শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ভিকটিম বেস্নইমিং এবং আদালতের আশ্রয়ে এসেও বিপদগ্রস্ত এক নারীর গল্প

রাস্তাঘাটে, অফিস-আদালতে ধরে ধরে জিজ্ঞেস করবে, আপনার মেয়েটার কী খবর? মামলা আর কতদিন চলবে? আহারে! এত ভালো মেয়েটা আর সংসার করতে পারল না! কেউ ব্যাক সাউন্ড দিয়ে বলবে, এটা তারই দোষ। ওর চলন দোষে এমনটা হয়েছে। কেউ বলবে, কই আর কারো সঙ্গে তো এমন হয় না ! কেউ বলবে, ওর পরিবারেও দোষ আছে। ম্যানেজ করতে পারেনি
সাইফুল ইসলাম পলাশ
  ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ০০:০০

নির্দেশক্রমে মা-মেয়েকে আদালতের সামনে আনা হলো। অভিযোগ জবানবন্দি দেওয়ার পর তারা স্বাক্ষর করছেন না। শেষ বিকালে আমার খুব রাগ হচ্ছিল পিয়নের ওপর। নিশ্চয়ই সে ফরিয়াদি ও তার মায়ের সঙ্গে কোনো ঝামেলা করেছে।

ফরিয়াদি ডলি তার স্বামী ও শ্বশুর-শাশুড়ির বিরুদ্ধে একটি যৌতুকের মামলা করেছিলেন। কয়েকদিন আগে সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে জবানবন্দিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেছেন। ফরিয়াদির সঙ্গে কথা বলছি...

- লেখায় কোনো সমস্যা হয়েছে কি?

- না স্যার, কোনো সমস্যা হয়নি।

- আপনি জানেন কি এভাবে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করলে আপনার কারাদন্ড/অর্থদন্ড হতে পারে?

- আমাদের ভুল হয়ে গেছে স্যার। মাফ করে দেন।

- তাহলে কেন স্বাক্ষর করতে চাচ্ছিলেন না?

- ৬ মাস ধরে উকিল সাহেবকে বলছি মামলা চালাব না। কিন্তু উনি মামলা তুলছেন না।

- কেন? উনি কেন মামলা তুলবেন না?

- স্যার, উনি বলেছেন, এটা সংস্থার মামলা। সংস্থা আমাকে আইন সহায়তা দিচ্ছে। সংস্থার অনুমতি ছাড়া মামলা তোলা যাবে না।

- আপনি আসলে কি চান তাহলে?

- স্যার, আমার শ্বশুর-শাশুড়ি খুব অসুস্থ। তারা দুজনেই প্যারালাইজড। ওদের জেল দিয়েন না।

- ও আচ্ছা। আপনার শ্বশুর-শাশুড়ি তো মামলার আসামি নন। তাদের অনেক আগেই বাদ দেওয়া হয়েছে। এখন কী তাহলে আপনার স্বামীর বিচার চান?

মেয়েটা কথা বলে না। মাঝে মাঝে আমি অবাক হই, যার এমন একটা দরদি মন আছে, শ্বশুর-শাশুড়ির প্রতি এমন ভালোবাসা আছে, সেই মেয়েটারও সংসার হয় না। কেন মামলা চালাতে চায় না তা বুঝলাম ফরিয়াদির মায়ের কথায়।

ফরিয়াদির সঙ্গে কথা বলতে বলতে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা তার মায়ের মোবাইলটা বেজে উঠল। কোর্ট স্টাফদের ধমকে বাটন মোবাইলটা বন্ধ করে একটি পলিব্যাগে ঢুকিয়ে নিল। লক্ষ্য করছি তিনি কাঁপছেন। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে এবার তিনি বললেন,

- বাবা, ডলি মামলা করার পর ওর বাবা মারা গেল। করোনার পর কোথাও কাজ-কাম নাই। আমার চারটা মেয়ে আর আমি পাতালে পড়ে গেলাম। বাধ্য হয়ে ডলিসহ অন্যের বাড়িতে ঝি-এর কাজ করা শুরু করলাম। একটা ভাঙা ঘরে আমরা থাকি। ঘর দিয়ে পানি পড়ে। ডলিকে গত ০৩ বছর ধরে বিয়ে দিতে চাচ্ছি। কিন্তু পারছি না।

- কেন পারছেন না?

- মামলার কারণে পারছি না।

- কেন কেন?

- যখনই কোনো প্রস্তাব আসে তখনই লোকে বলে মেয়ের নামে মামলা আছে। মেয়ে কোর্টে যায়। আর তখনই বিয়েটা ভেঙে যায়।

- কিন্তু মামলা করায় আপনার মেয়ের কী দোষ?

- লোকে বললে কী করার আছে!

২.

সত্যিই কিছু করার নেই। আমাদের সমাজে কোথাও কোনো অঘটন ঘটলে ঘটনা যাই ঘটুক বা যেই ঘটাক না কেন ঘটনাটার জন্য সাধারণত নারীকেই দায়ী করা হয়।

আদালত প্রাঙ্গণেও দেখেছি, যে মেয়েটা মামলা করতে আসে তাকেই অনেকে বাঁকা চোখে দেখে। যেন মামলা করাটাই একটা অপরাধ। আমরা কেউ বুঝতে চাই না যে, একটা মেয়ে শখ করে আদালতে আসে না।

রাস্তাঘাটে, অফিস-আদালতে ধরে ধরে জিজ্ঞেস করবে, আপনার মেয়েটার কী খবর? মামলা আর কতদিন চলবে? আহারে! এত ভালো মেয়েটা আর সংসার করতে পারল না!

কেউ ব্যাক সাউন্ড দিয়ে বলবে, এটা তারই দোষ। ওর চলন দোষে এমনটা হয়েছে। কেউ বলবে, কই আর কারো সঙ্গে তো এমন হয় না ! কেউ বলবে, ওর পরিবারেও দোষ আছে। ম্যানেজ করতে পারেনি।

কখনো কখনো দেখেছি মামলার শুনানিকালে যখন কোনো মেয়ে প্রতিবাদ করে কিছু বলে উঠে তখন আসামিপক্ষের আইনজীবী বলে উঠেন, এই জন্যই তো তোমার সংসারটা হয়নি।

আর পূর্বের সংসার বা অতীত রেকর্ড নিয়ে কথা বলার কথা বাদই দিলাম। কিন্তু কখনো কখনো আমার এমনও মনে হয়েছে- আগের সংসার হয়নি, তাই এটাও হবে না- এমনটা অধিকাংশ মানুষের ধারণা।

আর এভাবে চলতে চলতে এক সময় প্রতিবাদী মেয়েটাও মানসিক শক্তি হারিয়ে ফেলে। ডলির মতোই বিচারপ্রাপ্তি নিয়ে তার প্রচেষ্টা কমে যায়। ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হয়।

ধর্ষণের শিকার নারীকে বলা হয়, তোমার এ ধরনের কাপড় পড়া উচিত হয়নি। তোমার আরেকটু সতর্ক থাকা উচিত ছিল; তাহলে এমনটা হতো না। মনে পড়ে গেল, আশির দশকের 'আদালত ও একটি মেয়ে' সিনেমার কথা। তনুজা অভিনীত তপন সিনহার সিনেমাটি যারা দেখেছেন তারা বুঝবেন আজ চলিস্নশ বছর পরেও এ সমাজের দৃশ্যতো কোনো পরিবর্তন হয়নি। এখনো অপরাধীর অপরাধ বিশ্লেষণ না করে নারীকে দায়ী করে ঘটনার পেছনে তার কোনো ভূমিকা আছে কিনা সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করা হয়। আর এটাই হচ্ছে ভিকটিম বেস্নইমিং।

৩.

পরিবর্তন কীভাবে আসবে যদি না আমরা আমাদের মানসিকতায় পরিবর্তন না আনি। অতি সংকীর্ণ মন-মানসিকতা সম্পন্ন মানুষ এভাবে অপরাধের শিকার ভিকটিমকে দোষারোপ করতে পারে। তারা ভেবে দেখে না ডলির মতো মেয়েরা সমাজে কতটা অপমান নিয়ে চলে, কতটা মানসিক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে জীবন কাটায়; কতটা শক্তি, সাহস ও ধৈর্য নিয়ে আদালতে আসে!

আসুন, ভিকটিমকে সরাসরি সাহায্য করতে না পারলেও এতটুকু বলি, এ পরিস্থিতির জন্য তুমি দায়ী নও। তোমার সঙ্গে যা হয়েছে তা ঠিক হয়নি। নিশ্চয়ই তুমি ন্যায়বিচার পাবে। এতটুকু সহমর্মিতা নিঃসন্দেহে টনিকের মতো কাজ করবে, তার শক্তি ও সাহস জোগাবে, নতুন করে বাঁচার আশা জাগিয়ে তুলবে।

সম্প্রতি ডলির মামলায় পলাতক আসামির সাজা হয়েছে। রায়ের পর মা-মেয়ে দুজনেই খুব খুশি। তবে তারা খুশি যতটা না আসামির শাস্তির কারণে, তার চেয়ে বেশি খুশি মামলা শেষ হওয়ার কারণে। এবার ডলির মা তার মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে।

[বি. দ্র. ভিকটিমের ছদ্মনাম ব্যবহার করা হয়েছে। প্রতীকী ছবিটি ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে।]

সাইফুল ইসলাম পলাশ, অতিরিক্ত চিফ

জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে