শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

টাকা

শামীম খান যুবরাজ
  ৩০ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

আজ ক'দিন ধরেই বাঁধনের মনটা খারাপ যাচ্ছে। দুই বছর বয়সি অবুঝ ছেলেটাও না জানি কেমন হয়ে গেছে। নাওয়া-খাওয়ার নিয়মতান্ত্রিকতায় অমনোযোগী হয়ে পড়েছে দু'জনেই। দুই বছরের ছোট্টমণি নীরবটা ছিল বাড়ির নীরবতা ভাঙার একমাত্র যন্ত্র। সারা বাড়ি মাথায় তোলা যার দৈনন্দিন কাজ ছিল, তার উপস্থিতি সত্ত্বেও বাড়িটা সুনসান হয়ে গেল কয়েকদিনের ব্যবধানে। এদিকে যে বাঁধন একদিনের জন্যও চোখের আড়াল করেনি স্বামীকে। আজ সে কতদিন যাবত যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে অভাবের সংসারটিকে সচল রাখতে। নীরব আর বাঁধনের ভবিষ্যৎ সাজাতে।

বাঁধন প্রেম করে বিয়ে করেনি, বিয়ে করে প্রেম করেছে। কারণ সে জানে বিয়ের পূর্বে প্রেম, নর-নারীর অবাধ মেলামেশা ইসলামে নিষেধ করা হয়েছে। তাই বিয়ের পর স্বামীকে মন-প্রাণ-দেহ সবই উজাড় করে দিয়েছে। ভালোবেসেছে। সে ভালোবাসায় কোনো কৃপণতা ছিল না। ছিল না কলঙ্কের দাগ।

বাঁধনের স্বামী শামসুল ইসলাম। ডাকনাম শাম্‌স। একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে ম্যানেজারের চাকরি নিয়েছে। চাকরিটা নিতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে তাকে। চাকরি যে এ দেশে সোনার হরিণ। ঘুষ বা রাজনৈতিক সুপারিশ ছাড়া চাকরি মেলা ভার। পড়ালেখা শেষ করেও দিনের পর দিন বেকারত্বের কষাঘাতে জর্জরিত ছিল শামস। বিয়ের আগে ছোটখাটো একটা ব্যবসা ছিল তার। বিয়ের পর বাঁধনকে সময় দিতে গিয়ে ব্যবসায় ধস নামে। নিজে না থাকলে ব্যবসায় যা হয় তাই হয়েছে। ক'মাস পরেই লাল বাতি জ্বলল ব্যবসায়। বাঁধনকে নিয়ে সুখের স্বর্গে বাস করলেও অভাব নামের দানবটা তাড়া করতে লাগল শামসকে। এরই মাঝে তাদের কোলজুড়ে আসে একমাত্র সন্তান নীরব। মা-বাবার আদর-সোহাগ পেয়ে আস্তে আস্তে বেড়ে উঠতে লাগল সে। ছেলে আর বাঁধনের ভবিষ্যতের কথা ভেবে দুশ্চিন্তা চেপে বসল শামসের মাথায়। হন্যে হয়ে ঘুরেছে একটি চাকরির আশায়। অবশেষে চাকরি নামক সোনার হরিণের দেখা পেল সে। কিন্তু স্বল্প বেতনে কোনোরকম দিনাতিপাত করা ছাড়া উপায়ও যে নেই শামসের।

এদিকে বাঁধন আর নীরবকে ছাড়া কষ্টময় জীবন কাটছে তার। বিয়ের পর একদিনের জন্যও দূরে থাকেনি বাঁধনের কাছ থেকে। বাঁধনের বাঁধনেই ছিল তার সুখ। সব প্রশান্তি। বাঁধন যে তার ভালোবাসার হলুদিয়া পাখি। আর শিশু সন্তানটা তো কলিজার টুকরা। জন্মের পর থেকে আদর দিয়ে কাছে রেখে সময় কাটিয়েছে। কখনো চোখের আড়াল করেনি। আজ তারই ভবিষ্যৎ গড়তে তার কাছ থেকে দূরে থাকতে হচ্ছে। হায়রে নিয়তি! কতইনা সুখের সংসার ছিল তার। নীরব, বাঁধন আর সে। শামসের ভাবনার অতল গভীর থেকে আজ সেসব স্মৃতিই বারবার ভেসে বেড়াচ্ছে হৃদয়ের ক্যানভাসে। মুঠোফোনটা বের করে বাঁধনের উদ্দেশে একটা এসএমএস লিখল শামস। পাঠাতে গিয়ে শঙ্কায় পড়ে গেল সে। পাঠাবে কি পাঠাবে না সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে ভুগতে অবশেষে পাঠিয়ে দিল এসএমএসটি।

এসএমএসটি যখন বাঁধনের কাছে পৌঁছল তখন নীরবকে ঘুম পাড়িয়ে একাকী বিছানায় শুয়ে ছিল বাঁধন। ম্যাসেজ টোনের শব্দে বুকের ভেতরটা কেঁপে উঠল বাঁধনের। এসএমএসটা পড়ে চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানিতে বালিশ ভেজাল বাঁধন।

শামস লিখেছে- 'প্রাণের বাঁধন, তোমার ভালোবাসা আমায় দিয়েছে নতুন জীবন। কিন্তু আমি তোমায় কিছুই দিতে পারিনি। টাকার অভাবে একটা ভালো পোশাক কিনে দিতে পারিনি। ভালো খাবার খাওয়াতে পারিনি। আজ এই টাকার জন্য তোমাদের ছেড়ে একাকী জীবন কাটাতে হচ্ছে। জানি তুমি আমাকে ছাড়া কখনো থাকনি। নীরব থাকেনি আব্বুকে ছাড়া। একমাত্র টাকার জন্যই আজ তোমাদের সঙ্গে আমার এই দূরত্ব। টাকাই আমার হৃদয়ের সঙ্গে বাঁধা বাঁধনের বাঁধন খুলে দিয়েছে। নিষ্ঠুর টাকা। নির্দয় টাকা।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে