শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

দখলমুক্ত ফুটপাত নাগরিক অধিকার

রাজধানীতে বেপরোয়া বাস ফুটপাতে উঠে পথযাত্রী মৃতু্যর ঘটনাও ঘটছে। ফুটপাত থাকবে হকারদের দখলে, পথচারী নামবেন রাস্তায়, এ-ই যেন শহরের নিয়ম হয়ে পড়ছে! ২০১৮ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে 'গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট'-এর সভায় সড়কে শৃঙ্খলা আনার জন্য বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে সভায় ২০ দফা সুপারিশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে দুইটি সুপারিশ ছিল- ফুট ওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাসের আশপাশে রাস্তা পারাপার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা এবং পথচারীদের চলাচলের সুবিধার জন্য ফুটপাত হকারমুক্ত করা। কিন্তু এসব নির্দেশনার কোনো বাস্তবায়ন হয়নি
অ্যাডভোকেট মো. সাইফুদ্দীন খালেদ
  ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২২, ০০:০০

ফুটপাত শুধু রাস্তা বা সড়কের সৌন্দর্যই বাড়ায় না। পথচারীদের নিরাপদে হাঁটা ও চলাচলের উপযুক্ত স্থান ফুটপাত। প্রশস্ত ফুটপাতের কারণে যানজট বা দুর্ঘটনাও কমে অনেক। ব্যস্ত নগরীকে যানজটমুক্ত রাখতে স্বল্প দূরত্বে হেঁটে চলারও কোনো বিকল্প নেই। কিন্তু এই ফুটপাত কি আসলেই পথচারীদের জন্য? ফুটপাতের বর্তমান চিত্র হচ্ছে, ফুটপাত আছে আবার ফুটপাত নেই।

ফুটপাত যে মানুষের চলাচলের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে, একটা চরম বিশৃঙ্খলা এবং সময়ের বিশাল অপচয় হচ্ছে- যার ফলে মানুষের জন্য নগর বসবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে, সেদিকে কি থাকাবেন? ছোট ছোট দোকান, নির্মাণসামগ্রী, ব্যবসাসামগ্রী আর হকারদের ঠেলে গন্তব্যে পৌঁছাতে প্রতিদিনই হয়রানি পোহাচ্ছেন পথচারীরা। আবার কোথাও কোথাও পাশের দোকানের পণ্যসামগ্রী রাখা হয় সামনের ফুটপাত দখল করে। ফুটপাতে ব্যবসা বা খাবার বিক্রয় কেন করবে। ফুটপাতে ভাসমান ব্যবসায়ী, হকার, অবৈধ পার্কিং ইত্যাদি কারণে ব্যস্ততম রাস্তাগুলোতে দিনের বেশির ভাগ সময় লেগে থাকে যানজট।

মানুষ যেন মেনেই নিয়েছে এই পরিস্থিতিকে। কখনো কখনো ফুটপাতে গর্তও দেখা যায়। কোথাও কোথাও মূল রাস্তাকে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজে কেটে ফুটপাত আরো ছোট করে ফেলা হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে বিশেষ করে নগর ব্যবস্থাপনার মধ্যে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্তৃপক্ষের মধ্যে রয়েছে সমন্বয় ও সমঝোতার অভাব।

বর্ষাকালে ড্রেনেজ ব্যবস্থার সংস্কার, ওয়াসার লাইন স্থাপনের জন্য সংস্কার করা রাস্তা খুঁড়ে লাইন বসানো হয়। আবার কোথাও কোথাও রয়েছে ডাস্টবিন। এতে যানবাহন ও পথচারী চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে। সেই সঙ্গে ভোগান্তির মধ্যেও পড়ছেন পথচারী ও যানবাহন চালকরা। এতে মাঝেমধ্যে দুর্ঘটনাও ঘটছে। এতকিছুর পরেও যেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের টনক নড়ে না।

মানুষের চলাচল নির্বিঘ্ন ও নগরবাসীকে যানজটমুক্ত রাখতে হলে ফুটপাত দখলমুক্ত ও সংস্কার করার কোনো বিকল্প নেই। আসলে ফুটপাত দখলমুক্ত করতে হলে উভয়পক্ষ থেকেই দায়িত্বশীল কর্মপন্থা অবলম্বন করতে হবে। স্রোতের মতো হকাররা আসতে থাকবে আর তারা ফুটপাতে ব্যবসাবাণিজ্য করবে, তারপর পুনর্বাসনের দাবি তুলবে, এটি কখনো বাস্তবসম্মত নয়।

হকার স্থায়ী পুনর্বাসনের এই মানবিক দিকটি বিবেচনা করা দরকার। এ জন্য চাই সুস্পষ্ট নীতিমালা। কারা প্রকৃত হকার তাদের তালিকা তৈরি করতে হবে। একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে হবে। এ জন্য সবাইকে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে। কাজেই এমন ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে, যাতে পথচারী-হকার উভয়পক্ষের স্বার্থই রক্ষা হয়। গণসচেতনতা বাড়ানোর জন্য ফুটপাত দখলকারী ব্যবসায়ীদের দোরগোড়ায় যেতে হবে। তাদের পথচারীদের অধিকার সম্পর্কে বুঝিয়ে বলতে হবে।

আবার অনেক এলাকার রাস্তার ফুটপাত সংকীর্ণ, ভাঙাচোরা, কোথাও কোথাও এমন সংকীর্ণ যে একজন মানুষও হাঁটতে পারে না। বেশ কয়েকটি এলাকার ফুটপাতের চিত্র এমনই। ফুটপাত সংকীর্ণ করা নয় বরং প্রয়োজন হলে আরো প্রশস্ত করতে হবে। কোথাও আবার সড়কের সঙ্গে ফুটপাত মিশে একাকার হয়ে গেছে।

রাজধানীতে বেপরোয়া বাস ফুটপাতে উঠে পথযাত্রী মৃতু্যর ঘটনাও ঘটছে। ফুটপাত থাকবে হকারদের দখলে, পথচারী নামবেন রাস্তায়, এ-ই যেন শহরের নিয়ম হয়ে পড়ছে! ২০১৮ সালের আগস্ট মাসের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে 'গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট'-এর সভায় সড়কে শৃঙ্খলা আনার জন্য বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সে সভায় ২০ দফা সুপারিশ করা হয়েছিল। এর মধ্যে দুইটি সুপারিশ ছিল- ফুট ওভার ব্রিজ বা আন্ডারপাসের আশপাশে রাস্তা পারাপার সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা এবং পথচারীদের চলাচলের সুবিধার জন্য ফুটপাত হকারমুক্ত করা। কিন্তু এসব নির্দেশনার কোনো বাস্তবায়ন হয়নি।

পথচারীদের অবাধ যাতায়াতের সুবিধার জন্য ফুটপাত মেরামত করার মাধ্যমে পথচারী হাঁটার উপযুক্ত করা প্রয়োজন। ফুটপাতকে নাগরিক জীবনে ফিরিয়ে দেওয়া প্রশাসনের কাজ এবং জরুরি কাজ। প্রশাসনিক ঔদাসিন্যতার কারণে নাগরিক অধিকার নষ্ট হতে পারে না। দখলমুক্ত ফুটপাত নাগরিক অধিকার।

রাজনৈতিক দলের নেতারা নির্বাচনের আগে এসব দখল মুক্ত করে হকারদের পুনর্বাসন করার অঙ্গীকার করলেও নির্বাচনের পর তারা নীরব ভূমিকা পালন করেন। যে শহর যত বেশি নিরাপদ ও সুপ্রশস্ত ফুটপাত তৈরি করে, সেই শহর তত বেশি প্রাণবন্ত ও জনপ্রিয় হয়। জনবহুল বাণিজ্যিক এলাকার ক্ষেত্রে সাড়ে ছয় মিটার ফুটপাত রাখার মানদন্ড নির্ধারণ করেছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। যেখানে চার মিটার পথচারীদের জন্য, সবুজায়ন ও বিশ্রামের জন্য দেড় মিটার।

অথচ এ দেশে কোথাও বিশ্ব মানদন্ড অনুসরণ করে ফুটপাত নির্মাণ হচ্ছে না। ফুটপাত ব্যবহারের পাশাপাশি জেব্রা ক্রসিংও সড়কে দুর্ঘটনা এড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। পথচারীদের নিরাপদে সড়ক পার হওয়ার জন্য সাদা দাগ কেটে জেব্রা ক্রসিং তৈরি করা হয়। কিন্তু নগরীর বিভিন্ন এলাকায় দেখা যায়, যেসব স্থানে জেব্রা ক্রসিং আছে, সেখানে এর ব্যবহার তেমন নেই। অনেক জায়গায় ক্রসিংয়ের সাদা দাগের ওপরেই যানবাহন থেমে থাকছে। অধিকাংশ ড্রাইভার জানেনই না জেব্রা ক্রসিংয়ে গাড়ি থামাতে হয়।

জেব্রা ক্রসিংয়ের কাছাকাছি এলে গাড়ির গতি কমানোর নিয়ম। পথচারীরা পারাপারের সময়েও চালক যানবাহন না থামিয়েই দ্রম্নত চলে যায়। অনেক সময় জেব্রা ক্রসিংয়ে গাড়ি থামিয়ে যাত্রী তোলা হয় যানবাহনে। এখানে আরেকটা কথা বলে রাখি সময়ের চেয়ে আমাদের জীবনের মূল্য অনেক বেশি। নিরাপদ রাস্তা পারাপারে জনগণকে নিজ নিজ জায়গা থেকে সচেতন হতে হবে। সরকার জনগণের নিরাপদ রাস্তা পারাপারের জন্য ফুট ওভারব্রিজ, জেব্রাক্রসিং তৈরি করে, আর আমরা যদি তা ব্যবহার না করি তাহলে তার দায়ভার আমাদের নিতে হবে। আমরা যদি সবাই সচেতন হয়ে ফুট ওভারব্রিজ/ জেব্রাক্রসিং ব্যবহার করি এবং ফুটপাত সমস্যার সমাধান করা গেলে সড়ক দুর্ঘটনার হার অনেক কমে যাবে। আমাদের হাঁটার পথ হোক নিরাপদ।

\হলেখক: অ্যাডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে