্থক ধরে নেয়। যদিও অনুভূতি শারীরিক বা মানসিক কিংবা উভয়ই হতে পারে তবে আবেগ মূলত মানসিক। এটা এমন একটি মানসিক অবস্থা- যা স্বতঃস্ফূর্তভাবেই উদ্ভূত হয়। এর সঙ্গে মাঝে মাঝে শারীরিক পরিবর্তনও প্রকাশ পায়। সেক্ষেত্রে আবেগকে বলা যায় অনুভূতির উৎস। আবার শারীরিকভাবে বলতে গেলে মসৃণ পেশি এবং বিভিন্ন গ্রন্থির কারণে শরীরের অন্তর্নিহিত পরিবর্তনই হলো আবেগ। সামগ্রিকভাবে, চেতনার যে অংশ অনুভূতি বা সংবেদনশীলতার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কযুক্ত তাকে আবেগ বলা যায়।

মরগান ও কিংয়ের মতে আবেগের ৫টি উপাদান থাকা অত্যাবশ্যক : ১) আবেগের মানসিক বা আত্মনিষ্ঠ অনুভূতি ২) শারীরিক উত্তেজনা ৩) শরীর বৃত্তীয় ভিত্তি ৪) মৌখিক, ভাষাগত এবং অঙ্গ সঞ্চালনমূলক বহিঃপ্রকাশ ৫) সংশ্লিষ্ট প্রেশনামূলক অবস্থা।

মনোবিজ্ঞানীদের মতে, একজন ব্যক্তি অন্য কারও প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার ক্ষেত্রে মস্তিষ্ক মোট পাঁচ মিনিট ৩০ সেকেন্ড সময় নেয়। গবেষকরা এটাও দেখেছেন, মানুষের মস্তিষ্ক প্রেমে পড়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তি বিশেষে কিছু বিষয়ও বিবেচনা করে থাকে। তার মধ্যে ৫৫ শতাংশ হলো তার অঙ্গভঙ্গি বা বাহ্যিক রূপ, ৩৮ শতাংশ কণ্ঠস্বর ও কথা বলার ভঙ্গি এবং মাত্র ৭ শতাংশ তাদের মূল বক্তব্য শোনে।

যুক্তরাষ্ট্রের রটার্স বিশ্ববিদ্যালয় এর হেলেন ফিসারের মতে, প্রেমের তিনটি স্তর রয়েছে এবং এই তিনটি স্তরের প্রতিটি স্তরই ভিন্ন ভিন্ন হরমোন ও রাসায়নিক পদার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়। স্তরগুলো হলো : ১) ভালোবাসার ইচ্ছে বা লালসা ২) আকর্ষণ ও ৩) সংযুক্তি।

ভালোবাসার ইচ্ছে

এটি প্রেমের প্রথম স্তর। যখন কাউকে ভালো লাগে তখন তাকে ভালোবাসার ইচ্ছে থেকে ছেলেদের ক্ষেত্রে টেস্টস্টেরন ও মেয়েদের ক্ষেত্রে ইস্ট্রোজেন হরমোন নিঃসৃত হয়। এই দুটি হরমোন মানুষকে এমনভাবে তাড়িত করে যে, হরমোন দুটির প্রভাবে প্রেমে পড়লে কেউ কেউ একেবারে মরিয়া আচরণ পর্যন্ত করতে পারে। এই দুটি হরমোন দ্বারা যারা বেশি প্রভাবিত তারা প্রেমের জন্য অনেক কিছুই করতে পারে- সেটা হোক মহানুভবতা কিংবা হিংস্রতা।

আকর্ষণ

কাউকে দীর্ঘদিন ধরে ভালো লাগার ফলে তার প্রতি এক ধরনের আকর্ষণবোধ সৃষ্টি হয়। বিজ্ঞানীদের মতে এই স্তরের সঙ্গে তিনটি নিউরো-ট্রান্সমিটার জড়িত। ১) এড্রিনালিন ২) ডোপামিন ও ৩) সেরোটোনিন। নিউরোট্রান্সমিটার হলো এক ধরনের এন্ড্রজেনিক রাসায়নিক যা এক স্নায়ুকোষ থেকে অপর স্নায়ুকোষে সংকেত পাঠানোর কাজ করে।

দ্ব এড্রিনালিন :প্রেমে পড়ার প্রাথমিক পর্যায়ে এড্রিনালিন গ্রন্থি ও কর্টিসলে রক্ত সঞ্চালন বেড়ে যায়। ফলে প্রিয় মানুষটিকে দেখলে বা তার সঙ্গে কথা বলার সময় ঘাম ঝরে, হৃৎপিন্ডের গতি বেড়ে যায় এবং গলা শুকিয়ে আসে।

দ্ব ডোপামিন :হেলেন ফিসার সদ্য প্রেমে পড়া ছেলেমেয়েদের মস্তিষ্ক পরীক্ষা করে দেখেছেন যে, ভালোবাসার উত্তেজনার ফলে তাদের মধ্যে উচ্চমানের ডোপামিন নিঃসরণ হয়- যা ব্যক্তির মধ্যে পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। তিনি আরও জানান, ডোপামিনের নিঃসরণ বেশি হলে শক্তি ও মনযোগ বাড়ে, ঘুম ও খাওয়ার চাহিদা কমে যায়।

দ্ব সেরোটোনিন : গুরুত্বপূর্ণ এই হরমোনটিই নির্ধারণ করে কেন এবং কখন আপনি প্রেমে পড়বেন।

সংযুক্তি

এটি ভালোবাসার শেষ স্তর। দীর্ঘকাল একসঙ্গে থাকার পর দুজনই দুজনের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে। এ সময়টাতেই মূলত তারা ঘর বাঁধে। বিজ্ঞানীদের মতে এই অনুভূতি দুটি হরমোনের কারণে হয় : ১) অক্সিটোসিন ও ২) ভ্যাসোপ্রেসিন।

সুতরাং দেখা যাচ্ছে শরীর এবং মনকে সুখী রাখতে মূলত অক্সিটোসিন হরমোনই মূল ভূমিকা পালন করছে। সাধারণত এটি স্বাভাবিক নিয়মেই শরীরে উৎপন্ন হয়। তবে কেউ যদি ইতিবাচক জীবনে আগ্রহী হন তাহলে নিজের শরীরের অক্সিটোসিন বাড়ানোর চেষ্টা করতে পারেন। সুখ তৈরির হরমোনটিকে শরীরের ভেতর বাড়িয়ে তুলতে কয়েকটি প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চলতে হয় :

নিয়মিত যোগাসন করুন

নিয়মিত যোগাসন করলে মনের উদ্বেগ, স্ট্রেস, অবসাদ ইত্যাদি কমে যায়, ভালো ঘুম হয়, জীবনযাত্রার মান উন্নত হয়। অক্সিটোসিন হরমোনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। গবেষণা মতে যারা নিয়মিত যোগাসন করেন তাদের অক্সিটোসিনের মাত্রা অনেকটাই বেশি। সে কারণে তাদের মনের অসুখ কম হয়।

পছন্দের গান শুনুন

গবেষণা মতে পছন্দের গান শুনলে শরীরের অক্সিটোসিনের মাত্রা বৃদ্ধি পায়। তা যে কোনো গানই হতে পারে। একেক জনের পছন্দ একেক রকম হলেও গান শোনাটা খুব দরকারি। পছন্দমতো গান শোনা মানে আপনি বিষয়টি উপভোগ করছেন। আপনার মন ভালো থাকছে। অর্থাৎ আপনার অক্সিটোসিন আরও সক্রিয় হচ্ছে।

স্পা নিতে পারেন

শরীর অক্সিটোসিন হরমোনকে আরও সক্রিয় করতে মাসাজ নিন সঙ্গী কিংবা সঙ্গিনীকে মাসাজ দিন। গবেষণা বলছে, শরীরের স্নায়ুগুলোকে সক্রিয় করতে মাসাজ অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা রাখে। শরীরের পাশাপাশি মনের সুখকেও বাড়িয়ে তোলে এটি। আর পালস্না দিয়ে বাড়ায় অক্সিটোসিন হরমোনের মাত্রা। যারা নিয়মিত মাসাজ নেন তাদের শরীরের অক্সিটোসিনের মাত্রা অনেকটাই বেশি থাকে। ফলে শরীর, মন সতেজ থাকে। কাজে অধিক উৎসাহ আসে। অন্যান্য শারীরিক ক্রিয়ায় তারা পারদর্শী হন। বিশেষ করে যৌনসঙ্গমের ক্ষেত্রে এদের পারফরম্যান্স হয় দুর্দান্ত।

কথা ও আচরণে রোমান্টিকতা বাড়িয়ে দিন

শরীরে অক্সিটোসিনের মাত্রা বাড়াতে চাইলে প্রিয়জনের সঙ্গে রোম্যান্টিক কথা বলুন। একে অপরের প্রতি অনুভূতি, আকর্ষণ কিংবা ভালো লাগার বিষয় নিয়ে আলোচনা করুন। প্রিয় মানুষকে মাঝে মাঝেই জড়িয়ে ধরুন, হাতে হাত রেখে আলতো চাপ দিন কিংবা চুমু খেতে পারেন। এতে করে উভয়ের শরীরের অক্সিটোসিন ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাবে।

বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটান

শরীরের অক্সিটোসিনের মাত্রা বাড়াতে বন্ধুদের সঙ্গে নিয়মিত সময় কাটান। এতে মন ফুরফুরে থাকবে। একা থাকলে এই অনুভূতি হয় না। তাই একাকীত্বের পরিবর্তে সবার সঙ্গে খোলা মনে মিশুন। দেখবেন ধীরে ধীরে আপনার মনের আবেগ, ভালোবাসা, অনুভূতি, প্রেম ইত্যাদি বেড়ে যাবে এবং আপনার শরীরের অক্সিটোসিনের মাত্রাও বেড়ে যাবে।

মেডিটেশন করুন

নিয়মিত মেডিটেশন করুন। মেডিটেশন উদ্বেগ, অবসাদ, চিন্তাকে দূর করে মনকে প্রফুলস্ন্ল করে। মনের আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করে। এর প্রভাবে পিটুইটারি গ্রন্থির অক্সিটোসিন হরমোন আরও বেশি সক্রিয় হয়।

কথা কম বলুন, বেশি করে শোনার অভ্যাস করুন

শরীরের অক্সিটোসিন হরমোন বাড়ানোর আরেকটি ভালো উপায় হলো কম কথা বলা। কম বলুন, শোনার অভ্যাস করুন।

নিয়মিত যৌন সঙ্গম করুন

সঙ্গীর সঙ্গে যৌনসুখ বিশেষ করে অর্গাজমের সময় অক্সিটোসিন পর্যাপ্ত পরিমাণে নিঃসরণ হয়।

অক্সিটোসিন হরমোনের প্রভাবে যেমন শরীর এবং মনে সুখের সৃষ্টি হয়, তেমনই শারীরিক এবং মানসিকভাবে সুখী হলেই অক্সিটোসিন সক্রিয় হয়। তাই নিজেকে ভালো রাখতে জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনুন। ইতিবাচক কাজই জীবনকে সুখী সুন্দর করে তোলে। ইতিবাচক কাজে উৎসাহ দেয়। তাই জীবনটা ভালো কাজের জন্যই ব্যবহার করুন। দেখবেন আপনি যেমন ভালো থাকবেন তেমনই ভালো থাকবে আপনার শরীর এবং মন। সক্রিয় হবে পিটুইটারি গ্রন্থির গুরুত্বপূর্ণ হরমোন অক্সিটোসিন।

ডা. আবু হেনা মোস্তফা কামাল

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা,

নীলফামারী সদর, নীলফামারী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে