রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১
নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃতু্য (নিবারণ) আইন ২০১৩

অভিযোগ গ্রহণের ক্ষমতা কি শুধু দায়রা আদালতের?

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃতু্য (নিবারণ) আইন-২০১৩ এর অধীনে কি ম্যাজিস্ট্রেট আদালত অভিযোগ গ্রহণ করতে পারবেন? নাকি এই ক্ষমতা শুধু দায়রা আদালতের? এই আইনের অধীনে আরও কিছু বিধানের প্রয়োগ নিয়ে আইনাঙ্গনে রয়েছে বিতর্ক। আলোচিত এই বিষয় নিয়ে দুই পর্বে লিখেছেন বিচারক চন্দন কান্তি নাথ। আজ ছাপা হলো শেষ পর্ব, আর সিপিসির ১৫ ধারায় আছে, প্রত্যেকটি মামলা উহা বিচার করার যোগ্যতাসম্পন্ন সর্বনিম্ন পর্যায়ের আদালতে দায়ের করতে হবে। তাই দুই আদালতে অভিযোগ করার সুযোগ নেই। কেননা, ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ২০১ ধারায় আছে, যদি এমন কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয় যিনি ঘটনাটি আমলে নিতে উপযুক্ত নহেন তাহলে তিনি তা যথাযথ আদালতে দাখিল করার জন্য সেই মর্মে পৃষ্ঠাঙ্কন করে অভিযোগটি ফেরত দেবেন। অভিযোগটি যদি লিখিতভাবে করা না হয়, তাহলে ওই ম্যাজিস্ট্রেট ফরিয়াদিকে উপযুক্ত আদালতে প্রেরণ করবেন।
চন্দন কান্তি নাথ: বিচারক, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনাল (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ), বরিশাল
  ২৯ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃতু্য (নিবারণ) আইন-২০১৩ এর ৬ ধারা মতে এই আইনে তৃতীয় পক্ষ দ্বারা অভিযোগও করা যায়। কোনো ব্যক্তিকে অন্য কোনো ব্যক্তি নির্যাতন করেছে বা করছে এইরূপ কোনো তথ্য তৃতীয় কোনো ব্যক্তি এই আইনের এখতিয়ারধীন আদালতকে অবহিত করলে আদালত অভিযোগকারীর বিবৃতির ওপর নিজের মন্তব্য লিপিবদ্ধ করে ওই ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধান করবেন। যদি অভিযোগকারীর বক্তব্যে এই আইনের এখতিয়ারধীন কোনো আদালত এই মর্মে সন্তোষ্ট হন যে, ঘটনাস্থলে পরিদর্শন করা প্রয়োজন তা হলে আদালত ওই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করতে পারবেন।

৭ ধারামতে ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া সত্ত্বে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি এই আইনের এখতিয়ারধীন কোনো আদালত তথা দায়রা জজ আদালতে অথবা পুলিশ সুপারের নিচে নয় এমন কোনো পুলিশ কর্মকর্তার কাছে নির্যাতনের অভিযোগ দাখিল করতে পারবেন। দায়রা জজ আদালতে অভিযোগ করা হলে উপরোক্ত উপায়ে জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করে পরবর্তী কাজ আগাবেন।

কিন্তু কোনো অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ সুপার অথবা তার চেয়ে ঊধ্বর্তন পদমর্যাদার কোনো অফিসার তাৎক্ষণিক একটি মামলা দায়ের ও অভিযোগকারীর বক্তব্য রেকর্ড করবেন এবং মামলার নম্বরসহ এই অভিযোগের ব্যাপারে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে তা অভিযোগকারীকে অবহিত করবেন। অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণকারী পুলিশ সুপার অথবা তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অভিযোগ দায়েরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দায়রা জজ আদালতে একটি রিপোর্ট পেশ করবেন। আগেই বলা হয়েছে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি এই আইনের এখতিয়ারাধীন আদালতকে অবহিত করলে আদালত অভিযোগকারীর বিবৃতির ওপর নিজের মন্তব্য লিপিবদ্ধ করে ওই ব্যক্তির নিরাপত্তা বিধান করবেন।

তাছাড়াও ১১ ধারা মোতাবেক অভিযোগকারী কোনো ব্যক্তি এই আইনে অভিযুক্ত কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিরাপত্তা বিধানকল্পে দায়রা জজ আদালতে পিটিশন দায়ের করতে পারবে। রাষ্ট্র এবং যার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা চাওয়া হয়েছে তাদের ওই পিটিশনের পক্ষভুক্ত করা যাবে। পিটিশন গ্রহণ করে আদালত বিবাদীকে সাত দিনের নোটিশ জারি করবে এবং ১৪ দিনের মধ্যেই পিটিশনের ওপর একটি আদেশ প্রদান করবে।

আদালত প্রয়োজনবোধে ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে অনূ্যন সাত দিনের অন্তরীণ আদেশ দিতে পারবে এবং সময়ে সময়ে তা বৃদ্ধি করতে পারবে। আদালত এই আইনের অধীনে শাস্তিযোগ্য অপরাধের তদন্ত কর্মকর্তাদের আদালতের আদেশ পালন নিশ্চিত করবার নির্দেশ দিতে পারবেন। আদালত নিরাপত্তা প্রার্থীদের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দিতে পারবেন এবং প্রয়োজনবোধে আদালত স্থানান্তর এবং বিবাদীর নির্দিষ্ট কোনো এলাকায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা জারি করাসহ নিরাপত্তার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারবেন।

কিন্তু অনেকের মতে দায়রা আদালতে মামলা দায়ের সম্পর্কিত এই আইনের ৭ ধারার শিরোনাম হলো- 'অভিযোগের অপরাপর ধরণ'। সুতরাং, মামলা দায়েরের নিয়মিত ফোরামের বাইরে দায়রা আদালতকে 'বিকল্প ফোরাম' হিসেবে এই আইন ঘোষণা করেছে। এটা এই আইনের বিশেষত্ব। এই আইনে দায়রা আদালতে অভিযোগ দায়েরকে যেহেতু 'অপরাপর ধরন' হিসেবে উলেস্নখ করা হয়েছে, সুতরাং, মামলা দায়েরের 'নিয়মিত ধরন' যে আছে, সেটা সহজেই বোধগম্য। সেই নিয়মিত ধরন/ফোরাম কোনটি সেটি স্পষ্ট হয় এই আইনের ৯ ধারা পাঠ করলে।

যেখানে বলা হয়েছে, তদন্ত, অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ফৌজদারি কার্যবিধি প্রযোজ্য হবে। আর ফৌজদারি কার্যবিধি প্রযোজ্য হওয়া মানেই ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের এখতিয়ার বহাল থাকা। এই আইনে ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের এখতিয়ার বারিত করা হয়নি কারণ ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টের এখতিয়ার বারিত হলে এই আইন প্রণয়ন নিরর্থক হয়ে পড়বে। কারণ সংবিধান ও সিআরপিসি অনুসারে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনেই আসামির প্রডাকশন হয় এবং নির্যাতিত আসামির বক্তব্য প্রদানের সবচেয়ে উপযুক্ত ফোরাম ম্যাজিস্ট্রেট। এই আইনে ম্যাজিস্ট্রেটের এখতিয়ার যে অটুট আছে, সেটি মহামান্য আপিল বিভাগের ৬৯ ডিএলআর এডি ৬৩ মামলার রায়ের মাধ্যমে 'অবিসংবাদিত' হয়ে উঠেছে।

সেক্ষেত্রে বলা যায়,ম্যাজিস্ট্রেট কিভাবে উক্ত আইনের বাইরে আপিল বিভাগের রায়ে এখতিয়ার চর্চা করবে তা আগেই বলা হয়েছে। তবে ওই আইন অনুসারে নয়। ফৌজদারি কার্যবিধি অনুসারে। আর দুজায়গায় অভিযোগ করার কথা বাংলাদেশের কোনো আইনেই নেই। বিপরীতে বলা হয়--খোদ সিআরপিসিতে বেশ কিছু প্রতিকারের ক্ষেত্রে জুডিসিয়াল ও এক্সিকিউটিভ উভয় ম্যাজিস্ট্রেটকে এখতিয়ার দেয়া আছে। যেমন ১০০ ধারা। খোরপোশ আদায়ে পারিবারিক আদালতের পাশাপাশি পারিবারিক সহিংসতা আইনে ম্যাজিস্ট্রেটকেও এখতিয়ার দেয়া আছে।

সিআরপিসির ৪৯৮ ধারায় বেইল দেয়ার এখতিয়ার দায়রা জজ ও হাইকোর্ট উভয়কে দেয়া আছে। কিন্তু ১০০ ধারা মামলা দায়ের সংক্রান্ত নয়। সার্চ সংক্রান্ত। আর পারিবারিক আদালত ও পারিবারিক সহিংসতা আইন ভিন্ন আইনে পরিচালিত হয়। একটা ফৌজদারি আইন এবং অন্যটি পারিবারিক আদালতের বিশেষ আইন। আবার জামিন সংক্রান্তে যা উলেস্নখ করা হয় তাও অভিযোগ দায়ের সংক্রান্ত নয়।

অনেকের প্রশ্ন হলো, এই আইনে ৭ ধারাকে অভিযোগের অপরাপর ধরন হিসেবে কেন বলা হলো? প্রকৃতপক্ষে দায়রা আদালত এই আইনের অভিযোগগ্রহণকারী আদালত নয়। দায়রা জজ আদালতে ক্ষতিগ্রস্ত নয় এমন তৃতীয় পক্ষ ৭ ধারায় অভিযোগ করতে পারবেন। কিন্তু এই প্রশ্নের বিপরীতে পুনরায় উলেস্নখ করা যায় যে, ওই ধারায় পুলিশ অভিযোগ পেয়ে কি করবেন থাকলেও দায়রা জজ আদালত কি করবেন তা নেই। তাহলে নিশ্চিতভাবে এই আইনের এখতিয়ারধীন দায়রা আদালত ৪ ও ৫ ধারা অনুসারে আগাবেন। আবার এসপি বা তদূর্ধ্ব কর্মকর্তা দায়রা জজ আদালতে অভিযোগ দায়েরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে একটি রিপোর্ট পেশ করবেন।

যেমন রেজিস্ট্রার্ড ডাক্তার ৪ ধারায় ২৪ ঘণ্টার মধ্যে এই আইনের এখতিয়ারাধীন আদালতে রিপোর্ট পেশ করেন। মূলত ৭ ধারাটি ৫ ও ৬ ধারার অতিরিক্ত সংযোজন এবং অভিযোগের সর্বশেষ ধরন। ৭ ধারায় সে কারণেই ছাড়াও কথাটি আছে। ৭ ধারটি তাই এখানে উলেস্নখ করা হলো: ৭। (১) ধারা ৫ ও ৬-এ বর্ণিত প্রক্রিয়া ছাড়াও কোনো ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত না হওয়া সত্ত্বে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি দায়রা জজ আদালতে অথবা পুলিশ সুপারের নিচে নয় এমন কোনো পুলিশ কর্মকর্তার কাছে নির্যাতনের অভিযোগ দাখিল করিতে পারিবে।

(২) উপ-ধারা (১) এ বর্ণিত এ ধরনের কোনো অভিযোগ পাওয়ার পর পুলিশ সুপার অথবা তার চেয়ে ঊধ্বর্তন পদমর্যাদার কোনো অফিসার তাৎক্ষণিক একটি মামলা দায়ের ও অভিযোগকারীর বক্তব্য রেকর্ড করিবেন এবং মামলার নম্বরসহ এই অভিযোগের ব্যাপারে কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাইতে পারে উহা অভিযোগকারীকে অবহিত করবেন।

(৩) উপরে বর্ণিত উপ-ধারা (২) মোতাবেক অভিযোগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণকারী পুলিশ সুপার অথবা তার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা অভিযোগ দায়েরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে দায়রা জজ আদালতে একটি রিপোর্ট পেশ করবেন।

আবার উপমহাদেশে সব আইনে স্বীকৃত যে, দুই আদালতে অভিযোগ করা যায় না। এর বিপরীতে যুক্তি দেয়া হয় বস্তুত হেফাজতে নির্যাতন আইনটি বিশেষ ধরনের আইন। এখানে ৭ ধারায় 'অপরাপর অভিযোগের ধরনের ফোরামের' দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায়, এখানে দায়রা জজের পাশাপাশি পুলিশ সুপারকেও এখতিয়ার দেয়া আছে। আর সহকারী জজ আদালতের মামলা যুগ্ম জেলা জজ আদালতে করা যায়। কিন্তু ওই আইনে পুলিশ সুপারকে অভিযোগ গ্রহণ করার ক্ষমতা দেয়াটা নারী ও শিশু আইনে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আদালত তথা একজন জেলা জজকে ও থানায় অফিসার ইনচার্জকে অভিযোগ গ্রহণের ক্ষমতা দেয়ার মতো।

আর সিপিসির ১৫ ধারায় আছে, প্রত্যেকটি মামলা উহা বিচার করার যোগ্যতাসম্পন্ন সর্বনিম্ন পর্যায়ের আদালতে দায়ের করতে হবে। তাই দুই আদালতে অভিযোগ করার সুযোগ নেই। কেননা, ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ২০১ ধারায় আছে, যদি এমন কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে লিখিত অভিযোগ করা হয় যিনি ঘটনাটি আমলে নিতে উপযুক্ত নহেন তাহলে তিনি তা যথাযথ আদালতে দাখিল করার জন্য সেই মর্মে পৃষ্ঠাঙ্কন করে অভিযোগটি ফেরত দেবেন। অভিযোগটি যদি লিখিতভাবে করা না হয়, তাহলে ওই ম্যাজিস্ট্রেট ফরিয়াদিকে উপযুক্ত আদালতে প্রেরণ করবেন।

তাই একথা পুনরায় বলা যায়, নির্যাতন এবং হেফাজতে মৃতু্য (নিবারণ) আইন-২০১৩ এর অধীনে অভিযোগ দায়রা জজ আদালত নেবে। ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নয়। আর ম্যাজিস্ট্রেট আদালত আপাতত ১৯০(১)(সি) মোতাবেক আগাতে পারে। কিন্তু অভিযোগ নিতে পারলে তিনি মামলা আমলে নিতে পারবেন কি? আর এ ক্ষেত্রে ও বিতর্ক থাকলে মাননীয় আপিল বিভাগে ওই রায়ের রিভিউ আবেদনে তা নিষ্পত্তি হতে পারে। আর আদালত আইন তৈরি করতে পারে না যুক্তিতে ইতোমধ্যেই ২০২০ সালের ফেব্রম্নয়ারি মাসে বিনা পরোয়ানায় গ্রেপ্তার সংক্রান্ত ফৌজদারি কার্যবিধির ৫৪ ধারা ও রিমান্ড সংক্রান্ত ১৬৭ ধারা সংশোধনের নির্দেশনার বিষয়ে আপিল বিভাগের রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। যা শুনানির অপেক্ষায় আছে এবং সেখানেই আশা করি সব ধোঁয়াশা দূর হবে।

চন্দন কান্তি নাথ: বিচারক, ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইবু্যনাল (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ), বরিশাল।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে