বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

এজাহারে তারিখ বিভ্রাট ও একটি উল্টো বাঁকের বিচার

আমাদের সমাজে রাইটারদের মতো এমন অনেক লোক আছে যারা কারও ভালো করতে গিয়ে খারাপ করে ফেলে। আমরাই প্রয়োজনের সময়ে ভুল ব্যক্তির কাছে গিয়ে হিতে বিপরীত করে ফেলি। শুধু থানার রাইটার নন, বাস্তবে দেখেছি কিছু কিছু আইনজীবীও মামলা নিজে লেখেন না। মোহরার ড্রাফট করেন। তারা টানা সই করে দেন। শুনানিকালে অনুপস্থিত বিজ্ঞ আইনজীবীকে ডেকে আনার জন্য বললে তারা বলেন, তারা তাদের আইনজীবীকে চেনেন না। তবে আইনজীবী সহকারীকে ঠিকই চেনেন। এভাবে মোহরার-রাইটারদের জ্ঞানের স্বল্পতা, বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে সংযোগের অভাব এবং দায়িত্বশীলদের উদাসীনতার কারণে এমন ছোট ছোট ভুল বিচারের সময় বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়
ম সাইফুল ইসলাম পলাশ
  ০২ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

যুক্তিতর্ক শুনানিকালে হঠাৎ একটা বিষয় আমার নজরে এলো। এমন একটা বিষয় যার ফলে এজাহারকারীর ন্যায়বিচার পাওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। অথচ ঘটনা সত্য। সব সাক্ষীরা ঘটনাকে সমর্থন করে সাক্ষ্য দিয়েছে।

ঘটনাটা সম্ভবত ২০১৬ সালের। আসামি শফিকের সঙ্গে এজাহারকারী রেজিয়ার ঝগড়ার কারণটাও ছিল তুচ্ছ। সেদিন রেজিয়ার ছাগল আসামির ক্ষেত খেয়ে নিচ্ছিল। এক কথা দুই কথায় ঝগড়া শুরু হয়ে যায়। ঘটনাস্থলে থাকা একটি বাঁশের খুঁটি দিয়ে শফিক রেজিয়ার পায়ে আঘাত করেন। রেজিয়া সেখানেই কাতরাতে থাকেন। তার চিৎকারে সাক্ষীরা তাকে ধরে সেদিনই তানোর হাসপাতালে ভর্তি করেন। এক্স-রে করে দেখা যায়, তার পায়ের দুটো হাড়ের মধ্যে মোটা হাড়টিই (ঞরনরধ) ভেঙে (ঋৎধপঃঁৎব) গেছে।

রেজিয়ার মামলা রেকর্ড হয় পেনাল কোডের ৩২৫ ও ৫০৬ ধারায়। ধারা জামিনযোগ্য হওয়ায় খুব সহজেই আমলী আদালত থেকে জামিন পেয়ে যান শফিক। অথচ রেজিয়ার সুস্থ হতে সময় লেগেছিল প্রায় ০৪ মাস। পায়ের উপর দাঁড়াতেই সময় লেগেছে দুই মাস। রেজিয়া হিসাব মেলাতে পারেন না। এত বড় আঘাত, তবু কেন এক দিনের জন্য হাজতে গেল না আসামি!

ঘটনার প্রায় দু'বছর পর ২০১৮ সালের কোনো এক মাসে যুক্তিতর্ক শুনানি চলছে। একপর্যায়ে দেখি, মামলার ঘটনার তারিখ ৩০/০৬/২০১৬ খ্রি. কিন্তু রেজিয়া হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য ভর্তি হয়েছিলেন ৩০/০৫/২০১৬ খ্রি. অর্থাৎ মামলার ঘটনার তারিখের এক মাস আগে রেজিয়া হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা নিয়েছেন। প্রথমে ভাবলাম চিকিৎসা সনদে নিশ্চয়ই করণিক ত্রম্নটি (ঈষবৎরপধষ সরংঃধশব) হয়েছে। পরে দেখি, চিকিৎসার ছাড়পত্র একই কথা বলছে। সেই মর্মে চিকিৎসক সাক্ষী আদালতে এসে সাক্ষ্যও প্রদান করেছেন।

কোনো ফৌজদারি মামলায় যখন প্রসিকিউশন পক্ষ ঘটনার তারিখ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়, তখন ঘটনাটির স্থান ও ধরন প্রমাণের প্রশ্ন উঠতে পারে না। সময়, স্থান এবং ঘটনার ধরনের মধ্যে একটা শক্তিশালী যোগসূত্র রয়েছে। যেখানে অপরাধ সংঘটনের কোনো তারিখ নেই, সেখানে কোনো সময়, স্থান ও ঘটনার ধরন থাকতে পারে না [অহধিৎ ঐড়ংংধরহ ঠং. ঞযব ংঃধঃব (ঈৎরসরহধষ) ৬৮ উখজ ঢ়ধমব ৭৬ ]। অনুরূপভাবে এই মামলাতেও ঘটনার তারিখ প্রমাণিত হয়নি।

এজাহারকারীর জেরায় দেখা গেল, এজাহার লিখেছেন থানার রাইটার। এজাহার লেখার পর তিনি তা পড়ে দেখেননি। রেজিয়াকে তা পড়েও শোনানো হয়নি (মৌখিক এজাহার লিখিত হলে তা পড়ে শোনাতে হবে- সিআরপিসি'র ১৫৪ ধারা)। এতদিন সিনিয়র আইনজীবীদের এই জেরা মূল্যহীন মনে হতো। সেদিন প্রথম এর গুরুত্ব উপলব্ধি করলাম।

এ সম্পর্কে মাননীয় হাইকোর্টের একটা নজিরও পড়েছিলাম। গড়ঃধষবন ঠং. ঝঃধঃব; ৯ ইখঈ (২০০৪) ঐঈউ ১৫৫ মামলায় হাইকোর্ট অভিমত দেন যে, 'ঊলযধৎ ৎিরঃঃবহ নু ধহ অফাড়পধঃব - ঘড়ঃ ৎবধফ ড়াবৎ :ড় :যব রহভড়ৎসধহঃ- ংরসঢ়ষু ঢ়ঁঃ যরং ংরমহধঃঁৎব :যবৎবরহ রিঃযড়ঁঃ মড়রহম :যৎড়ঁময :যব পড়হঃবহঃং ড়ভ রঃ- পৎবধঃবং ফড়ঁনঃ ধনড়ঁঃ :যব ঢ়ৎড়ংবপঁঃরড়হ পধংব.' হাইকোর্টের এই নজিরটা যেন এই মামলার সঙ্গে মিলে যায়। তবে কী মামলার ঘটনা মিথ্যা, সাজানো ও বানোয়াট!

আমার বারবার মনে হচ্ছিল কোথাও একটা ভুল হয়েছে। আবারও প্রত্যেক সাক্ষীর জবানবন্দি, জেরা পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পর্যবেক্ষণ করলাম। তাদের আবেগ, বলার ধরন, সাক্ষ্য গ্রহণকালে ভিকটিমের আচরণ সম্পর্কিত নোট ও ঘটনার পারিপার্শ্বিকতা ইত্যাদি দেখে মনে হলো তারা সবাই সত্য বলছে।

আবার এটাও হতে পারে এজাহার যথাসময়ে দেওয়া হলেও তা বিলম্বে রেকর্ড হয়েছে। যেটাই ঘটুক না কেন এই মামলায় রাইটার রেজিয়ার ভালো করতে চেয়েছিলেন। তিনি জানতেন বিলম্বে মামলা দায়ের হলে মামলা সন্দেহজনক হয়। এজন্য তিনি মামলাটিকে শক্ত করার জন্য প্রকৃত ঘটনার তারিখের চেয়ে একমাস সময় কমিয়েও দিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি এটা জানেন না সন্তোষজনক ব্যাখা থাকলে বিলম্বজনিত এজাহার প্রসিকিউশন মামলাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে না। বরং এ দেশে সন্তোষজনক ব্যাখ্যায় ঘটনার ২১ বছর পরেও মামলা দায়ের করে প্রমাণ হয়েছে। তাই মামলা দায়েরে বিলম্ব প্রসিকিউশন মামলা অবিশ্বাসের ভিত্তি নয়। বিভিন্ন পরিস্থিতিতে মামলা দায়ের করতে বিলম্ব হতে পারে [গধলড়ৎ ইধুষঁষ ঐঁফধ াং. ঝঃধঃব; ৬২ উখজ (অউ) ২০১০ ঢ়ধমব ১৪৬, ঢ়ধৎধ ৫৪৬ ]।

আমাদের সমাজে রাইটারদের মতো এমন অনেক লোক আছে যারা কারও ভালো করতে গিয়ে খারাপ করে ফেলে। আমরাই প্রয়োজনের সময়ে ভুল ব্যক্তির কাছে গিয়ে হিতে বিপরীত করে ফেলি। শুধু থানার রাইটার নন, বাস্তবে দেখেছি কিছু কিছু আইনজীবীও মামলা নিজে লিখেন না। মোহরার ড্রাফট করেন। তারা টানা সই করে দেন। শুনানিকালে অনুপস্থিত বিজ্ঞ আইনজীবীকে ডেকে আনার জন্য বললে তারা বলেন, তারা তাদের আইনজীবীকে চেনেন না। তবে আইনজীবী সহকারীকে ঠিকই চেনেন। এভাবে মোহরার-রাইটারদের জ্ঞানের স্বল্পতা, বিচারপ্রার্থীদের সঙ্গে সংযোগের অভাব এবং দায়িত্বশীলদের উদাসীনতার কারণে এমন ছোট ছোট ভুল বিচারের সময় বড় প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।

তখন বিচার সংশ্লিষ্ট সবার প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।

১৫ দিন পর রায়ের দিন এলো। দুপক্ষই ডকে হাজির। আমি রায় ঘোষণার সময় আম্পায়ারের ভূমিকা থেকে সরে আসলাম। নিজের সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলাম। সম্পূর্ণ উল্টো বাঁক (ট-ঃঁৎহ) নিয়ে উভয় পক্ষকে আপস করার জন্য বললাম। এ বিষয়ে তাদের দীর্ঘ সময় বোঝালাম। আসামি পক্ষের আইনজীবীও সহযোগিতা করলেন।

জিজ্ঞেস করলাম, তারা আপসে রাজি আছে কি না? এতদিন তারা আপসে রাজি না হলেও বিস্ময়করভাবে সেদিন রাজি হয়ে গেল। আমিও যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম। রেজিয়াকে বললাম, 'আপনার চিকিৎসা বাবদ কত খরচ হয়েছে?'

তিনি বললেন, 'আমার স্বামীকে ছাড়া আপস কইরতে পারব না।' রেজিয়া তার স্বামীকে ফোন করলেন। তার স্বামী শামছু নিজের ভ্যান নিয়ে দুই ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির। শামছু জানালেন, "টাকা লিয়্যা আপস করব না...... টাকা লিয়্যা আপস করব না। শফিক অর ভাবির কাছে ক্ষমা চাহিলেই হবে।'

এজলাস ডায়াসের পাশে তিনজনকে মুখোমুখি করলাম। শফিক ক্ষমা চাইল রেজিয়ার কাছে। রেজিয়া চোখ মুছতে মুছতে বললেন, 'তুই একবার যদি আসতি, তাহলে এই কোর্ট-কাচারি করতে যাইতুম না।'

এজলাসে তিনজনই ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। শেষ বিকালে পিনপতন নীরবতায় তাদের কান্নার আওয়াজ ক্রমশ ভারী হয়ে যাচ্ছে। শান্ত বিকালের ক্লান্ত ছায়ায় একটা ধূসর প্রলেপে আমারও মনটা ছেয়ে গেছে। তাদের কান্না ভাইরাসের সংক্রমণে নিজের অনিবার্য কান্নাকে সংবরণ করলাম। নিজেকে আড়াল করে দ্রম্নতই এজলাশ ত্যাগ করলাম।

প্রস্থানকালে শুধু বললাম, 'আজ মামলায় দু'পক্ষই জিতেছেন। আজ থেকে আর আদালতে আসতে হবে না।'

খাস কামরায় ব্রিটিশ কবি এবড়ৎমব ঐবৎনবৎঃ-এর একটি উক্তি বারবার মনে হলো। উপলব্ধি করলাম, 'অ ষবধহ পড়সঢ়ৎড়সরংব রং নবঃঃবৎ :যধহ ধ ভধঃ ষধংিঁরঃ.'

বি. দ্র. মামলার ঘটনা সত্য। ঘটনার তারিখ আনুমানিক। পক্ষগণের ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে।

সাইফুল ইসলাম পলাশ: যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে