সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ বৈশাখ ১৪৩১
ইন্দিরা গান্ধীর ইলেকশন কেইস

যেভাবে শুরু হলো উপমহাদেশের অন্যতম আলোচিত মামলা

১৯৬৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী প্রথম লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তার নিজের বাড়ি উত্তর প্রদেশের রাই বেরিলি আসন থেকে। ১৯৬৯ সালে কংগ্রেস ভেঙে গেলে উত্তর প্রদেশের চিফ মিনিস্টার টি এন সিং মোরারজি দেশাইয়ের কংগ্রেস (অর্গানাইজেশন) এ যুক্ত হন। কংগ্রেস (অর্গানাইজেশন) এর নেতৃত্বে সংযুক্ত বিকাশ দল নামে মহাজোট ছিল ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেসের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থাৎ ইলেকশনের সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর নিজের প্রদেশে তার বিরোধী দল ক্ষমতায়।
হাবিবুর রহমান
  ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০

প্রথম পর্ব

১৯৬৯ সালে কংগ্রেস ভেঙে যায়। ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে পার্লামেন্টে এমপির সংখ্যা কমে যায়। ১৯৭০ সালের ২৭ ডিসেম্বর ইন্দিরা গান্ধী প্রেসিডেন্টকে পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেন। পরবর্তী নির্বাচন হওয়ার কথা ছিল ১৯৭২ সনে। কিন্তু পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়ার কারণে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে আগাম নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করা হয়।

বিরোধী দলগুলো প্রথমে বিস্মিত হলেও কমিউনিস্ট পার্টি বাদে সব বিরোধী দল মিলে 'গ্রান্ড এলায়েন্স/মহজোট' তৈরি করে কনটেস্ট করার ঘোষণা দেয়। কংগ্রেসের বিপক্ষের জোটে ছিল জনসংঘ, স্বতন্ত্র পার্টি, সংযুক্ত সোশ্যালিস্ট পার্টি এবং ইন্দিরা গান্ধীর সরকারের উপ-প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশলাইয়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস (অর্গানাইজেশন)।

১৯৬৭ সালে ইন্দিরা গান্ধী প্রথম লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তার নিজের বাড়ি উত্তর প্রদেশের রাই বেরিলি আসন থেকে। ১৯৬৯ সালে কংগ্রেস ভেঙে গেলে উত্তর প্রদেশের চিফ মিনিস্টার টি এন সিং মোরারজি দেশাইয়ের কংগ্রেস (অর্গানাইজেশন) এ যুক্ত হন। কংগ্রেস (অর্গানাইজেশন) এর নেতৃত্বে সংযুক্ত বিকাশ দল নামে মহাজোট ছিল ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেসের মূল প্রতিদ্বন্দ্বী অর্থাৎ ইলেকশনের সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর নিজের প্রদেশে তার বিরোধী দল ক্ষমতায়।

এ সময়ে একটা গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, ইন্দিরা গান্ধী এবার রাই বেরিলি থেকে লোকসভা নির্বাচন করবেন না। তিনি এবার হরিয়ানার গুরগাঁও থেকে নির্বাচন করতে চান। ২৯ ডিসেম্বর, ১৯৭০, একটা প্রেস কনফারেন্সে একজন সাংবাদিক ইন্দিরা গান্ধীকে জিজ্ঞেস করেন, বিরোধী দলের একজন নেতা আজকে বলেছেন যে, আপনি এবার আসন পরিবর্তন করে রাই বেরেলির বদলে গুরগাঁও থেকে নির্বাচন করবেন। ইন্দিরা গান্ধী উত্তর দিলেন, ঘড়, ও ধস হড়ঃ. ১৯ জানুয়ারি ১৯৭১, বিরোধী জোট রাই বেরিলি আসনে তাদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করল, সোশ্যালিস্ট পার্টির রাজ নারায়ণ। যারা জোটের সদস্য না, তারাও ওই আসনে নিজেদের কোনো ক্যান্ডিডেট না দিয়ে টেকনিক্যালি ইন্দিরা গান্ধীর বিপক্ষে রাজনারায়ণকে সমর্থন দিলেন।

ইন্দিরা গান্ধী পরের দিন রাজনারায়ণকে ভর্ৎসনা করলেন এই বলে, ঐব রং ধ বিষষ শহড়হি ঘবযৎঁ যধঃবৎ ধহফ নধরঃবৎ.

২৫ জানুয়ারি, নির্বাচন কমিশন কংগ্রেসের দুই পক্ষকে আলাদা আলাদা প্রতীক বরাদ্দ দিল। মোরারজি দেশাইয়ের কংগ্রেস (অর্গানাইজেশন) পেল- একজন নারী চরকা কাটছে, ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস পেল- একটা গরু এবং একটা বাছুর।

ভোটগ্রহণের জন্য দিন ধার্য ছিল- ৩, ৫ এবং ৭ মার্চ। নমিনেশন পেপার জমা দেওয়ার শেষদিন ৩ ফেব্রম্নয়ারি। ২৫ জানুয়ারি ঠিক হলো, ইন্দিরা গান্ধী নমিনেশন পেপার জমা দেবেন। ১ ফেব্রম্নয়ারি সকাল ১১টায়। ওই সময়েই তিনি জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের অফিসে নমিনেশন পেপার জমা দিলেন।

ইন্দিরা গান্ধী তার ইলেকশন এজেন্ট বানালেন ইয়াশপাল কাপুরকে। ইয়াশপাল কাপুর এর আগে ওএসডি অফিসার হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। মাত্র কয়েকদিন আগে সরকারি চাকরি থেকে রিজাইন করেছেন। ইয়াশপাল কাপুর এর আগে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর প্রাইভেট সেক্রেটারি। ১৯৬৭ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে সরকারি চাকরি থেকে পদত্যাগ করেন। নির্বাচনের পরে আবার তাকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়।

বিরোধী জোট 'ইন্দিরা হটাও' আর ইন্দিরা গান্ধী 'গরীবী হটাও' স্স্নোগান নিয়ে নির্বাচনি প্রচারণায় ঝাঁপিয়ে পড়েন।

রাই বেরিলি আসনে ভোটগ্রহণ হয় ৭ মার্চ। কোনো বিশেষ ঘটনা ছাড়াই স্বাভাবিকভাবেই ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হয়। ভোটগণনার হবে ৯ মার্চ।

ভোট গণনার আগেই ৮ মার্চ রাজনারায়ণ রাই বেরিলিতে বিশাল বিজয় মিছিল বের করেন। তিনি মিছিল করে রাই বেরিলির জনগণকে ধন্যবাদ জানান, তাকে ভোট দিয়ে নির্বাচিত করার জন্য।

১০ মার্চ ফলাফল আসতে শুরু করে। ফলাফলে দেখা যায়, রাজনারায়ণ এক লাখ ১০ হাজারের বেশি ভোটে হেরে গেছেন। ইন্দিরা গান্ধী পেয়েছেন ১ লাখ ৮৩ হাজার ৩০৯ ভোট, আর রাজনারায়ণ পেয়েছেন ৭১ হাজার ৪৯৯ ভোট। একজন স্বতন্ত্র প্রার্থী স্বামী আদিত্যনাথ অল্প কিছু ভোট পেয়েছেন।

রাজনারায়ণ প্রবল আত্মবিশ্বাসী মানুষ। ফলাফল দেখে মর্মাহত হলেন। এলকায় গুজব ছড়িয়ে পড়ছিল যে, ইন্দিরা গান্ধী কেমিক্যাল দিয়ে ব্যালট পেপার টেম্পার করেছেন। রাজনারায়ণ গুজব বিশ্বাস করতে শুরু করলেন। বিরোধী জোটের নেতারাও মনে করলেন, রাসায়নিক পদার্থ দিয়ে ব্যালট টেম্পার করা হয়েছে। তাদের ধারণা হয়েছিল, ব্যালটে অরিজিনাল প্রিন্টের উপরে একটা টেম্পোরারি স্ট্যাম্প মার্ক দেওয়া হয়েছিল। এই মার্কটা গণনার আগে অটোমেটিক ভ্যানিশ হয়ে গেছে। রাজনারায়ণ এটা বিশ্বাস করলেন। এখন ব্যালট টেস্ট করতে হবে? তাহলে উপায়? একমাত্র উপায় একটা ইলেকশন পিটিশন ফাইল করা। রাজনারায়ণ এবার ইন্দিরা গান্ধীর ইলেকশন চ্যালেঞ্জ করে ইলেকশন পিটিশন দায়ের করার কথা ভাবলেন।

আরপিএ, ১৯৫১ অনুসারে, ইলেকশন পিটিশন দায়ের করতে হবে স্থানীয় হাইকোর্টে ফলাফল ঘোষণার পরবর্তী ৪৫ দিনের মধ্যে।

রাজনারায়ণ এলাহাবাদ হাইকোর্টের আইনজীবী রমেশ চন্দ্র শ্রীবাস্তবের কাছে গেলেন ইলেকশন পিটিশন দায়ের করার জন্য। রাজনারায়ণ সিনিয়র আইনজীবী হিসেবে নিযুক্ত করতে চাইলেন শান্তি ভূষণকে। শান্তি ভূষণ মোরারাজি দেশাইয়ের কংগ্রেস (অর্গানাইজেশন)-এর ডাকসাইটে নেতা এবং সুপ্রিম কোর্টের জাঁদরেল অ্যাডভোকেট। বিনা পয়সায় রাজনৈতিক মামলা পরিচালনা করে তিনি যথেষ্ট খ্যাতি অর্জন করেছেন।

রাজনারায়ণ কয়েকজন জুনিয়র আইনজীবীর সহযোগিতায় একটা প্রাথমিক ড্রাফট তৈরি করে ২২ এপ্রিল অ্যাডভোকেট শান্তি ভূষণ এর কাছে গেলেন। ড্রাফট পিটিশনে ইন্দিরা গান্ধীর বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো ছিল-

১। ব্যালটপেপারে ক্যামিক্যাল টেম্পার হয়েছে।

২। ইয়াশপাল কাপুর ৫০ হাজার রুপি উৎকোচ দিয়ে স্বামী আদিত্যনাথকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে।

৩। ইন্দিরা গান্ধীর লোকজন ভোটারদের মধ্যে লেপ, কম্বল, ধুতি এবং নানা ধরনের ড্রিংকস বিতরণ করেছে।

৪। ইন্দিরা গান্ধী ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আনা নেওয়ার জন্য যানবাহন দিয়েছে।

৫। ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনে সর্বোচ্চ খরচের সীমা ৩৫ হাজার রুপির চেয়ে বেশি টাকা খরচ করেছে।

৬। ইয়াশপাল কাপুর সরকারি চাকরিতে থাকা অবস্থায় ইন্দিরা গান্ধী ইলেকশনের কাজে তার কাছ থেকে সাহায্য নিয়েছেন।

ব্যালটপেপার বাদে বাকি পাঁচটা অভিযোগ নির্বাচনী আচরণবিধির লঙ্ঘন। এর কোনো একটা প্রমাণিত হলে তার এমপি পদ বাতিল হয়ে যাবে এবং পরবর্তী ছয় বছরে কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না।

অ্যাডভোকেট শান্তি ভূষণ রাজনারায়ণের কথা শুনে মনে করলেন, এই মামলা দায়ের করার উদ্দেশ্য হচ্ছে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা। সত্যিকার অর্থে কনটেস্ট করার মতো কেইস না। কিন্তু রাজনারায়ণ নাছোড়বান্দা। শান্তিভূষণ রাজি হলেন এক শর্তে- কেমিক্যাল দিয়ে ব্যালট টেম্পারের এলিগেশন বাদ দিতে হবে। শান্তিভূষণ নিজেও এই এলিগেশন বিশ্বাস করতে পারছেন না। রাজনারায়ণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হলেন। শান্তি ভূষণ পিটিশনে আরও কয়েকটা গ্রাউন্ড যুক্ত করলেন-

১। ইন্দিরা গান্ধী তার জনসভায় পুলিশ এবং সরকারি কর্মকর্তাদের দিয়ে ব্যারিকেড, বেষ্টনী এবং মঞ্চ তৈরি করার কাজ করিয়ে নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন।

২। এয়ার ফোর্সের সরকারি বিমান ব্যবহার করে বিভিন্ন জায়গায় গিয়েছেন।

৩। ইন্দিরা গান্ধীর নির্বাচনী প্রতীক গরু এবং বাছুর একটি ধর্মীয় প্রতীক। এইগুলো নির্বাচনে ব্যবহার করা অবৈধ।

রাজনারায়ণ জিজ্ঞেস করলেন, এই মামলা জেতার চান্স কেমন। শান্তি ভূষণ বললেন, একেবারেই কম। প্রথমত, মামলা শক্ত না। দ্বিতীয়ত, একজন সিটিং প্রধানমন্ত্রীর পদ অবৈধ ঘোষণা করার সাহস খুব কম বিচারকেরই আছে। তবে শান্তিভূষণ বললেন, শক্তভাবে ফাইট করতে হবে, কোনোভাবে যদি কিছু হয়।

পরের দিন রাজনারায়ণ আবার আসলেন শান্তি ভূষণের কাছে। তিনি বললেন, ব্যালট টেম্পারিংয়ের ব্যাপারটা বাদ দেওয়ায় সারারাত একটুও ঘুমাতে পারিনি। এটা রাখা যায় কিনা? শান্তিভূষণ অনিচ্ছাসত্ত্বেও রাজি হলেন। কিন্তু অভিযোগটা একটু ঘুরিয়ে দিলেন- ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে কাস্ট হওয়া অনেক ব্যালট দেখে মনে হয়েছে এগুলো মানুষের দেওয়া ভোট না, কোনো মেকানিক্যাল প্রসেসে করা হয়েছে। ব্যালটের প্রিন্ট চেক করে দেখতে হবে যে সব ঠিক আছে কিনা।

১৯৭১ সালের ২৪ এপ্রিল ইলেকশন পিটিশন দায়ের করার শেষদিন ছিল। ওইদিন রাজনারায়ণ রমেশ শ্রীবাস্তবকে দিয়ে এলাহাবাদ হাইকোর্টের রেজিস্ট্রার অফিসে ইলেকশন পিটিশন দায়ের করলেন।

জাস্টিস ব্রম্নমের কোর্টের মামলাটি পড়ল। তিনি এক নম্বর বিবাদী প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং দুই নম্বর বিবাদী স্বামী আদিত্যনাথের নামে সমন জারি করলেন। (চলবে)

ম হাবিবুর রহমান, তরুণ আইনজীবী

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে