সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

সন্তানকে ত্যাজ্য ঘোষণার আইনগত ভিত্তি আছে কি?

সাধারণত সন্তানরা বাবা-মায়ের অবাধ্য হলে বা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজের মতো করে কোনো কাজ করলে কিংবা কোনো কারণে বখে গেলে তাকে পরিবারের মতে চলার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। কিন্তুত্ম কোনো কিছুতেই যখন তাকে বশে আনা যায় না, তখন বাবা-মায়েরা ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে শাস্তিস্বরূপ তাদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দেন এবং অনেক সময় ত্যাজ্যপুত্র হিসেবে ঘোষণাও করেন। ত্যাজ্যপুত্র যদিও একটি প্রচলিত বিষয়, কিন্তু্তু এ বিষয়ে অস্বচ্ছ ধারণা রয়েছে। প্রচলিত ধারণা এই যে, যদি কোনো বাবা-মা তার সন্তানকে ত্যাজ্য হিসেবে ঘোষণা করেন, তবে ওই সন্তান চিরতরে তার বাবা-মায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে।
আইন ও বিচার ডেস্ক
  ০৮ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

ধনাঢ্য ঘরের একমাত্র সন্তান শাকিল (ছদ্মনাম) পরিবারের অমতে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন অপেক্ষাকৃত নিচু ঘরের সন্তান লিলিকে (ছদ্মনাম)। শাকিলের বাবার একান্ত ইচ্ছা ছিল, ধুমধাম করে ছেলের বিয়ে দেবেন তার দীর্ঘ দিনের এক বন্ধুর মেয়ের সঙ্গে। কিন্তু্তু শাকিল যখন সবার ইচ্ছার বিরুদ্ধে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে ফেলে, তখন তার বাবা এতে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হন এবং তাকে ত্যাজ্যপুত্র হিসেবে তার সব সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার ঘোষণা দেন।

আমাদের দেশে এ রকম ঘটনার কথা অহরহ শোনা যায়। সাধারণত সন্তানরা বাবা-মায়ের অবাধ্য হলে বা তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নিজের মতো করে কোনো কাজ করলে কিংবা কোনো কারণে বখে গেলে তাকে পরিবারের মতে চলার জন্য চাপ প্রয়োগ করা হয়। কিন্তুত্ম কোনো কিছুতেই যখন তাকে বশে আনা যায় না, তখন বাবা-মায়েরা ক্ষোভের বশবর্তী হয়ে শাস্তিস্বরূপ তাদের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার হুমকি দেন এবং অনেক সময় ত্যাজ্যপুত্র হিসেবে ঘোষণাও করেন।

ত্যাজ্যপুত্র যদিও একটি প্রচলিত বিষয়, কিন্তু্তু এ বিষয়ে অস্বচ্ছ ধারণা রয়েছে। প্রচলিত ধারণা এই যে, যদি কোনো বাবা-মা তার সন্তানকে ত্যাজ্য হিসেবে ঘোষণা করেন, তবে ওই সন্তান চিরতরে তার বাবা-মায়ের সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। অনেক সময় দেখা যায়, পিতা তার সন্তানকে ত্যাজ্য হিসেবে ঘোষণা করেন এবং হলফনামার মাধ্যমে স্বীকৃতি দেন যে, তার মৃতু্যর পর ওই সন্তান সম্পত্তির কোনো অংশীদার হবে না। এ ধরনের ঘোষণার আদৌ কোনো আইনি ভিত্তি আছে কিনা, তা অনেকের কাছেই অজানা। এই অজ্ঞতার কারণেই সমাজে বিষয়টি সম্পর্কে নানা ধরনের অঘটন ঘটছে।

কিন্তু প্রকৃত বিষয় হলো, ত্যাজ্যপুত্র সম্পর্কে মুসলিম আইনে কোনো বিধান নেই এবং এটি একটি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা।

মুসলিম পারিবারিক আইনে উত্তরাধিকার সম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে বলে দেয়া হয়েছে- কারা সম্পত্তির উত্তরাধিকার হবে এবং তাদের অংশ কতটুকু হবে। মুসলিম আইন অনুযায়ী, জন্মসূত্রেই কোনো সন্তান তার পরিবারের সম্পত্তিতে উত্তরাধিকার অর্জন করে এবং তাদের এই অধিকার কোনোভাবেই খর্বযোগ্য নয়।

আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি নানাভাবেই সম্পত্তি হস্তান্তর করতে পারেন। যেমন দান, উইল, বিক্রি ইত্যাদি। তবে মুসলিম আইনে উইলের দ্বারা এবং ওই ব্যক্তির মৃতু্যর পর তা কার্যকর হবে। উইলের ক্ষেত্রে কোনোভাবেই এক-তৃতীয়াংশের বেশি সম্পত্তি দেয়া যাবে না। জীবনকালে যদি কোনো সম্পত্তি হস্তান্তর করা হয় দান বা বিক্রির মাধ্যমে, তবে ওই সম্পত্তিতে ওই ব্যক্তির মালিকানার বিলুপ্তি ঘটে এবং তার মৃতু্যর পর হস্তান্তর করা সম্পত্তি বাদে রেখে যাওয়া বাকি সম্পত্তিতে ওই ব্যক্তির উত্তরাধিকারীদের মালিকানা সৃষ্টি হয় এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত অংশ অনুযায়ী তাদের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টিত হবে।

কিন্তু মুসলিম আইনে এমন কোনো বিধান রাখা হয়নি, যার দ্বারা ঘোষণার মাধ্যমে বাবা-মা তাদের সম্পত্তি থেকে সন্তানকে বঞ্চিত করতে পারেন। যেহেতু সুস্পষ্টভাবে অংশ নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে, তাই সম্পত্তি কীভাবে এবং কাদের মধ্যে বণ্টিত হবে, সে বিষয়ে মতামত দেয়ার কোনো অবকাশ নেই।

উত্তরাধিকার আইনে যে কয়জন অংশীদারকে কোনো অবস্থায় সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করা যায় না, তাদের মধ্যে ছেলে ও মেয়ে রয়েছে। তবে কেউ যদি রেজিস্ট্রিকৃতভাবে পুরো সম্পত্তি দান বা হস্তান্তর করে যায় এবং সন্তানকে বঞ্চিত করার লক্ষ্যে তার কোনো অংশের কথা উলেস্নখ না করে যায়, তবে ওই সম্পত্তিতে তার সন্তানদের কোনো অংশ থাকবে না। অনেকে দলিল সম্পাদন কিংবা হলফনামার মাধ্যমে ত্যাজ্য করার ঘোষণা দেন। কিন্তু্তু যেভাবেই করা হোক, এ ধরনের ইচ্ছা বা আদেশের কোনো মূল্য নেই। কেননা, মুসলিম আইনে এ ধরনের দলিল বা হলফনামা সম্পাদনের কোনো ধারাই রাখা হয়নি।

সাধারণত দেখা যায়, বাবা যদি কোনো সন্তানকে ত্যাজ্য করেন তবে তার মৃতু্যর পর অন্যান্য উত্তরাধিকারী সেই সন্তানকে সম্পত্তির অংশ দিতে চান না। সমাজপতিরাও আইন সম্পর্কে অজ্ঞ হওয়ার কারণে এ বিষয়ে ভুল সিদ্ধান্ত দেন এবং কোনো সুরাহা করতে পারেন না। তাই কেউ যদি এমন অবস্থার শিকার হন এবং ব্যক্তিগতভাবে বিষয়টির নিষ্পত্তি করতে না পারেন, তবে তিনি আদালতের আশ্রয় নিতে পারেন। ত্যাজ্যপুত্র একটি ভুল ও ভ্রান্ত বিষয় এবং এটি কোনোভাবেই আইনে স্বীকৃত নয়। মুসলিম আইন উত্তরাধিকার স্বত্বের অধিকারকে চিরন্তন সত্য হিসেবেই স্বীকৃতি দিয়েছে।

আমরা একটা বিষয় সচরাচর দেখতে পাই যে, কোনো সন্তান পিতার আদেশ না মানলে বা অবাধ্য হলে বা কোন রকম ঝগড়া-বিবাদ হলে পিতা তার সন্তান কে ত্যাজ্য ঘোষণা করে। সাধারণত এসব ঘোষণা মৌখিকভাবে হলেও অনেকেই স্ট্যাম্পে লিখে বা নোটারি করে সন্তানকে ত্যাজ্য ঘোষণা করে। সে পরিস্থিতিতে যখন পিতা বা মাতা মৃতু্যবরণ করেন, তখন তার কাছের কিছু আত্মীয় ও এলাকার স্বার্থান্বেষী মহল এমনই একটা পরিস্থিতির সৃষ্টি করে যে, যাতে করে সেই ত্যাজ্য সন্তান কোনো প্রকার সম্পদ পেতে না পারে। অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির সম্পত্তি মূল মালিকের কাছে না পৌঁছিয়ে যেন হরি লুট করে খাওয়া যায়। এটা সম্পূর্ণ বেআইনি, নীতি বহির্ভূত ও গর্হিত কাজ। কারণ, পিতামাতা ও সন্তানের সম্পর্কটা কোনো চুক্তি নয় বা বিবাহ, তলাক বা দাস মুক্তির মতো নয় যে, যেকোনো সময় ভেঙে ফেলা যাবে।

রক্তের সম্পর্ক কখনো মুখের কথায় পরিবর্তন বা পরিবর্ধন হয় না। এটা নিতান্তই স্থায়ী বিষয়। তবে একটা বিষয় সর্বদাই গ্রহণযোগ্য, তা হলো কেউ যদি ইচ্ছা করে, তাহলে তার মোট সম্পদ থেকে এক তৃতীয়াংশ যে কোনো সময় যে কোনো ব্যক্তিকে দান করতে পারবে। এ ব্যাপারে তাকে কেউ বাধা দিতে পারবে না; কিন্তুত্ম সেটি নিজের সন্তানদের ত্যাজ্য করে নয়। তাই এই ধরনের ত্যাজ্য যদি কেউ করে, তাহলে সেই ত্যাজ্যের বিষয় ধর্মীয় বা রাষ্ট্রীয় কোনো নিয়মেই গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ এই ধরনে নীতিমালা না ইসলামে আছে, না রাষ্ট্রীয় কাঠামোর কোথাও লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তুত্ম ত্যাজ্যপুত্র বা কন্যা বলতে কোনো আইনগত বিধান না থাকলেও, পিতা মাতা ইচ্ছা করলে তার সমস্ত সম্পত্তি সাব-কবলা রেজিঃ বা দান ইত্যাদি করে, অপর সন্তানকে বঞ্চিত করতে পারেন। তবে সাব-কবলা বা দান লিখিত ও রেজিস্ট্রিকৃত না হলে ত্যাজ্যপুত্র বা ত্যাজ্য কন্যা বললেই বা ঘোষণা করলেই সম্পত্তি হতে বঞ্চিত হবে না বা সম্পর্ক ছিন্ন হবে না।

মুসলিম আইনানুসারে, কাউকে ত্যাজ্যপুত্র করা বা মৃতু্যর সময় অসিয়তের মাধ্যমে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হারাম এবং অবৈধ। শরিয়তের দৃষ্টিতে এটি গ্রহযোগ্য নয়। কাজেই যাকে ত্যাজ্যপুত্র ঘোষণা করা হয় কিংবা যাকে তার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করার অসিয়ত করা হয়- সে কোনোভাবেই তার উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হবে না, বরং সে তার নির্ধারিত অংশ পাবে।

রাসূলুলস্নাহ (সা.) বলেছেন, 'যে তার উত্তরাধিকারীকে উত্তরাধিকার (মিরাস) থেকে বঞ্চিত করবে, কিয়ামতের দিন আলস্নাহ্‌ তাকে তার জান্নাতের উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করবেন। (ইবনে মাজাহ)

অন্যদিকে, হিন্দু আইনেও ত্যাজ্যপুত্র করবার কোনো বিধান নেই। হিন্দু আইনে 'ত্যাজ্য' করে কোনো ব্যক্তি তার উত্তরাধিকারীদের সম্পত্তির দাবি থেকে বঞ্চিত করতে পারে না।

অতএব, আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, ত্যাজ্যপুত্র বলে কোনো বিধান আইনে নেই। তাই কেউ তার সন্তানকে ত্যাজ্য করলেও সে তার উত্তরাধীকার থেকে বঞ্ছিত হবে না।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে