শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলায় আইন শিক্ষা, আইন প্রণয়ন, ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ কতটুকু সম্ভব?

হাতেগোনা অল্প কিছু আইন বাদে এ দেশের সব আইন ইংরেজিতে তৈরি। দেশের সব জায়গায় বাংলাকে প্রচলন করতে হলে আইনগুলো বাংলাতে হওয়া জরুরি। এ বিষয়ে কোনো দ্বিমত থাকার কথা না। একই সঙ্গে দেশে আইন শিক্ষাও বাংলায় চালু করা জরুরি। এটা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। একটি বড় সংখ্যায় আইনের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, বিচারক ও আইনজীবীরা মনে করেন যে, আইন পুরোপুরি বাংলায় শেখা সম্ভব না। এ বিষয়ে তাদের কিছু যুক্তিও আছে। বাংলায় আইন শিক্ষা, আইন প্রণয়ন, বিচারকাজ পরিচালনার সমস্যা, চ্যালেঞ্জ, সম্ভাবনা নিয়ে দুই পর্বের আলোচনার আজ ছাপা হলো প্রথম পর্ব। লিখেছেন তালহা মুহাম্মদ
নতুনধারা
  ০১ মার্চ ২০২২, ০০:০০

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ইংরেজি ভাষায় আইন পড়েছি। দেশের অনেক পাবলিক/প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগগুলোতে আইন বাংলা এবং ইংরেজি দুটো ভাষাতেই চালু আছে। অন্যান্য ল' কলেজগুলোতে বাংলার ওপরই বেশি জোড় দেওয়া হয়। যাদের ইংরেজিতে আইন পড়ে ভালো করে মর্মার্থ উপলব্ধি করতে কষ্ট হয় তারাই বাংলায় পড়েন। ব্যতিক্রম অবশ্যই আছে।

হাতেগোনা অল্প কিছু আইন বাদে এ দেশের সব আইন ইংরেজিতে তৈরি। দেশের সব জায়গায় বাংলাকে প্রচলন করতে হলে আইনগুলো বাংলাতে হওয়া জরুরি। এ বিষয়ে কোনোর দ্বিমত থাকার কথা না। একই সঙ্গে দেশে আইন শিক্ষাও বাংলায় চালু করা জরুরি। এটা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। সেই বিতর্ক আবার কিছুটা নতুন করে আলোচিত হচ্ছে যখন ঢাবির বাংলা বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম গত ৬ ফেব্রম্নয়ারি, ২০২২ তারিখে প্রথম আলোতে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বললেন, 'আইন বিভাগ যত দিন পর্যন্ত বাংলার প্রয়োগটা না করছে, তত দিন পর্যন্ত উচ্চতর আদালতে বাংলা চালু হবে না। কেননা, এটা যেমন মানসিকতার ব্যাপার, আবার তেমন চর্চার ব্যাপারও। যিনি বাংলায় আইনগুলো শেখেননি, বাংলায় খসড়া করা শেখেননি, তিনি কী করে রায়টা বাংলায় দেবেন?'

একটি বড় সংখ্যায় আইনের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, বিচারক ও আইনজীবীরা মনে করেন যে, আইন পুরোপুরি বাংলা শেখা সম্ভব না। এ বিষয়ে তাদের কিছু যুক্তিও আছে। সেটা পরে আলোচনা করা হবে।

আগে দেখব, আসলেই বাংলায় আইন তৈরি, আইনের ব্যাখ্যা, আইন প্রয়োগ এবং আইন শিক্ষা কতটুকু সম্ভব।

আমরা দ্বিতীয় বর্ষে থাকাকালীন আধুনিক ভাষা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক শিশির ভট্টাচার্য স্যার আমাদের একটা ক্লাস নিয়েছিলেন। ক্লাসের বিষয় ছিল আদালতের ভাষাবাংলা হওয়া উচিত কিনা। সেই ক্লাসে তিনি পুরোপুরি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে আইন বাংলায় তৈরি করা সম্ভব এবং উচ্চ আদালতের ভাষাও বাংলা হওয়া উচিত। আমরা অনেক প্রশ্ন করেছিলাম। তিনি তার সঠিক উত্তর দিয়েছিলেন।

কিন্তু ক্লাস শেষে তারপরেও কেন যেন আমার মনে হতো আইন আসলে ইংরেজিতেই থাকা উচিত। অনার্স-মাস্টার্সে আইন ইংরেজিতেই শিখেছি এবং পরীক্ষার খাতায়ও ইংরেজিতেই লিখেছি। বাংলায় আইন শিখব এটা মেনে নিতে পারছিলাম না। কেন এরকম মনে হতো- তা আমি তখন বুঝিনি। এখন বুঝেছি। এরকম মনে হওয়ার কারণ ছিল আমার ইগো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে যদি আইন ইংরেজিতে না পড়ি তাহলে শরীরে ভাব আসে না। আমরা ইংরেজিতে আইন পড়ি আর অন্যরা বাংলায় আইন পড়ে এটা ভেবে সুখানুভূতি পাওয়া যায়।

ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজি কেবল একটা বিদেশি ভাষাই না। এটা একটা মর্যাদা বা ক্লাস (শ্রেণি)। যে ইংরেজি জানে সে এক শ্রেণির লোক আর যে ইংরেজি জানে না সে অন্য শ্রেণির লোক। বাংলাদেশে যারা ইংরেজি মিডিয়ামে পড়াশুনা করে তারা আলাদা শ্রেণির লোক। এইটা ভালোভাবে বোঝার জন্য ইরফান খানের 'হিন্দি মিডিয়াম' সিনেমাটি দেখতে পারেন। এজন্য ইংরেজিতে আইন পড়ে নিজেকে একটু আলাদা শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করার মানসিক তাড়নাও আমাদের মধ্যে কাজ করে।

পৃথিবীর এমন অনেক লোক আছে যারা হাঁচি দিলেও নাক দিয়ে ইংরেজি বের হয়। তাদেরও নিজেদের মাতৃভাষার সঙ্গে আপস করতে দেখা যায় না। বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘ কিংবা চীনের শান্তি সম্মেলনে যোগদান করে বাংলায় ভাষাণ দিয়েছিলেন। তিনি আপনার-আমার থেকে অনেক ভালো ইংরেজি জানতেন। শুধু মাতৃভাষার মর্যাদার জন্যই তিনি বাংলায় ভাষণ দিয়েছিলেন। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নেতাদের মধ্যেও এই বৈশিষ্ট্য রয়েছে। বর্তমানে আমাদের মাঝে সেই রকম আত্মমর্যাদাবোধ দেখা যায় না। ভাঙাচুরা ইংরেজি দিয়ে আমরা একখান সাক্ষাৎকার দিতে পারলে নিজেকে শাহেনশাহ ভেবে বসে থাকি।

যেই আইন দ্বারা এ দেশের লোকজন শাসিত হচ্ছে তা সবার বোধগম্য হওয়া দরকার। অনেকেই আইন সম্পর্কে জানার আগ্রহ প্রকাশ করে। কোন বই পড়লে আইনের সাধারণ বিষয়গুলো জানতে পারবে তা জানতে চায়। তখন তাদের নিরাশ করা ছাড়া উপায় থাকে না। যেই ইংরেজি পড়ে আমারই আইন বুঝতে কষ্ট হয়। কোন আক্কেলে তাদের সেই আইন পড়তে বলব? আবার বাংলায় লেখা ভালো কোনো আইনের বই বাজারে নেই। কোর্টের নিয়মকানুন সব ইংরেজিতে রেখে বাংলাভাষায় ভালো আইনের বই আশা করাটাও সমীচীন নয়।

আইন জানা জনগণের মৌলিক অধিকার। আমি মনে করি, নিরক্ষরতা দূর করার পরে একটি দেশের সরকারের অন্যতম কাজ হলো জনগণকে আইন সচেতন করে তোলা। জনগণকে আইন জানতে না দিলে আমরা আইন মান্যকারী নাগরিক কোথায় পাব? ইংরেজিতে আইন তৈরি করে সরকার তার এই দায় থেকে মুক্ত হতে পারে না। এই ক্ষেত্রে সরকারের পরেই কোর্টকাচারির দায় রয়েছে।

আইনের মৌলিক একটা বিধান হলো যে, আইনে অজ্ঞতা কোনো অজুহাত হতে পারে না (ওমহড়ৎধহপব ড়ভ :যব খধি রং হড়ঃ ধহ বীপঁংব)। অর্থাৎ কেউ আইন জানে না শুধু এই কারণে তার দায় থেকে রক্ষা পাবে না। এখন আপনি এমন একটি ভাষায় আইন রচনা করলেন যেই ভাষার ওপরে এ দেশের জনগণের দক্ষতা নেই। তাহলে জনসাধারণ কীভাবে আইন জানবে?

একটি উদাহরণ দেই: রেজিস্ট্রেশন আইন, ১৯০৮-এর ধারা ১৭ক অনুযায়ী স্থাবর সম্পত্তি বিক্রয়ের চুক্তি একমাসের মধ্যে রেজিস্ট্রেশন করা বাধ্যতামূলক। যদি তা না করা হয় তাহলে আইনে সেই চুক্তি বলবৎযোগ্য হবে না। এই আইন আপনি ইংরেজিতে তৈরি করলেন। ফলে জনগণ বুঝতে পারল না, জানতেও পারল না। আর সরকারও পাড়া-মহলস্নায় প্রচার করল না। এই না জানার কারণে যদি জনগণ কোনো ক্ষতির সম্মুখীন হয় তাহলে তা কি ন্যায়বিচার হবে?

আবার তামাদি আইনের বিধানগুলো যদি জনসাধারণ না জানে তাহলে দেখা যাবে শুধু এই না জানার কারণেই তারা আইনের প্রতিকার থেকে বঞ্চিত হবে। এর বাস্তব ফলাফল আমরা হাতেনাতে পাই না। কিন্তু এর প্রভাব সমাজে অবশ্যই রয়েছে। এরকম অসংখ্য উদাহরণ হাজির করা যাবে।

মামলার রায় মক্কেলদের জন্য জানা অপরিহার্য। মামলার রায় যখন ইংরেজিতে দেওয়া হয় তখন রায়টি মক্কেলের পক্ষে না বিপক্ষে একথা উকিলের কাছে শুনতে হয়। কিন্তু মামলার রায় কেন যে তার বিপক্ষে গেল বা পক্ষে আসল একথা তার জানার উপায় থাকে না। কারণ উকিল মহোদয়ের এত সময় নাই যে, পুরো রায় মক্কেলকে বুঝিয়ে দেবেন। কারণ উকিলের সময়ের মূল্য আছে। মক্কেলরা উকিলের যত কম সময় নেবেন তার বিল তত কম হবে।

অথচ মামলার রায় বাংলায় লেখা হলে মক্কেলদের এই দুর্ভোগ পোহাতে হয় না। মামলার রায় কেন তার পক্ষে আসল অথবা কেনই বা তার বিপক্ষে গেল এটা সে নিজে নিজে জানতে পারবে। এতে তাদের মানসিক প্রশান্তিও হয়।

পৃথিবীর বুকে প্রথম ভাষার জন্য বাঙালিরাই জীবন দিয়েছে। বাংলা ভাষাকে উসিলা করে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হচ্ছে। মাতৃভাষা মানে শুধু মায়ের ভাষাতে কথা বলার অধিকারই না; রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম মাতৃভাষায় চালু করতে হবে; মাতৃভাষায় শিক্ষা লাভের অধিকার দিতে হবে; মাতৃভাষায় আইন বোঝার অধিকার এবং আইনের প্রতিকার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

আইন দেশের গুটিকয়েক লোকের জন্য তৈরি হয় না। সর্বসাধারণের জন্য তৈরি হয়। মানুষ যত আইন জানবে তত আইন মান্য করার চেষ্টা করবে। ফলে কোর্টকাচারিতে মামলাও কম হবে। উকিলরা চাইলেই মক্কেলদের সঙ্গে হয়রানি করতে পারবে না, মামলা দীর্ঘায়িত করতে পারবে না। কোর্টে দৌড়াতে দৌড়াতে মক্কেলদের পাছার কাপড়ও ক্ষয় হবে না। আইন যাদের জীবিকা তারা আইনের ফাঁকফোকর খোঁজে; আর আইন যাদের প্রয়োজন তারা আইনের সুবিধা খোঁজে।

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। এর অর্থ রাষ্ট্রের সব কার্যক্রম বাংলাভাষাতেই চলবে। বাংলাভাষা প্রচলন আইন-১৯৮৭ এর ধারা ৩ এ বলা হয়েছে যে, 'এই আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশের সর্বত্র তথা সরকারি অফিস, আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যতীত অন্যান্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন আদালতের সওয়াল জবাব এবং অন্যান্য আইনানুগত কার্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখিতে হইবে।'

প্রায়ই একটা অভিযোগ করা হয় যে, এ দেশের কোর্টকাচারিতে বিশেষ করে জেলা জজ আদালতে যোগ্য আইনজীবীর খুব অভাব। এটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নাই। আইন আদালত কার্যক্রম বাংলায় হলে যোগ্য আইনজীবীদের অভাব অনেকটাই কমানো যেত। দেখুন, কেউ ওঊখঞঝ কিংবা এজঊ করে আইন পেশায় আসে না। কথা বলার কিংবা কারো সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য যতটুকু ইংরেজি দরকার সেটা শেখা খুব কঠিন কিছু না। কিন্তু ইংরেজিতে মানসম্মত কিছু লিখতে এবং কোনো বই পড়ে তার মর্ম উদ্ধার করতে যে পরিমাণ দক্ষতা ইংরেজি ভাষায় থাকতে হয় তা

অর্জন করা সহজ নয়।

ইংরেজিতে মৌলিক জ্ঞান না থাকলে কাউকে ওঊখঞঝ এবং এজঊ গুলিয়ে খাওয়াইলেও ভাল ইংরেজি পারবে না। বিশেষ করে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় তা আরও কঠিন। প্রথম শ্রেণি থেকে ইংরেজি পড়া আমাদের শুরু হয়। অনার্স-মাস্টার্স শেষ করে, অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বাদ দিলেও, কতজন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ভালো ইংরেজি পারে এবং বোঝে? এই হারটা খুব বেশি না। আর আমরা আইন আদালতের সবকিছুই ইংরেজিতে রেখে দিছি।

বলা হয় যে, আইনজীবী একটি চ্যালেঞ্জিং পেশা। কিন্তু অধিকাংশ আইনজীবীর প্রথম চ্যালেঞ্জটাই হয় ইংরেজিকে বদ করা। এক বন্ধু ঢাকার বাহিরের এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় আইন পরে ওকালতি পেশায় নিযুক্ত হয়েছে। কয়েক মাস আগে সে ডিএলআর থেকে একটা মামলার ছবি তুলে আমাকে পাঠায়। কারণ, মামলায় কি বলা হয়েছে তা সে বুঝতেছিল না। আমার কাছে মনে হয়েছে এটা ইংরেজিতে হওয়ায় তার বুঝতে কষ্ট হয়েছে। আইন পড়বে মানুষ সাহিত্যের মতো আনন্দচিত্তে। আর সেখানে আমরা ইচ্ছাকৃত অনেক বাধা দিয়ে রেখেছি।

তালহা মুহাম্মদ : শিক্ষানবিস আইনজীবী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে