রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

ডিক্রি রদবদলে 'পৃথক মামলা' দীর্ঘসূত্রতাসহ নানাবিধ জটিলতা তৈরি করবে

বাংলাদেশের পারিবারিক আদালতগুলোতে ডিক্রিজারি মামলা চলমান থাকার একপর্যায়ে অনেক ক্ষেত্রে ডিক্রিদার খোরপোশ বৃদ্ধির প্রার্থনা করেন। কখনো কখনো খোরপোশের দায় থেকে অব্যাহতি বা খোরপোশের পরিমাণ হ্রাসের প্রার্থনায় দায়িকও আদালতের শরণাপন্ন হন। এসব আবেদন নিষ্পত্তি করতে চাইলে আদালতকে ডিক্রিপরবর্তী ঘটনা- যেমন: তালাক, দায়িকের আর্থিক সঙ্গতির হ্রাস-বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি প্রভৃতি বিবেচনায় নিতে হয় এবং মূল ডিক্রিতে কিছু রদবদল আনতে হয়। পরিবর্তিত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে পারিবারিক ডিক্রির এ রকম সামান্য রদবদল বিশ্বব্যাপী একটি স্বাভাবিক ঘটনা হলেও আমাদের দেশে এ ধরনের আদেশ প্রদানের ক্ষেত্রে পারিবারিক আদালতগুলোর মধ্যে এক ধরনের দ্বিধা কাজ করে। বিষয়টি নিয়ে দুই পর্বে লিখেছেন বিচারক মারুফ আলস্নাম। আজ ছাপা হলো শেষ পর্ব
মারুফ আলস্নাম, জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী
  ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

ডিক্রি পরবর্তী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে মূল আদেশটিতে সামান্য রদবদলের প্রয়োজন দেখা দিলে নতুন মামলা দীর্ঘসূত্রতাসহ নানা জটিলতা তৈরি করবে। তার চাইতে বরং আগের মামলার অধীনে আবেদন গ্রহণ করে উভয়পক্ষকে শুনানির সুযোগ দিয়ে প্রতিকারটি দেওয়া হলে সবদিক থেকে সুবিধাজনক হবে। এক্ষেত্রে কয়েকটি যুক্তি বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।

প্রথমত, ডিক্রি রদবদলের আবেদনটি পুরাতন মামলার নথিতে যত দ্রম্নততার সঙ্গে নিষ্পত্তি করা সম্ভব, নতুন মামলার নথিতে তত দ্রম্নত নিষ্পত্তি সম্ভব হবে না। পুরনো মামলার নথিতে উভয়পক্ষ আগে থেকেই হাজির থাকেন। পক্ষান্তরে নতুন মামলার নথিতে বিবাদীকে হাজির করানো সময়সাপেক্ষ ব্যাপার হবে। পারিবারিক মামলাগুলোতে প্রায়শই দেখা যায়, মামলা প্রলম্বিত করতে বিবাদীপক্ষ নানা ধরনের অসাধু উপায় অবলম্বন করে থাকেন। যেমন- মামলার নোটিশ নিতে গড়িমসি করেন কিংবা অনেক ক্ষেত্রে নোটিশ গ্রহণ করেন না। এর ফলে একতরফা আদেশ দিয়ে মামলার নিষ্পত্তি করতে হয়।

সেই একতরফা আদেশ রদরহিত করার জন্য বিবাদীপক্ষ দীর্ঘদিন পরে এসে একটি আবেদন করেন। এই আবেদনটি নিষ্পত্তির জন্য আবারো অপরপক্ষকে নোটিশ দিতে হয়। সেই নোটিশ জারি হলে অপরপক্ষ আপত্তি দেন। এরপর জবানবন্দি-জেরা গ্রহণপূর্বক উভয়পক্ষকে শুনানির সুযোগ দিয়ে আগের একতরফা আদেশটি রদরহিত হয় এবং মূল মামলাটি পুনর্বহাল হয়। উলিস্নখিত প্রক্রিয়ায় মূল মামলায় ফেরত যেতে কখনো কখনো বছরাধিককাল পেরিয়ে যায়। অতপর, সেই মামলাটি দোতরফা সূত্রে নিষ্পত্তি হয়। এভাবে মামলায় বাদীকে সীমাহীন ভোগান্তির শিকার হতে হয়। খোরপোশ হ্রাসবৃদ্ধির আবেদনটি আগের মামলার অধীনেই নিষ্পত্তি করা গেলে এই অহেতুক প্রলম্বন ও ভোগান্তি থাকবে না।

দ্বিতীয়ত, ডিক্রিপরবর্তী ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আগের আদেশটিতে যে- 'সামান্য রদবদলের' প্রয়োজন পড়ে, পৃথক মামলার চাইতে আগের মামলার অধীনে এই রদবদল করা সহজ ও নির্ঝঞ্ঝাট হবে। মামলা নতুন বা পুরাতন যাই হোক- আদালত যদি সন্তুষ্ট হয়ে খোরপোশ হ্রাস-বৃদ্ধির আদেশ দেন, সেক্ষেত্রে নতুন এই আদেশটিকে 'আগের আদেশের ধারাবাহিকতা' হিসেবে দেখানো উচিত হবে। কিন্তু নতুন মামলার নথিতে এই আদেশটিকে আগের মামলার আদেশের 'ধারাবাহিকতা হিসেবে দেখানোর সুযোগ থাকবে না; বরং আগের আদেশটিকে রদরহিত করতে হবে (কারণ একই বিষয়ে দুটি ডিক্রি বহাল থাকতে পারে না)। এভাবে আগের আদেশটি রদরহিত হলে জটিলতা বাড়বে। কারণ এমনও হতে পারে যে, আগের ডিক্রির অধীনে খোরপোশের সমুদয় অর্থ পরিশোধিত নেই। সেক্ষেত্রে আগের ডিক্রিটি রদরহিত হওয়ার অজুহাতে ওই ডিক্রির অবশিষ্ট অর্থ পরিশোধের দায় থেকে অব্যাহতি নেওয়ার সুযোগ খুঁজবেন দায়িক। সুতরাং, নতুন আদেশটিকে আগের আদেশের 'ধারাবাহিকতা' হিসেবে দেখানোই বেশি যুক্তিযুক্ত হবে এবং সেটি সুচারুভাবে করা সম্ভব হবে কেবল পুরাতন নথিতেই।

শুধু তাই নয়, খোরপোশের একটি মামলা দীর্ঘ সময়ব্যাপী আদালতের পর্যবেক্ষণে থাকে। মামলার নথিতে এক বিচারকের পর আরেক বিচারক আসেন। কোনো কোনো আদেশ দিতে গিয়ে মামলার আগের ইতিহাস দেখে নেওয়া প্রয়োজন হয়। সেক্ষেত্রে বিচারক নতুন নথিতে এই মামলার পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস পাবেন না। গোড়ার ইতিহাস জানতে হলে তাকে আগের নথিটি তলব দিতে হবে। এতে অহেতুক বিড়ম্বনা বাড়বে।

'তালাকের ঘটনা' বিবেচনা করা গেলে ডিক্রিপরবর্তী অন্য ঘটনা বিবেচনা করা যাবে না কেন?

আমাদের পারিবারিক আদালতগুলো ডিক্রিপরবর্তী তালাকের বিষয়টি জারি পর্যায়ে নিয়মিতভাবেই বিবেচনা করে আসছেন। তালাক প্রমাণ হলে পারিবারিক আদালত স্ত্রী বরাবর তিন মাসের ইদ্দতকালীন খোরপোশ প্রদানের আদেশসহ নিয়মিত খোরপোশ পরিশোধের দায় থেকে স্বামীকে অব্যাহতি দিয়ে থাকেন।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে, ডিক্রিপরবর্তী ঘটনা (তালাক) বিবেচনায় নিয়ে মূল মামলার অধীনেই প্রতিকার দেওয়ার নিয়ম আমাদের পারিবারিক আদালতগুলোতে 'অপরিচিত' বা 'নতুন' কোনো বিষয় নয়। তালাক প্রমাণ ও নিয়মিত খোরপোশ প্রদানের দায় থেকে অব্যাহতির প্রার্থনায় স্বামীকে পৃথক মামলার দিকে কখনই ঠেলে দেওয়া হয় না। সব সময়ই মূল মামলার অধীনে এ ধরনের আবেদন বিবেচনা করে প্রয়োজনীয় প্রতিকার প্রদান করা হয়।

এখন প্রশ্ন হলো- ডিক্রিপরবর্তী তালাকের ঘটনা চলমান মামলার অধীনেই বিবেচনা করতে পারলে ডিক্রিপরবর্তী অন্যান্য ঘটনাসমূহ (যেমন- দায়িকের আর্থিক সামর্থ্যের হ্রাস-বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি) পারিবারিক আদালত কেন চলমান মামলায় বিবেচনায় নিতে পারবেন না?

চলমান মামলার অধীনেই মূল ডিক্রির রদবদল করা যাবে যেভাবে

মূল ডিক্রি রদবদলের প্রয়োজন হলে নতুন মামলার পরিবর্তে চলমান মামলার অধীনেই যেন এ সম্পর্কিত আবেদনটি সুচারুভাবে নিষ্পত্তি করা যায়, সেজন্য নিম্নোক্ত প্রক্রিয়া অনুসরণ করা যেতে পারে।

যে পক্ষ ডিক্রি রদবদলের আবেদন করতে চান, আদালতে দাখিলের আগে অপরপক্ষ বা তার আইনজীবীকে তিনি আবেদনের একটি কপি প্রদান করবেন। অপরপক্ষ মূল আবেদনের ওপর প্রাপ্তি স্বীকার প্রদানপূর্বক স্বাক্ষর দেবেন। এরপর দাখিলি আবেদনটি আদালত গ্রহণ করে মূল নথিতে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা করবেন এবং শুনানির জন্য একটি তারিখ নির্ধারণ করবেন। শুনানির তারিখটি সম্পর্কে উভয়পক্ষকে নোটিশ প্রদান করতে হবে। শুনানির দিন অপরপক্ষ উপস্থিত না থাকলে আদালত দেখবেন, নোটিশ জারি হয়েছে কিনা। নোটিশ জারি থাকলে আদালত একতরফা শুনানি করে প্রয়োজনীয় আদেশ দেবেন। নোটিশ জারি না হলে নোটিশ জারি-অন্তে শুনানির দিন ধার্য করবেন।

শুনানির দিন অপরপক্ষ আদালতে হাজির হয়ে আবেদনের যৌক্তিকতা মেনে নিতে পারেন অথবা আপত্তি (লিখিত বা মৌখিক) দাখিল করতে পারেন। যৌক্তিকতা মেনে নিলে আপসমূলে ডিক্রি সংশোধন হতে পারে। আর অপরপক্ষ থেকে আপত্তি দাখিল করা হলে তার শুনানি সেদিনই বা পরবর্তী ধার্য তারিখে হতে পারে। উভয়পক্ষ নিজ নিজ দাবির সমর্থনে প্রয়োজন মনে করলে সাক্ষ্যপ্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেন এবং অপরপক্ষকে জেরাও করতে পারেন। যথাসম্ভব সংক্ষিপ্তভাবে শুনানি গ্রহণ করে আদালত আদেশ দেবেন। কোনো পক্ষ সংক্ষুব্ধ বোধ করলে আপিল করতে পারবেন।

উলেস্নখ্য যে, জারির নথিতে আবেদনটির শুনানি না করে মূল নথিতে করা সমীচীন হবে। মূল নথি রেকর্ড রুমে গিয়ে থাকলে সেক্ষেত্রে সেটি তলব দিতে হবে। মূল ডিক্রিতে আদালত রদবদল আনার আদেশ প্রদান করলে সেই আদেশটি সংশ্লিষ্ট জারির নথিতে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বা ডিক্রিদারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জারির নথিতে প্রয়োজনীয় সংশোধন আনতে পারবেন।

উলিস্নখিত প্রক্রিয়ায় কোনো পক্ষের ক্ষতির আশঙ্কা ছাড়াই দ্রম্নত গতিতে পক্ষগণকে প্রয়োজনীয় প্রতিকার দেওয়া সম্ভব হবে।

উপসংহার

পারিবারিক মামলার প্রকৃতিই এমন যে, এর ডিক্রি সময়ে রদবদলের প্রয়োজন পড়ে। পৃথিবীর অন্যান্য দেশে মূল মামলার অধীনেই এই রদবদলের সুযোগ রাখা আছে। আমাদের দেশেও পারিবারিক আদালতগুলো ডিক্রিপরবর্তী বিয়ে বিচ্ছেদ বিবেচনায় নিয়ে মূল ডিক্রি রদবদল করছেন এবং খোরপোশ প্রদানের দায় থেকে স্বামীকে অব্যাহতি দিচ্ছেন। এক্ষেত্রে পৃথক মামলার আবশ্যকতা নিয়ে কোনো কথা ওঠেনি।

তাহলে ডিক্রি সম্পর্কিত অন্যান্য ঘটনাগুলো আদালতের নজরে এনে ডিক্রিতে প্রয়োজনীয় রদবদল আনতে পক্ষদেরকে কেন পৃথক মামলার দিকে ঠেলে দেওয়া হবে? মূল মামলাতেই যদি উভয়পক্ষের শুনানি-অন্তে কার্যকর ও জটিলতামুক্ত আদেশ দেওয়া সম্ভব হয়, তাহলে পৃথক মামলার আবশ্যকতা কোথায়? হোসনে আরা বেগম বনাম মো. রেজাউল করিম ৪৩ ডিএলআর ৫৪৩ মামলার রায়ে সুপ্রিম কোর্ট বলেছেন, পারিবারিক আদালত গঠনের উদ্দেশ্য- 'দ্রম্নত নিষ্পত্তি'। যে কারণে দেওয়ানি কার্যবিধি ও সাক্ষ্য আইনকে পারিবারিক মামলায় প্রযোজ্য করা হয়নি।

চলমান মামলার অধীনে প্রতিকার দেওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও পক্ষদেরকে পৃথক মামলার দিকে ঠেলে দেওয়া পারিবারিক আদালতের উদ্দেশ্যের পরিপন্থি নয় কি?

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে