সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১

আইনের পরিধি, পুলিশের কাজ এবং আমাদের বিচার ব্যবস্থা

মামলার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নির্দিষ্ট কোনো জিনিস বিশেষ কোনো ব্যক্তির দখলে আছে বলে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গতভাবে যদি জানা যায়, তবেই সেই ক্ষেত্রে কেবল বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি চালানো যেতে পারে। অন্যথায় তল্লাশি পরোয়ানা ছাড়া তল্লাশি বেআইনি। তল্লাশিকালে প্রাপ্ত মালামাল তালিকাসহ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৫ ধারা অনুযায়ী যথা শিগগির সম্ভব তল্লাশিকারী পুলিশ কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রেরণ করবেন। উল্লেখ্য, কোনো গৃহের দখলদার দাগি, দুশ্চরিত্র কিংবা ফেরারি আসামি আছে, শুধু এই অজুহাতেই সেই গৃহ বিনা পরোয়ানায় তল্লাশি চালানো যাবে না
অ্যাডভোকেট সিরাজ প্রামাণিক
  ১৭ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে হোক কিংবা অন্য কোনো শত্রম্নতাবশত হোক কিংবা নিজেদের অপরাধের কারণেই হোক- মামলা-হামলা-গ্রেপ্তার আর তলস্নাশির যে ভয়াবহ হয়রানি ও জুলুমের শিকার হতে হয়, তা প্রচলিত আইনের বিধি-বিধানের সম্পূর্ণ পরিপন্'ী। পুলিশ কোনো নাগরিকের গৃহ তলস্নাশি করতে পারে দু'ভাবে। ১। আদালত হতে ইসু্যকৃত তলস্নাশি পরোয়ানা বলে, ২। কোনো মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা হিসেবে শুধু সেই মামলার আসামি গ্রেপ্তার বা মালামাল উদ্ধারকল্পে। এ বিষয়ে ফৌজদারি কার্যবিধির ধারা-৯৬, ৯৮, ৯৯ক, ১০০, ৪৭ ও ১৬৫; অস্ত্র আইন-২৫; জুয়া আইন-৫ এ স্পষ্টভাবে বলা আছে। তবে গৃহ তলস্নাশি শুরু করার আগেই ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৩ ধারা ও পিআরবি ২৮০ মোতাবেক পুলিশ কর্মকর্তা স্থানীয় দুই বা ততোধিক সম্মানিত ব্যক্তিকে সরেজমিন উপস্থিত থেকে তাতে সাক্ষী হওয়ার জন্য প্রয়োজনে লিখিতভাবে অনুরোধ করবেন। তলস্নাশিকালে গৃহকর্তা অথবা তার মনোনীত কোনো প্রতিনিধিকে অবশ্যই সঙ্গে রাখতে হবে। তলস্নাশিতে কাঙ্ক্ষিত কোনো মালামাল পাওয়া গেলে পুলিশ কর্মকর্তা তার একটি তালিকা প্রস্তুত করবেন। অতঃপর সেই তালিকায় উপস্থিত সাক্ষীদের স্বাক্ষর গ্রহণ করবেন। এরপর সেই তালিকার একটি অনুলিপি চাহিদা মোতাবেক গৃহকর্তা বা তার প্রতিনিধিকে এবং সাক্ষীদের প্রদান করবেন। তলস্নাশিকালে যদি কোনো মালামাল পাওয়া না যায়, তাহলে জব্দকৃত কোনো মালামাল নেই মর্মে জব্দ তালিকা প্রস্তুত করে উপরোলিস্নখিত একই পদ্ধতিতে সংশ্লিষ্টদের তার অনুলিপি প্রদান করতে হবে। শুধু তাই নয়, থানায় এসে পিআরবি'র ৩৭৭ বিধি অনুযায়ী জব্দ তালিকার বিষয়টি জিডিতে উলেস্নখ করতে হবে। ওই জব্দকৃত মালামাল পিআরবি'র ৩৭৯ বিধি অনুযায়ী থানার সম্পত্তি রেজিষ্টারে লিপিবদ্ধ করতে হবে। জব্দ তালিকা বা সিজার লিস্ট হচ্ছে- কোনো মামলার সঙ্গে সম্পৃক্ত এমন বস্তু বা আলামত, বেওয়ারিশ সম্পত্তি, চোরাইমাল, আগ্নেয়াস্ত্র এবং সন্দেহজনক কোনো বস্তু বা জিনিস উদ্ধার করা। জব্দ তালিকা একটি মামলার প্রাণ। সাক্ষ্য আইনের ৯ ধারা অনুযায়ী আদালতের ব্যাখ্যা বা উপস্থাপনামূলক হিসেবে জব্দ তালিকা প্রাসঙ্গিক বা গ্রহণযোগ্য। সাক্ষ্য আইন ৩৫ ধারা বলছে, সরকারি কর্মচারীর কর্তব্য সম্পাদনকালে সরকারি দলিল (বিপি নং৪৪) লিপিবদ্ধ হিসেবে জব্দ তালিকা আদালতে গ্রহণযোগ্য। সাক্ষ্য আইন ৮০ ধারা বলছে, একটি বিশুদ্ধ দলিল হিসেবে গণ্য হবে জব্দ তালিকাকে। এ প্রসঙ্গে মহামান্য হাইকোর্টের ৪৫ ডিএলআর ২৯৭ পৃষ্ঠার সিদ্ধান্ত হচ্ছে, সাক্ষীদের উপস্থিতিতে তলস্নাশি চালানোর বিধান করার লক্ষ্য হচ্ছে তদন্তকারী কর্মকর্তার পক্ষে সম্ভাব্য চাতুরী ও মনগড়া কিছু করার বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ তৈরি করা। তলস্নাশি যে সততার সঙ্গে হয়েছে তা নিশ্চিত করা তার জন্য বাধ্যতামূলক। ভুক্তভোগীরা প্রায়ই অভিযোগ করে থাকেন, তাদের হয়রানি করার উদ্দেশ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেরাই অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক পদার্থ বা মাদকদ্রব্য তাদের দখলে রেখে অতঃপর সেই দখল রাখার অপরাধ দেখিয়ে তাদের ফাঁসিয়ে দেয়। এমন অভিযোগের সত্য-মিথ্যা তদন্ত সাপেক্ষ হলেও বাস্তবতার সঙ্গে অনেক ঘটনার মিল রয়েছে। সে কারণেই পুলিশ বিভাগের বাইবেল বলে খ্যাত পি আর বি'র ২৮০ রেগুলেশনের বিধান অনুসারে কোনো স্থান তলস্নাশি করার জন্য প্রবেশের পূর্বে অবশ্যই পুলিশ অফিসার নিজের কাছে কিছু নেই তা উপস্থিত সাক্ষী কর্তৃক প্রবেশের পূর্বেই সার্চ করাতে হবে। নতুবা নিজেদের বহন করা মালামাল দিয়ে যে কাউকে ফাসিয়ে দিতে পারেন। এখানে সম্মানিত ব্যক্তি বলতে উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে বোঝাবে, যিনি নিরপেক্ষ হবেন এবং যাকে তলস্নাশি স্থানের মালিক বা প্রতিনিধি বিশ্বাস করতে পারেন। এ ধারার বিধানগুলো যথাযথভাবে অনুসরণ ব্যতিরেকে কোনো গৃহ তলস্নাশি করা বা কোনো সন্দেহভাজন মালামাল জব্দ করা অবৈধ বা বেআইনি কর্ম বলে গণ্য হবে উচ্চ আদালত সিদ্ধান্ত দিয়েছেন। মামলার তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নির্দিষ্ট কোনো জিনিস বিশেষ কোনো ব্যক্তির দখলে আছে বলে যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গতভাবে যদি জানা যায়, তবেই সেই ক্ষেত্রে কেবল বিনা পরোয়ানায় তলস্নাশি চালানো যেতে পারে। অন্যথায় তলস্নাশি পরোয়ানা ছাড়া তলস্নাশি বেআইনি। তলস্নাশিকালে প্রাপ্ত মালামাল তালিকাসহ ফৌজদারি কার্যবিধির ১৬৫ ধারা অনুযায়ী যথা শিগগির সম্ভব তলস্নাশিকারী পুলিশ কর্মকর্তা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে প্রেরণ করবেন। উলেস্নখ্য, কোনো গৃহের দখলদার দাগি, দুশ্চরিত্র কিংবা ফেরারি আসামি আছে, শুধু এই অজুহাতেই সেই গৃহ বিনা পরোয়ানায় তলস্নাশি চালানো যাবে না। মহামান্য হাইকোর্ট ৬০ ডিএলআর ৩৪ পাতার সিদ্ধান্তে বলেছেন, ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৩ ধারার বিধান যথাযথভাবে প্রতিপালন না করে অপরাধমূলক দ্রব্যাদি তলস্নাশি করা এবং জব্দ করা বৈধ হতে পারে না। সুতরাং, সংশ্লিষ্ট কোনো পুলিশ কর্মকর্তা যদি এই বিধানের ব্যত্যয় করেন, তবে তা আইনবহির্ভূত বা বেআইনি কাজ বলে গণ্য হবে। সেই বেআইনি কাজটির জন্য তার দু'ধরনের শাস্তি হতে পারে, ১। কোনো অসৎ উদ্দেশ্য ব্যতিরেকে, শুধু গাফিলতির কারণে যদি বিধানের ব্যত্যয় হয়- তবে তাতে তার হতে পারে প্রশাসনিক শাস্তি। যেমন- পদাবনতি, চাকরিচু্যতি ইত্যাদি, ২। তা যদি হয় এমন কাজ- অপরাধ করার উদ্দেশ্যে পূর্ব পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি ইত্যাদি সম্পন্ন করার উদ্দেশ্যে সংঘটিত, তাহলে তা শাস্তিযোগ্য হবে অন্য সব সাধারণ অপরাধীর মতোই। তবে অনেকের অভিমত হচ্ছে- অন্যদের চেয়ে পুলিশের শাস্তির মাত্রা বরং বেশি হওয়া উচিত। কেননা, তাদের দায়িত্বই হলো অপরাধ নিবারণ আর এজন্য রাষ্ট্র ও আইন তাদের দিয়েছে বিশেষ ক্ষমতা ও মর্যাদা। সুতরাং, ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করে অসহায় নাগরিকদের জীবনকে বিপন্ন করার দায় পুলিশের জন্য তুলনামূলকভাবে অন্য অপরাধীদের চেয়ে অনেক বেশি। পৃথিবীর অনেক সভ্য দেশের আইনে এ ধরনের নজিরও আছে এবং এমন বেআইনি কর্মের জন্য তাদের সম্ভাব্য যেসব শাস্তি হতে পারে, তার উলেস্নখ আছে দন্ডবিধিতে। যেমন দন্ডবিধির ১৬৬, ৪২৭, ৩৯২/৩৯৫ এবং নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ধারা ১০-এ। ক্ষেত্রভেদে এসব শাস্তির পরিমাণ হতে পারে ২ থেকে ১০ বছরের সশ্রম কারাদন্ড। কোনো নাগরিক যদি এসব অপরাধ-অনাচার হতে কোনো বৈধ বা সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে থেকে কোনো আশ্রয় না পান, তাহলে এমন বেআইনি ও অপরাধমূলক অপতৎপরতা থেকে বাঁচার লক্ষ্যে দন্ডবিধি-১০৪ ধারা মোতাবেক আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করতে পারবেন। যে ধারায় বলা হয়েছে- সম্পত্তির বিরুদ্ধে সংঘটিত বা প্রচেষ্টারত অপরাধ যদি সাধারণ চুরি, ক্ষতি বা গৃহে অনধিকার প্রবেশ সম্পর্কিত হয়; সে ক্ষেত্রে সম্পত্তি সংক্রান্ত আত্মরক্ষার ব্যক্তিগত অধিকার প্রয়োগ করতে গিয়ে অপরাধকারীর মৃতু্য ঘটানো ব্যতিরেকে যে কোনো ধরনের শক্তি প্রয়োগ করা যাবে। লেখক: আইনের শিক্ষক, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ও আইনগ্রন্থ প্রণেতা। ইমেইল: ংবৎধল.ঢ়ৎধসধহরশ@মসধরষ.পড়স

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে