শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রীর অভিযোগ

আইনি লড়াইয়ে মিথ্যা মামলা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার গল্প
অ্যাডভোকেট এস এম তাসমিরুল ইসলাম উদয়
  ২৩ মে ২০২৩, ০০:০০

স্বামীর বিরুদ্ধে স্ত্রী নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১১(খ) ধারায় মামলা দায়ের করেছে। মামলায় অভিযোগ; যৌতুকের দাবিতে স্বামী ও শাশুড়ি যোগসাজশ করে বাদিনীকে রক্তাক্ত গুরুতর জখম করেছে- যার ফলশ্রম্নতিতে নয় মাসের অন্তঃসত্ত্বা বাদিনীর গর্ভের সন্তান মিসক্যারেজ হয়ে বাদিনী মৃত সন্তান প্রসব করেছে। অভিযোগ গুরুতর।

এই মামলায় আমরা অভিযুক্তের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে অংশ নেই। মামলার শেষ দৃশ্যে আসতে আসতে এই মামলার সঙ্গে জড়িত দুজন পুলিশ কর্মকর্তা চাকরিচু্যত হয় এবং একাধিক পুলিশ সদস্য অর্থদন্ডসহ বিভিন্ন ছোট বড় শাস্তির মুখোমুখি হয়?

মামলার এজাহার দায়ের করা হয়; ০৩/১১/২০২১। এজাহারে যৌতুকের দাবিতে গুরুতর আঘাতের ঘটনার তারিখ দেখানো হয় ১৪/০৯/২০২১, সময়: রাত ১০:৩০ ঘটিকায়। এজাহার মতে বাদিনী স্থানীয় একটি বেসরকারি মেডিকেলে মৃত বাচ্চাটি প্রসব করেন ১৬/০৯/২০২১ তারিখে। কিন্তু মেডিকেল স্স্নিপ হিসেবে দাখিল করা হলো সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগের একটি কাগজ, যা ইসু্য করা হয় ১৫/০৯/২০২১ ইং তারিখে কিন্তু ওই স্স্নিপে নেই পুলিশ কেস সংক্রান্ত কোনো সিল।

অনুসন্ধানে দেখা গেল যে, ডাক্তার বাদিনীকে প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান করেন তিনি অর্থোপেডিকের ডাক্তার কিন্তু অভিযুক্তের বিরুদ্ধে তো অভিযোগ প্রসূতি সংক্রান্ত!

মামলা দায়েরে বিলম্ব এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত কাগজপত্র প্রাথমিক অনুসন্ধান করতে গিয়ে ধরা পড়লো চাঞ্চল্যকর ঘটনা, মামলার এজাহারের কপিটাই রিপেস্নস করে ফেলেছে পুলিশ!

প্রথম এজাহারটিতে ঘটনা উলেস্নখ করা হয়েছে; সকাল ৮:৩০ ঘটিকা। ঘটানাটিকে রীতিমতো ভয়াবহ স্ক্যাম বলা যায়। দুটো এজাহারকে একাট্টা করে বিজ্ঞ চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর বিষয়টি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি ডিসি প্রসিকিউশনকে তদন্তের নির্দেশ প্রদান করেন। এরই মধ্যে আমাদের মোয়াক্কেলের বিরুদ্ধে তদন্তকারী কর্মকর্তা (বর্তমানে চাকরিচু্যত) চার্জশিট দাখিল করেন।

এবার আমরা চলে যাই আরও গভীরে। খুলতে থাকে রহস্যের জট। বেসরকারি হাসপাতালে মৃত সন্তান ডেলিভারি, কিন্তু সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের স্স্নিপ সংক্রান্ত ইসু্যতে আমাদের সামনে উপস্থাপন করা হলো ওই বেসরকারি মেডিকেলের একটি রেফারেল স্স্নিপ- যেখানে আঁকাবাঁকা হাতের লেখায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে রেফারের ব্যাপারে বলা হচ্ছে। রেফারেল স্স্নিপের অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা গেল এটি ওই হাসপাতাল থেকে সরবরাহকৃত কোনো রেফারেল স্স্নিপ নয় বরং এটি একটি মেডিসিন স্স্নিপ- যা বাদিনী যোগসাজশের মাধ্যমে ফাঁকা সংগ্রহ করেছে। কিন্তু চোর আর্টিস্ট না হলে যা হয়!

মেডিসিন স্স্নিপকে রেফারেল স্স্নিপ বলে চালিয়ে দেয়া ওই স্স্নিপে তারিখ লেখা আছে ০১/১১/২০২১। এদিকে বেসরকারি হাসপাতালের মৃত বাচ্চা প্রসবের কারণ হিসেবে মেডিকেল রিপোর্টে বলা হলো; গর্ভস্থ শিশুর গলায় ও বুকে মায়ের নাড়ির তিনটি আটসাট গিঁট পড়ায় শিশুটির শ্বাসপ্রশ্বাস প্রক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃতু্যবরণ করে। কিন্তু মায়ের কিংবা শিশুর শরীরের কোথাও কোনো আঘাতের বিষয়ে অথবা আঘাতের ফলে শিশুর মৃতু্য হয়েছে এমন কোনো মন্তব্য চিকিৎসক করেননি। মেডিকেল সায়েন্সে এটি একটি প্রায় নিয়মিত দুর্ঘটনা বলে জানতে পারি।

প্রকৃত বিষয় হলো; ১৪/০৯/২১ ইং তারিখ রাতে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সন্তানের ডেলিভারি কোন হাসপাতালে হবে সেই বিষয়ে কথাকাটাকাটি হয়। স্ত্রী তার স্বামীকে সায়েস্তা করার লক্ষ্যে ১৫/০৯/২১ তারিখে নিজের শরীরে নিজে আঘাত করে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলে গিয়ে বহির্বিভাগে যে চিকিৎসককে পায় তার থেকেই একটি মেডিকেল স্স্নিপ সংগ্রহ করে নিয়ে আসে। কিন্তু দুপুর থেকে বাদিনী নিজের গর্ভের সন্তানের কোনো নড়াচড়া টের না পেয়ে ১৫/০৯/২১ তারিখ সন্ধ্যায় ওই বেসরকারি হাসপাতালে তার নিয়মিত চিকিৎসককে ঘটনাটি জানালে চিকিৎসক আল্ট্রাসনোগ্রাম করে জানতে পারে গর্ভের সন্তানটি বাদিনীর নাড়ির সঙ্গে পেঁচিয়ে ইতোমধ্যে মৃতু্যবরণ করেছে। বাদিনী তখনই ওই মেডিকেলে ভর্তি হয় এবং ১৬/০৯/২১ তারিখে বাদিনীর স্বামী অর্থাৎ আমাদের মোয়াক্কেল এবং বাদিনীর মাতার যৌথ সম্মতি স্বাক্ষরে বাদিনীর অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে সন্তান ডেলিভারি সংক্রান্ত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। আমাদের সামনে সেই সম্মতিপত্রের কপিটিও চলে আসে।

এবার এজাহার দায়েরে বিলম্বসহ যাবতীয় হিসেব একটু একটু করে মিলতে শুরু করল; এজাহারের ঘটনা দেখানো হলো; ১৪/০৯/২১, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে চিকিৎসা নেয়া হলো ১৫/০৯/২১, বাদিনী বেসরকারি হাসপাতালে মৃত বাচ্চা প্রসব করল ১৬/০৯/২১, কিন্তু বেসরকারি হাসপাতাল থেকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে রেফার করা হলো ০১/১১/২১। অর্থাৎ আহত হওয়ার দেড় মাসাধিক কাল পরে ভিক্টিম বাদিনীকে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে রেফার করা হলো কিন্তু হাসপাতাল মেডিকেল স্স্নিপ ইসু্য করল দেড় মাস আগের তারিখের!

আদালত এবার মামলার তদন্ত ভার দিল পিবিআইকে। ইতোমধ্যে মামলার এজাহার রিপেস্নস করার বিষয়টি ডিসি প্রসিকিউশন কর্তৃক তদন্তে সত্যতা পাওয়া গেল।

অভিযুক্ত ওসি (তদন্ত), এসআই (আইও), জিআরওসহ সংশ্লিষ্ট কতিপয় পুলিশ কর্মকর্তা আমাদের সিনিয়রের নিকট ধর্ণা দিলেন। বিষয়টি আপস রফার জন্য অভিযুক্তদের পক্ষ থেকে সিনিয়রকে অফার করা হলো মোটা অঙ্কের অর্থ। কিন্তু সিনিয়র এতেও অটল। বিষয়টা যে ন্যায়বিচারের। একপর্যায়ে ভীতি প্রদর্শনের চেষ্টা করা হলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হলো। অভিযুক্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিভাগীয় বিচার ও চাকরিচু্যতির বিষয়টি আরও তরান্বিত হলো। এর মধ্যে বাদিনী একই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামান্য ঘুরিয়ে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের পেনাল কোডের ৩১৩/১০৯ (বিনা অনুমতিতে নারীর সন্তানের মিসক্যারেজ) ধারায় আরেকটি মামলা দাখিল করল। পিবিআই তদন্তে মামলাটির ঘটনা অসত্য বলে পুলিশ প্রতিবেদনে এলো। মামলাটি খারিজ হলো। কারণ এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ইতোমধ্যে পুলিশ প্রশাসনের ভেতরে অনেক বড় ঘটনা ঘটে গেছে।

এতো চাঞ্চল্যকর ঘটনার পরেও পিবিআই আমাদের মোয়াক্কেলের বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশিট দিলেন কিন্তু ১১(গ) ধারায়! অর্থাৎ গুরুতর জখম হয়নি কিন্তু সোহরাওয়ার্দী মেডিকেলের স্স্নিপ মতে সাধারণ আঘাতের ঘটনা ঘটেছে! যথারীতি মামলা নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইবু্যনালে বিচারের জন্য বদলি হলো।

এরপর চার্জ গঠন বিষয়ে সম্প্রতি লম্বা শুনানি হলো। ডিএলআর, বিএলসি, বিএলডি, এএলআরসহ ক্রিমিনাল প্রসিডিউর এবং নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের নানা দিকের ব্যাখ্যার ওপর সাঁড়াশি অভিযান চালাতে লাগলাম। এই মামলায় আমরা আমাদের সিনিয়রসহ আসামিপক্ষে অংশগ্রহণ করি।

তাছাড়া উভয়পক্ষেই একাধিক প্রথিতযশা সিনিয়র ট্রায়াল আইনজীবী অংশগ্রহণ করলেন। অবশেষে আমাদের মোয়াক্কেলকে বিজ্ঞ আদালত ডিসচার্জ ঘোষণা করলেন!

আমরা চাপমুক্ত অনুভব করলাম। আইনের যথাযথ প্রয়োগ ও অনুসন্ধানী মনের যুগপৎ প্রচেষ্টায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আমরা মিথ্যাকে পরাজিত করলাম, আপাতত এটাই পরম প্রাপ্তি।

এস এম তাসমিরুল ইসলাম উদয়

আইনজীবী, ঢাকা জজ কোর্ট।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে