রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

একশত টাকা ফিস গ্রহণের অন্য গল্প

অ্যাডভোকেট এস এম তাসমিরুল ইসলাম উদয়
  ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

আলমগীর (ছদ্মনাম) পেশায় একজন অনিয়মিত রিকশাচালক। অনিয়মিত কারণ, তার বিরুদ্ধে হওয়া মামলার এজাহার অনুযায়ী তিনি সত্তরোর্র্ধ্ব। স্ত্রী ছুটা বুয়ার কাজ করে কোনোভাবে দুজন মিলে সংসার চালান। মাদক বিক্রির অভিযোগের মামলায় দুমাস হাজতবাস শেষে বের হয়ে এখনো আদালতে হাজিরা দিচ্ছেন। বর্তমানে মামলা সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে চলমান।

চেম্বারের প্রো-বোনো মামলা হিসেবে আমরা মামলাটি দেখাশুনা করছি। সেদিন আলমগীরের মামলার বাদী অর্থাৎ রাষ্ট্রপক্ষে এজাহার দায়েরকারী পুলিশ, একই সঙ্গে যিনি তর্কিত জব্দকৃত বস্তুর জব্দকারী ও জব্দতালিকা প্রস্তুতকারী অফিসার, সাক্ষ্য প্রদান করতে আদালতে এসেছেন।

সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ ও তাকে জেরার কার্যক্রম দুপুর ৩:৩০ থেকে বিকাল ৪:০০ পর্যন্ত চললো। জেরায় উঠে এসেছে সাক্ষ্য প্রদানকারী ওই ব্যক্তি এজাহারে উলিস্নখিত তর্কিত সময়ে, তর্কিত ঘটনা স্থলে ও থানায় একই সময়ে অবস্থান করছিল এবং থানায় বসেই তিনি জব্দকৃত বস্তু থেকে নমুনা আলামত পৃথকসহ ইত্যাদি কার্যক্রম সম্পন্ন করেছেন। একপর্যায়ে ম্যাজিস্ট্রেট মহোদয় ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন জেরা আর না করলেও চলবে।

আলমগীরের বক্তব্য অনুযায়ী, তাকে যে টহলকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করেছিল সেখানে আজকে সাক্ষ্য প্রদানকারী ব্যক্তি ছিলই না এমনকি তিনি এই ব্যক্তিকে থানাতেও দেখেননি। ভিআইপি রোড দিয়ে রিকশা চালানো কে কেন্দ্র করে ট্রাফিক পুলিশের সঙ্গে বাগবিতন্ডায় জড়িয়ে যাওয়া আলমগীরকে রাস্তায় টহলকারী পুলিশ ধরে থানায় নিয়ে আসে। তাকে যে মাদক মামলায় কারাগারে পাঠানো হয়েছিল তা তিনি জানতে পারেন কারাগারে যাওয়ার পরে! তার সঙ্গে একই মামলায় চালান করা অপর দুই আসামির পিসি-পিআরে একাধিক মাদক মামলার অস্তিত্ব পাওয়া যায়- যা প্রাথমিকভাবে প্রমাণ করে আলমগীরকে প্রতিহিংসা বশত এই মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

ক্রাইম সাপ্রেস পলিসি এবং মাদক/অস্ত্র উদ্ধারের ক্রেডিট গ্রহণের পলিসি উপমহাদেশ পুলিশের ঐতিহ্যের অংশ। সেই ক্রেডিটের নেশার বলি অনেক নিরীহ মানুষকে হতে হয়েছে, হচ্ছে।

৬৯ ডিএলআর (২০১৭), পৃষ্ঠা ৯৩ এ মহামান্য সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ নির্দ্বিধায় উলেস্নখ করেছেন, 'আদালত বা ট্রাইবু্যনাল নিরপরাধ মানুষের সর্বশেষ আস্থার স্থল। পুলিশি তদন্তের প্রতি আস্থাহীনতা এবং তাদের স্টেরিওটাইপ উদ্ধারের গল্প এবং ট্রায়াল ল'ইয়ারের সংকটের কারণে আদালতকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তলস্নাশি ও জব্দের বিষয়ে যথাযথভাবে আইনের অনুসরণ হয়েছে কিনা সে বিষয়ে কঠোর যাচাই-বাছাই করতে হবে। সাক্ষীর সাক্ষ্যের সঙ্গে তলস্নাশি ও উদ্ধারের গল্পের সামঞ্জস্যতা পরীক্ষা করতে হবে....'

মাদক উদ্ধারের গল্প পর্যাপ্ত পরিমাণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে বলেই এরকম রায় এসেছে।

বিকাল ৪:০০টার সময় আলমগীরকে বিদায় দেওয়ার সময় হলে খুব দ্রম্নততার সঙ্গে আকস্মিকভাবে তিনি পকেট টিসু্যর প্যাকেট থেকে একশত সত্তর টাকা বের করে তন্মধ্যকার, যেটা মূলত মানিব্যাগের কাজ করে, একশত টাকার একটি নোট জোর করে আমার হাতে গুঁজে দিতে চাইলেন। আমি টাকা গ্রহণে অস্বীকার করলে তিনি বিনয়ের সঙ্গে জানালেন, সত্তর টাকা তার পথ খরচ, তিনি দুপুরে না খেয়ে সেই একশত টাকা রেখে দিয়েছেন। আমি তাকে সেই টাকা দিয়ে খেয়ে নেয়ার পরামর্শ প্রদান করলে তিনি জানালেন, বাসায় গিয়ে তিনি খেয়ে নিতে পারবেন তাছাড়া চিন্তায় তার ক্ষুধাও মরে গেছে।

আমি বারংবার সেই টাকা গ্রহণে অস্বীকার করলে তিনি ভাবলেন আমি অহংবশত টাকা গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাচ্ছি। আলমগীর অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বললেন, আপনি যেই কাজ করে দিয়েছেন তার পয়সা দেওয়ার সামর্থ্য আমার নেই। গত কয়েকদিন তিনি রিকশা চালাতে পারেনি। আমি এই টাকাটা নিলে তিনি খুশি হবেন। তার আবেগের সম্মানার্থে তার এই সম্বলটুকু ফিরিয়ে দেওয়ার শক্তি আর পেলাম না।

তার দেওয়া সেই একশত টাকা স্মারক হিসেবে সংরক্ষণ করার চিন্তা করলাম। আশা করি, এই স্মারক রাষ্ট্রীয় বাহিনীর জুলুমের বিরুদ্ধে নিরীহ নাগরিকদের পক্ষে আইনি লড়াইয়ে অনুপ্রেরণা জোগাবে।

লেখক: তরুণ আইনজীবী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে