পৃথিবীতে প্রতিটি শিশুই আসে পরম শুদ্ধতা ও পবিত্রতা নিয়ে। তাদের ভেতর থাকে সফলতার শিখরে পৌঁছানোর অপার সম্ভাবনা। প্রতিটি শিশুর পক্ষেই এই সম্ভাবনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব যদি তারা সঠিক পারিবারিক ও সামাজিক সমর্থন পায় এবং সেই সঙ্গে তাদের সুষ্ঠু শারীরিক ও মানসিক বিকাশ ঘটে। ধীরে ধীরে শৈশব, কৈশোর, তারুণ্য পেরিয়ে শিশুটি পরিণত বয়সে এসে পৌঁছে। তবে সঠিক শিক্ষা ও সংস্কারের অভাবে শিশু-কিশোররা অপরিণত বয়সেই তাদের অপরিপক্ব সংবেদনশীল মানসিকতার ওপর নির্ভর করে যে কোনো বিরূপ সিদ্ধান্ত এমনকি পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে অপরাধ করার সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
কিশোর অপরাধ নিয়ে আলোচনার শুরুতে কোন বয়সটিকে শিশু-কিশোর হিসেবে ধরা হয় তার একটি স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন। জাতিসংঘ গৃহীত শিশু অধিকার সনদের অনুচ্ছেদ এক অনুযায়ী আঠার বছরের নিচে সব মানব সন্তান শিশু। উলেস্নখ্য, বাংলাদেশ এই সনদ গ্রহণ করেছে। এমনকি বাংলাদেশের শিশু আইন-২০১৩ অনুযায়ী ১৮ বছরের নিচের সবাই শিশু। তাই ১৮ বছর বয়সের নিচের শিশুদের অপরাধকেই আমরা আইন অনুযায়ী কিশোর অপরাধ বলে থাকি।
কিশোর অপরাধ মূলত অপরিপক্ব সংবেদনশীল মানসিকতা ও প্রতিকূল পরিবেশের প্রভাবেই হয়ে থাকে। জীবনের এই ধাপে শিশু-কিশোররা যে কোনো সামাজিক বা পারিবারিক সমস্যায় তীক্ষ্ন প্রতিক্রিয়া দেখায়। পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের যে কোনো অস্থিরতা আর অবহেলাই তাদের কোমল হৃদয়কে ভাবিয়ে তোলে। পিতামাতার বিবাহ বিচ্ছেদ, দারিদ্র্য, অবহেলা, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অপসংস্কৃতি ইত্যাদি হলো কিশোর অপরাধের কয়েকটি উলেস্নখযোগ্য কারণ।
কারণ ও পরিস্থিতির ওপর ভিত্তি করে কিশোর অপরাধ নিয়ে অপরাধ বিদ্যা ও আইন একটু ভিন্নভাবে চিন্তা করে। তাই আইনে শিশু অপরাধীদের বিচারের চেয়ে তাদের সংশোধনের বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের বিচার প্রক্রিয়া হওয়া উচিত সংশোধনমূলক। অন্যথায়, বিচার ও শাস্তি তাদের কিশোর হৃদয়ে বিরূপ প্রভাব বা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। আদালতের কার্যবিধি ও জেলখানার শাস্তি থেকে দূরে রেখে, স্নেহ মমতা ও ভালোবাসা ও যত্ন নিয়ে বুঝিয়ে কিছুটা কঠোর নিয়ন্ত্রণে তাদের সংশোধন করে তোলাই কিশোর অপরাধের প্রকৃত বিচার। আর এই সংশোধনের লক্ষ্যেই আইনে শিশুদের পৃথক আদালতে বিচারের কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে বলা হয়েছে, কিশোর সংশোধনাগার প্রতিষ্ঠার কথা।
বাংলাদেশ শিশু আইন-২০১৩-এ শিশু অপরাধীদের বিচারের জন্য প্রতিটি জেলা সদর ও মহানগর এলাকায় কমপক্ষে একটি শিশু আদালত প্রতিষ্ঠা করার কথা বলা হয়েছে। একই আইনের ১৫ ধারায় বলা হয়েছে কোনো শিশুকেই প্রাপ্তবয়ষ্ক অভিযুক্তের সঙ্গে একত্রে বিচার করা যাবে না। এমন কোনো অপরাধ যেখানে শিশু ও প্রাপ্তবয়ষ্ক উভয়েই আসামি, সেক্ষেত্রে শিশুর জন্য আলাদা অভিযোগপত্র দাখিল করতে হবে। আইনের ধারা ১৭(৪) অনুযায়ী শিশু আদালত অবশ্যই সাধারণ আদালত থেকে ভিন্ন হবে। যে কক্ষে শিশুর বিচার হবে, সেখানে কোনো সাক্ষীর কাটারা বা লাল গালিচার মঞ্চ থাকা যাবে না। সর্বোপরি, বিচারের পরিবেশ কোনোভাবেই যাতে শিশু মনে ভীতি সৃষ্টি করতে না পারে।
শিশু আইনের ৩১(২) ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, শিশু অপরাধের কোনো বিচারক তার সিদ্ধান্ত দেওয়ার পূর্বে অবশ্যই শিশুর বয়স, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা, শিক্ষাগত যোগ্যতা, সামাজিক অবস্থান, পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা, শিশু ও তার পরিবারের জীবনধারা এবং অপরাধটি করার পেছনে কারণসমূহ বিবেচনা করবে। সেই সঙ্গে এই আইনে শিশুদের গ্রেপ্তার, তাদের অপরাধের তদন্ত, জামিন এবং তাদের জন্য আইনজীবী নিয়োগের ব্যাপারেও সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। শিশু আইনটি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারেও গুরুত্ব দিয়েছে। ধারা ৫৯ অনুযায়ী এই আইনের অধীনে সরকার পর্যাপ্তসংখ্যক কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে বাধ্য থাকবে। এসব উন্নয়ন কেন্দ্রের উদ্দেশ্য হচ্ছে- যেসব শিশু বিচার প্রক্রিয়ার অধীন, বা আদালতের রায়ে কারাদন্ডপ্রাপ্ত, তাদের সঠিক পুনর্বাসন ও সংশোধন নিশ্চিত করা।
বর্তমানে বাংলাদেশে সরকারিভাবে গাজীপুরের টঙ্গী, কোনাবাড়ীতে ও যশোরে ৩টি কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র রয়েছে। এর মধ্যে শুধু কিশোরীদের জন্য গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে অবস্থিত কেন্দ্রটি। সর্বোপরি ২০১৩ সালের সংশোধিত শিশু আইনটি কার্যকর আইন এবং শিশুদের অধিকার ও বিচারের ক্ষেত্রে আইনটি জাতিসংঘ শিশু অধিকার সনদের আদলে তৈরি একটি আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন আইন। তাই সুযোগ ও সক্ষমতার অভাবে এই আইনের সুফল থেকে শিশু-কিশোররা যাতে বঞ্চিত না হয়, সে ব্যাপারে রাষ্ট্রের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।
প্রতিটি শিশু-কিশোরেরই আছে বিশ্ব জয়ের অদম্য আশা। ত্রম্নটিপূর্ণ সমাজ ব্যবস্থা ও ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশের কারণে, অকালেই যাতে তারা বিপথগামী হয়ে অপরাধে জড়িয়ে না পড়ে প্রথমত সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে। তবে যদি পরিস্থিতির শিকার হয়ে তারা অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়েও পড়ে, তবে অবশ্যই সঠিক পদক্ষেপ ও পরিচর্যার মাধ্যমে তাদের সংশোধন করে আলোর পথে নিয়ে আসতে হবে। আর এতেই দেশ ও জাতির মঙ্গল নিহিত।