শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
স্ম র ণ

বরেণ্য আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেনের সংক্ষিপ্ত জীবনী

আইন ও বিচার ডেস্ক
  ১০ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আইনজীবী খন্দকার মাহবুব হোসেন ৩১ ডিসেম্বর রাত পৌনে ১১টায় রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। বিভিন্ন শারীরিক জটিলতায় ভুগছিলেন ৮৪ বছর বয়সি খন্দকার মাহবুব হোসেন। গত ২৮ ডিসেম্বর তাকে রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। শারীরিক অবস্থার অবনতি হওয়ার ভেন্টিলেটশন সাপোর্টে নেওয়া হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন প্রথিতযশা এই আইনজীবী।

খন্দকার মাহবুব হোসেন চার দফায় সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ছিলেন। বাংলাদেশ বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দুবার দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার পক্ষে আদালতে মামলা লড়তেন খন্দকার মাহবুব হোসেন। তিনি বাংলাদেশের ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ হিসেবে পরিচিত ছিলেন।

বরেণ্য এই আইনজীবীর মহাপ্রয়াণে তার

সংক্ষিপ্ত জীবনী জন্ম ও পরিচয়

১৯৩৮ সালের ২০ মার্চ বরগুনার বামনায় প্রখ্যাত এ আইনজীবীর জন্ম। পিতা খন্দকার আবুল হাসান শিক্ষাবিদ ছিলেন।

শিক্ষা জীবন

প্রাথমিক শিক্ষা জীবন কাটে বরগুনায়। এরপর উচ্চ মাধ্যমিকে পড়তে চলে আসেন নারায়ণগঞ্জে। ওঠেন খান সাহেব ওসমান আলীর পরিবারে। ভর্তি হন নারায়ণগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ে। ওই স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করে ভর্তি হন ঐতিহ্যবাহী নটর ডেম কলেজে। ছাত্র রাজনীতিতে জড়িয়ে পরায় পড়াশোনার গ্যাপ পড়ে। দু'বছর পর আইএসসি পরীক্ষা দেন। ১৯৫৮ সালে পাস করে ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে। ১৯৬৪ সালে ল' পাস করে আইন পেশা শুরু করেন।

ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধে অবদান

খন্দকার মাহবুব যখন নারায়ণগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সারাদেশ তখন উত্তাল। প্রতিদিন শহরের অলিগলিতে মিছিল হয়। ভাষার প্রতি আবেগ সংবরণ করতে পারেননি উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র খন্দকার মাহবুব হোসেন। যোগ দেন ওই প্রতিবাদী মিছিলে। মিছিল থেকেই পুলিশ তাকে আটক করে। এরপর তিন রাত কাটান নারায়ণগঞ্জ থানা হাজতে। ছাত্রাবস্থায় প্রথম ভোগ করেন হাজতবাস।

মুক্তিযুদ্ধের সময় নেপথ্যে থেকে সহায়তা করেন মুক্তিযোদ্ধাদের। ৭১ সালের মার্চের মাঝামাঝিতে হাইকোর্টে আইনজীবীদের একটি মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলো বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন দেওয়ার। তখন তিনিও চাইছিলেন কিছু একটা করার। প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিলস্নুর রহমানসহ আইনজীবীদের নিয়ে জেলা কোর্টে একটি সমাবেশের আয়োজন করেন। ওই সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বক্তব্য দেন তরুণ আইনজীবী মাহবুব হোসেন। পরদিন অবজারভার পত্রিকার প্রথম পাতায় তার ছবি প্রকাশিত হয়। ওই ছবি নিয়ে গোয়েন্দারা তলস্নাশি শুরু করেন। তখন ওয়ারীর হেয়ার স্ট্রিট রোডের একটি বাড়িতে ভাড়া থাকতেন। ওই বাসায় থাকতেন প্রয়াত জিলস্নুর রহমান ও আইভি রহমান।

একাত্তরের ২৫ মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর ওই বাসা থেকে তাদের নিরাপদ অবস্থানে নিয়ে যান তিনি। শুরু হয় স্বাধীনতার যুদ্ধ। তখন মুক্তিযোদ্ধারা তার ওই বাসাকে অস্ত্রাগার হিসেবে ব্যবহার করতেন। আলমারিতে রাখা মোটা আইনি বইয়ের পেছনে লুকিয়ে রাখতেন গ্রেনেড। একদিন গ্রেনেড বহনকারী এক মুক্তিযোদ্ধা এসে বললেন, তাকে কবি জসীমউদ্‌দীনের কমলাপুরের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার জন্য। ওই বাড়িটি মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। নিজের ট্রাম্প গাড়িতে করে রওনা দেয়ামাত্রই পাক সেনারা তাদের গতিরোধ করে। পাক সেনাদের বোকা বানিয়ে ওই মুক্তিযোদ্ধাকে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেন তিনি।

রাজনীতি ও কর্মজীবন

ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতিতে জড়িত মাহবুব হোসেন ১৯৬২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ল' অ্যাসোসিয়েশনের ভিপি নির্বাচিত হন। তখন সামরিক শাসক আইয়ুব খানের জারি করা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মিছিল করেন। ১০-১২ জন সহপাঠীর সঙ্গে ফের গ্রেপ্তার হন তিনি। তাদের বিচার শুরু হয় সামরিক আদালতে। নিজেই বিচারের মোকাবিলা করেন সাহসী তরুণ মাহবুব হোসেন। বিচারককে ছুড়ে দেন আইনি চ্যালেঞ্জ। ঘাবড়ে যান বিচারক। উর্দু ভালো বলতে পারার কারণে কিছুটা আনুকূল্যও পান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের পরিচয় পেয়ে তাকে খালাস দেন বিচারক। তবে ছাত্রনেতা হওয়ার কারণে আইয়ুব খান তাকে এমএ পরীক্ষায় অংশ নিতে দেননি। তাই ১৯৬৪ সালে ল' পাস করে আইন পেশা শুরু করেন। তখন থেকেই রাজনীতিবিদ ও ছাত্রনেতাদের মামলা পরিচালনা করেন তিনি।

১৯৬৬ সালে হাইকোর্টের আইনজীবী হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধকালীন অপরাধের বিচারের জন্য গঠিত আদালতের চিফ প্রসিকিউটর নিয়োগ দেয়া হয় খন্দকার মাহবুব হোসেনকে। তরুণ বয়সে এত বড় দায়িত্ব পেয়ে ভড়কে যান তিনি। ছুটে যান তৎকালীন আইনমন্ত্রী ড. কামাল হোসেনের কাছে। কামাল হোসেন তাকে জানান, এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না, আপনি বঙ্গবন্ধুর কাছে যান। বঙ্গবন্ধু তাকে পিঠ চাপড়ে অভয় দেন। এরপর থেকে সবুর খান, শাহ আজিজুর রহমান, ফজলুল কাদের চৌধুরীসহ প্রভাবশালী সব রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে মামলা পরিচালনা করেন। ৫৫ বছরের আইন পেশায় দেশের প্রথম সারির সব রাজনীতিবিদের মামলা পরিচালনা করেছেন তিনি।

ছাত্রজীবনে রাজনীতি করলেও জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না তিনি। মূলত পেশাজীবনেই বেশি ব্যস্ত ছিলেন। তবে আইনজীবী হিসেবে সারা জীবন কাটালেও পড়ন্ত বেলায় জাতীয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ২০০৮ সালে যোগ দেন বিএনপিতে। বর্তমানে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ছিলেন। ২০১৬ সালে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটিতে ভাইস চেয়ারম্যান পদ পান।

২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বরগুনা-২ আসন থেকে তিনি ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর কাছে পরাজিত হন। ওই আসন থেকে আগেও অন্য দল থেকে একাধিক বার তিনি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

উলেস্নখযোগ্য মামলা

আইনজীবী হিসেবে তিনি অসংখ্য যুগান্তকারী মামলা পরিচালনা করেছেন। তার মধ্যে, যাবজ্জীবন কারাদন্ড সম্পর্কিত মামলা (আতাউর মৃধা বনাম রাষ্ট্র, ৭৩ ডিএলআর (এডি) ২৯৮), শাজনীন হত্যা মামলা (সৈয়দ সাজ্জাদ মাইনুদ্দিন হাসান বনাম রাষ্ট্র, ৭০ ডিএলআর (এডি) ৭০), চাপা হত্যা মামলা (রাষ্ট্র বনাম খন্দকার জিলস্নুর বারী, ৭০ ডিএলআর (এডি) ৭০) সালেহা খুকি হত্যা মামলা (এহতেশামুদ্দিন বনাম বাংলাদেশ, ৩৩ ডিএলআর (এডি) ১৫৪), আজম রেজা মামলা (রাষ্ট্র বনাম আজম রেজা, ৬২ ডিএলআর ৩৯৯), এরশাদ শিকদার বনাম রাষ্ট্র, ভিডিও ক্যাসেট মামলা (খালেদা আকতার বনাম রাষ্ট্র, ৩৭ ডিএলআর ২৭৫), অন্যতম।

সমাজসেবায় বহুমুখী অবদান ও সম্মাননা স্বীকৃতি

অন্ধ ও পঙ্গুদের জন্য ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত প্রশিক্ষণ কেন্দ্র (ভিটিসিবি)-এর ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি তিনি। শিশু সংগঠন কচিকাঁচার উপদেষ্টা এবং জসীমউদ্দীন পরিষদের সম্মানিত পৃষ্ঠপোষক। ওয়ার্ল্ড বস্নাইন্ড ইউনিয়ন, এশিয়ান বস্নাইন্ড ইউনিয়ন ও ঢাকা রোটারী ক্লাবের সদস্য। এসব কাজের স্বীকৃতিস্বরূপ নানা পুরস্কারেও ভূষিত হয়েছেন মেধাবী এ আইনজীবী। জসীমঊদ্‌দীন স্বর্ণপদক (২০০৬), কবি নজরুল স্বর্ণপদক (২০০৭), ড. মুহম্মদ শহীদুলস্নাহ স্বর্ণপদক (২০০৮) পান তিনি।

ব্যক্তিগত জীবন

ব্যক্তিগত জীবনে বিয়ে করেছেন অধ্যাপিকা ফারহাত হোসেনকে। দুই ছেলে ও এক কন্যাসন্তানের জনক তিনি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে