শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

অর্থ নয়, প্রয়োজন সদিচ্ছা

মো. আশরাফ উদ্দিন আসিফ
  ০৬ মার্চ ২০২৩, ০০:০০

কুড়িগ্রামের দিনমুজুর জয়নাল আবেদীনের ৩৫০০ বইয়ের লাইব্রেরি গড়ার খবরটি আমার কাছে আলাদাভাবে নজর কেড়েছে। অর্থবৃত্ত মানুষকে কখনো কখনো ভালো কাজের প্রতি আগ্রহী করতে পারে না। আবার কখনো কখনো অতি দরিদ্রতাও মানুষকে তার অসাধ্য সাধনে আটকাতে পারে না। অন্যের বাড়িতে কাজ করে মাসিক কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করে জমি কিনে গড়েছেন ৩৫০০ বইয়ের লাইব্রেরি। কোনো প্রশংসাই দিনমজুর জয়নাল আবেদীনের জন্য যথেষ্ট নয়। পরের বাড়িতে কাজ করার ফাঁকে ফাঁকে সময় বের করে সকাল-বিকাল মানুষকে বই পড়ার জন্য লাইব্রেরি খুলে দিচ্ছেন জয়নাল আবেদীন। বই পড়ায় কি মোহিনী শক্তি! কি মধুমাখা বিষ সংযুক্ত প্রেম! শত কুর্নিশ তোকে, মোহের চাকচিক্য এমন দিনমজুরের কাছে পরাস্ত। প্রতিটি স্থানে, প্রতিটি জায়গায় এমন একজন দিনমজুর জন্ম নিক যার প্রতিটি ঘামের ফোঁটায় একেকজন মানুষ আলোকিত হবে, আলোকিত হবে প্রতিটি স্থান, প্রতিটি জায়গা তথা সমস্ত বাংলাদেশ।

মনোবল যেখানে ইস্পাতসম সেখানে কোনো বাধাই প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে না তার জলন্ত উদাহরণ কুড়িগ্রামের দিনমজুর এই জয়নাল আবেদীন। তার এই মহৎ কাজকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই। সত্যিকার অর্থে দিন এনে দিন খাওয়া মানুষের জন্য ৩৫০০ বইয়ের লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা বিলাসিতা ছাড়া বৈকি? ওমর খৈয়াম বলেছিলেন 'প্রকৃতপক্ষে রুটি, মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা- যদি তেমন বই হয়'। আবার সৈয়দ মুজতবা আলী কয়েক দশক আগে বলেছিলেন, 'বই কিনে কেউ দেউলিয়া হয় না'। এই উক্তিগুলোর যেন যথার্থতা প্রমাণ করার কঠিন সংগ্রামে নেমেছেন জয়নাল আবেদীন। ইতিহাস হতে চলেছেন জয়নাল আবেদীনের গড়া লাইব্রেরি। আমার চোখে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে গেছে জয়নাল আবেদীন। আমরা যারা সমাজে মধ্যবিত্ত কিংবা উচ্চবিত্ত অবস্থানে আছি তাদের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও এমন একটি ভালো কাজের প্রতি আগ্রহী হতে পারি না। আসলে ভালো কাজের জন্য দরকার ভালো উদ্যোগ। টাকা পয়সা বা অভাব কোনো ভালো কাজের জন্য বাধা হতে পারে না সেটা আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন জয়নাল আবেদীন।

বর্তমান সমাজে মানুষ নিজে কীভাবে ভালো থাকবে, ভালো খাবে, ভালো পরবে সেই চিন্তায় ব্যতিব্যস্ত। এই সমাজের বেশির ভাগ মানুষই যেখানে কি ন্যায় কি অন্যায় না ভেবে অর্থোপার্জনে দিনরাত চেষ্টায় মত্ত, সেখানে কিছু পরোপকারী সমাজ সচেতন মানুষের ব্যতিক্রমী চিন্তাচেতনা আমাদের বাড়তি অনুপ্রেরণা জোগায় নিঃসন্দেহে। একজন মানুষকে বাঁচতে হলে খুব বেশি অর্থ-কড়ির প্রয়োজন পড়ে না। তবুও আমরা অর্থের পেছনে অন্ধের মতো ছুটছি অবিরাম। ভালো কাজের ফুসরত মেলে না আমাদের। আচমকা যদি কেউ ভালো কাজ করে তবুও আমরা বাহবা দিতে কুণ্ঠাবোধ করি। আমাদের ধ্যান-ধারণাটা এমন যে, আমি ভালো কাজ করব না কিন্তু সে কেন মহৎ কাজ করবে? আমরা জাতে মানুষ, আমাদের হিংসা-বিদ্বেষ থাকবেই তাই বলে একটু অনুপ্রেরণা কেন আমরা কাউকে দিতে পারব না? আমাদের একটু অনুপ্রেরণায় জেগে উঠতে পারে একটি সমাজ, জেগে উঠতে পারে আমাদের মনুষত্ব। প্রকৃত পক্ষে বই একটা সমাজকে বদলে দিতে পারে। একটা সময় ছিল আমাদের অবসর কাটতো বই পড়ে। তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার ঘটার ফলে ইন্টারনেটে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব খুব জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। কমছে বই পড়ার আগ্রহ, তৈরি হচ্ছে না পাঠাগার গড়ার প্রতি মানুষের আগ্রহ। এখন আমাদের নিত্য সঙ্গী মোবাইল আর কম্পিউটার। খেলাধুলা, সঙ্গীতচর্চা, নাটক, সিনেমা ও বই পড়ার মাধ্যমে মানসিক এবং সাংস্কৃতিক বিকাশ ঘটে তার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। মুক্তবুদ্ধির চিন্তাচেতনার সমৃদ্ধি এখন আর লক্ষ্য করা যায় না। কিছুকাল আগেও যেখানে গ্রামের মানুষের বিস্তীর্ণ মাঠে নানান ধরনের খেলাধুলার সুযোগ ছিল, খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুরে সাঁতার কাটা, ঘুরি উড়ানো মধ্য দিয়ে দৈহিক ও মানসিক বিকাশের অবারিত সুযোগ ছিল। পাড়া-মহলস্নাগুলোতে ছিল বিভিন্ন ক্লাব, সংগঠন ও পাঠাগার। কিন্তু আজ এর সব কিছুই সংকুচিত হয়ে আসছে। মাঠ-ঘাট, নদী-নালা, পুকুর দ্রম্নত ভরাট হয়ে আসছে। খেলাধুলা,গানবাজনা আর আগের মতো হয় না।

বই মানুষকে যুক্তিবুদ্ধি জোগায়, তাকে চিন্তাশীল করে তোলে তার ভেতরের সুপ্ত প্রতিভাকে জাগিয়ে একজন আদর্শ ব্যক্তি হিসেবে সমাজে নতুন করে রূপদান করে। বই মানুষের ভেতরের সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলে সৃজনশীল ও মননশীল জাতি হিসেবে প্রত্যাশিত মাত্রায় বিকশিত করতে পারে। একজন মানুষের জ্ঞানের প্রতিভা পরিপূর্ণ বিকশিত হয়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন জ্ঞানের অবাধ, উন্মুক্ত সাহিত্যচর্চা। সভ্যতার সঠিক মূল্যবোধ ও ভেতরের প্রতিভাকে বিকশিত করার জন্য বইয়ের বিকল্প নেই। কিন্তু ডিজিটাল যোগাযোগ প্রযুক্তি দ্রম্নত বিস্তারের ফলে তথ্য ও জ্ঞান প্রসারের অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশে বইয়ের বিকল্প হিসেবে ই-বুকের প্রচলন বাড়ছে। কিন্তু অতি দুঃখের বিষয় যাদের মধ্যে এতটুকু বই পড়ার অভ্যাস ছিল তাও আজ হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম। আমাদের মতো তথ্য প্রযুক্তিতে পিছিয়ে পড়া জাতির মধ্যে ই-বুক পড়ার প্রবণতা তৈরি হবে সেই আশা করা বোকার স্বর্গে বসবাস করা ছাড়া আর কিছুই নয়। আর সেজন্য দরকার পাড়া-মহলস্নায় অলিতে-গলিতে পাঠাগার গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করা। সেখানে তৈরি হবে লেখক, কবি, সাহিত্যিক। তাদের মননশীল ও বৈচিত্রময় লেখনীর মাধ্যমে জেগে উঠবে সুপ্ত প্রতিভা, প্রসার ঘটবে মেধা ও মননশীলতার।

পাঠক বইয়ের কাছে না গেলেও যেন বই পাঠকের কাছে চলে আসে আমাদের মাঝে সেই মনোভাবের চিন্তা জাগ্রত করতে হবে। সে জন্য দরকার সামাজিক ও সাংগঠনিক উদ্যোগ। আর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য তরুণদের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে, রাখতে হবে অগ্রণী ভূমিকা। প্রতিটি পাড়া-মহলস্নায় এগিয়ে আসতে হবে একেক জন জয়নাল আবেদীনকে। আর এই অকুতোভয় সাহসী ও বই যোদ্ধাদের সহযোগিতায় এগিয়ে আসতে হবে তরুণ সমাজকে, এগিয়ে আসতে হবে এই সমাজ তথা দেশকে। তবেই সঠিক দিশা পাবে দিনমজুর জয়নাল আবেদীনরা। আর এভাবেই বদলাতে শুরু করবে সমাজ, আমরা হবো প্রতিভা সম্পন্ন মননশীল জাতি, গড়ে উঠবে সুখী ও সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ। দিনমজুর জয়নাল আবেদীনের কাছে এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে