রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

একাত্তরের হেমন্ত

খলিফা আশরাফ
  ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

হেমন্তকে বলা হয় ঋতু রানী। এই ঋতুতেই চিরায়ত বাংলা অনন্য মাধুর্যে নন্দিত সজ্জায় ঐশ্বর্যময় রূপে আবির্ভূত হয়। একটা শান্ত, স্নিগ্ধ, মনোহর লাবণ্য ফুটে ওঠে প্রকৃতির প্রতিটি অঙ্গে। ওম মাখানো পুষ্পের সমারোহ, পক্ব সোনালি ধানের শীষে মৃদুমন্দ বাতাসের হিলেস্নালিত অপরূপ শোভা, পত্র পলস্নব আর দুর্বার ডগায় জমে থাকা মুক্তো শিশির, নবান্নের প্রাণময় উৎসব মিলেমিশে বাঙালির হৃদযন্ত্রে এক অপরূপ আনন্দের চাঞ্চল্য সৃষ্টি করে। বাঙালি হৃদযন্ত্রে নেচে ওঠে অপার পুলক সম্ভারে।

কিন্তু একাত্তরের হেমন্ত এমন ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ তখন চূড়ান্ত পরিণতির দিকে। যুদ্ধ চলছে এখানে সেখানে, সর্বত্র। কোথাও চোরাগোপ্তা, কোথাও বা সম্মুখ সমরে। মৃতু্যর বিভীষিকা চারদিকে। জননী জন্মভূমির সবুজ আঁচলে ছোপ ছোপ রক্তের দাগ, হানাদার পাকিস্তানি সৈন্য আর তার দোসরদের নারকীয় মৃতু্য আতঙ্কে সন্ত্রস্ত ছিল সব জনপদ। কিন্তু বাঙালিদের মধ্যে কিছু ব্যতিক্রমী কুলাঙ্গার ছাড়া সবাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। বালক-বালিকা থেকে প্রৌঢ় প্রত্যেকের মুখেই ছিল স্বাধীনতার জয়গান, দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য আকুল প্রার্থনা। দেশের স্বাধীনতার জন্য কেউবা মসজিদে সিন্নি দিচ্ছে, কেউবা মানত মানছে মন্দির, গির্জা ও প্যাগোডায়। আধো আধো কণ্ঠে শিশুরাও বলছে 'জয় বাংলা'।

সেদিনের হেমন্ত ছিল যুদ্ধের সাজে। দুর্বার উৎফুলস্ন ডগায় মুক্তো শিশির ছিল না, নবান্নের উৎসবে জননী সাজেনি আনন্দ গৌরবে, মৃতু্যর ক্রন্দন ছিল ভয়ার্ত দুই চোখে। সেদিন পাকা ধানের ক্ষেতে দখিনা বাতাসের হিলেস্নাল দেখেনি কেউ, মৃতু্যর করাল থাবার মুখে সন্ত্রস্ত ছিল অনিশ্চিত ভীষণ। সেদিন প্রাণবন্ত কিষানীরা নবান্নের উৎসবে ওঠেনি মেতে পিঠাপুলির আয়োজনে। নরপশুদের হাত থেকে বাঁচার জন্য শঙ্কিত ছিল প্রতিটি মুহূর্তে। কেউ বুকের শিশুকে আঁকড়ে ধরে দৌড়াচ্ছে মাইলের পর মাইল, কেউবা খালে-বিলে পুকুরে ডুবে কচুরিপানার মধ্যে থেকেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, অথবা কেউ ফসলের মাঠে, ঝোপঝাড় জঙ্গলে ভয়ার্ত কাটিয়েছে রাত। যুবতী জয়া ভগ্নির ভয় ছিল নরপশুদের লোলুপ পাশবিকতার। হেমন্ত প্রকৃতিতে ছিল সম্ভ্রম হারানোর উদ্ধত ভীতি, মৃতু্যর পরোয়ানা নিয়ে শানিত কৃষাণ। একাত্তরের হেমন্তে পলাশ আর জবার সব লাল মিলেমিশে একাকার হয়েছিল গুলিবিদ্ধ লাশের রক্তের সঙ্গে। সেদিন মৃতু্যভয় সেঁটে ছিল হেমন্তের বুকে।

একাত্তরের হেমন্তে মানুষের বুকে পুষ্পের সৌরভের পরিবর্তে বারুদ ছিল, মাতৃভূমি স্বাধীনের অগ্নি শপথ ছিল, আত্মবিসর্জনের নির্ভীক প্রত্যয় ছিল অন্তর্গত বুকের পাঁজরে। আকাশে বাতাসে সেদিন আসন্ন বিজয়ের সৌরভ ছিল, হানাদার পাকবহিনীর নিশ্চিত পরাজয়ের সুস্পষ্ট আলামত ছিল, সেই হেমন্তের খাঁজে খাঁজে স্বাধীনতার স্বপ্ন উঁকি দিয়েছিল, মুক্তিবাহিনীর বিজয়ের সংবাদ ছিল ইথারে ইথারে।

সেদিনের অতুল স্নিগ্ধ হেমন্ত স্বাধীনতাকামী বাঙালি হৃদয়কে ব্যক্তি ভালোবাসায় আবদ্ধ রাখেনি, কিশোর, যুবক, প্রৌঢ়কেও জননী জন্মভূমির মুক্তির জন্য আত্মবিসর্জনে উদ্বুদ্ধ করেছিল। অকুতোভয় মুক্তিযোদ্ধারা বেয়োনেটের ফলায় জীবনকে বেঁধে প্রাণপণ যুদ্ধ করছে মাতৃভূমিকে স্বাধীন করার জন্য। ডানে কিংবা বামে লুটিয়ে পড়ছে সহযোদ্ধা, ছিটকে পড়ছে মাথার মগজ, বেরিয়ে গেছে পেটের নাড়ি ভুঁড়ি, সে এক বীভৎস দৃশ্য। অগ্র পশ্চাতে বিকট শব্দে ফাটছে গোলা, বৃষ্টির মতো ঝাঁকঝাঁক গুলি শনশন করে উড়ে যাচ্ছে মাথার ওপর দিয়ে। তবুও জীবন বাজি রাখা নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধারা এগিয়ে চলেছে অদম্য সাহসে। তাদের মস্তিষ্কে অতুল সাহসে ধ্বনিত হচ্ছে, 'এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'।

একাত্তরের হেমন্ত সেদিন অন্য সাজে সেজেছিল। মুক্তিযুদ্ধের সাজে, দেশকে শত্রম্নমুক্ত করার সাজে, স্বাধীন বাংলাদেশ পাওয়ার সাজে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে