শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১
বুক রিভিউ

ন্যায়বিচারের অন্বেষণে

মো. মনিরুজ্জামান
  ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
ন্যায়বিচারের অন্বেষণে

বিচারাসনের উচ্চতায় বসে সহজেই পেশকার, সেরেস্তাদার, মোক্তার, মোহরার, সাক্ষী, বিচারপ্রার্থী, অপরাধী বা দর্শনার্থী সবাইকে সমান সূক্ষ্ণতা এবং নিরপেক্ষতায় দেখতে পান বিচারক। সত্য-মিথ্যার বাকযুদ্ধে উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে বিচার বঞ্চিত এজলাসে দন্ডায়মান অসহায় ফরিয়াদি অথবা মিথ্যার অহংকারে নিষ্পেষিত কাঠগড়ায় আবদ্ধ বন্দির অশ্রম্ন টলমল চোখে ভেসে ওঠা নিটোল সত্যের প্রতিচ্ছবি ছুঁয়ে যায় তার মন। আইনের সমান দৃষ্টির গদবাঁধা ছকের বাইরে সাম্য আর মানবিকতার কল্যাণকর কোমল দৃষ্টিতে দেখেন জীবন সংসারের এপিঠ ওপিঠ।

ন্যায়বিচারের পাশাপাশি আদালতের আইন-কানুনের সংস্পর্শে আসা মানুষের জীবন সহজতর করার সূক্ষ্ণ প্রয়াস চালান তিনি। বদলে দেন অনেকের জীবন। দূর করতে সচেষ্ট হন মানবাধিকার পরিপন্থি নানান আইনি অসঙ্গতি। প্রবন্ধ আকারে লিপিবদ্ধ করেন সেই শিক্ষণীয় গল্পগুলো।

একটি ওয়ারেন্ট সঠিকভাবে তামিল হলো কিনা? গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তি যথাযথ প্রক্রিয়ায় গ্রেপ্তার হলেন কিনা? পুলিশের হেফাজতে আসা ব্যক্তির তথ্য তার পরিবার জানলো কিনা? এক জেলার মানুষ অন্য জেলায় গ্রেপ্তার হয়ে তলবের অপেক্ষায় বিনা তলবে অনির্দিষ্টকাল অন্যায়ভাবে কারাগারে আটক থাকল কিনা? কারাগার থেকে আদালতে হাজিরা দিতে আসা হাজতি সারাদিন অভুক্ত থাকল কিনা? তৃতীয় লিঙ্গের বন্দিরা কারাগারে কোনো বৈষম্যের শিকার হলেন কিনা? আদালত প্রাঙ্গণে আসা নারী, শিশু কিংবা একজন নিতান্ত গরিব মানুষ তার প্রাপ্য অধিকার বঞ্চিত হলো কিনা? একজন অভ্যাসগত অপরাধীকে আদালতের ঘুরচক্কর থেকে মুক্ত করে সমাজের মূলস্রোতে ফেরানো যায় কিনা? এমন অসংখ্য অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা খালি চোখে দেখা যায় না তা হৃদয় দিয়ে অনুধাবন, সাধ্যের সর্বোচ্চ দিয়ে সফলভাবে বাস্তবায়ন, শিক্ষণীয় দৃষ্টান্ত হিসেবে সুখপাঠ্য প্রবন্ধ আকারে উপস্থাপন এবং সেই প্রবন্ধ সংকলনেরই আনুষ্ঠানিক প্রকাশ 'ন্যায়বিচারের অন্বেষণে।'

লেখক ও বিজ্ঞ বিচারক (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ) মো. সাইফুল ইসলাম মহোদয়ের প্রকাশিত দ্বিতীয় গ্রন্থ 'ন্যায়বিচারের অন্বেষণে'। শুধু গ্রন্থ রচনার উদ্দেশ্যে রচিত কোনো গ্রন্থ নয় এটি। লেখক বিচারকের আসনে বসে রীতিমতো সেবার মহান ব্রত ছড়িয়ে ছিটিয়ে সমাজের শেকড়ে প্রাণ সঞ্চার করেছেন। বৈষম্য হরণের স্বপ্নে বিভোর হয়ে স্বীয় কর্মে আলিঙ্গন করেছেন সমাজের চোখে ঘৃণিত অপরাধী বা নিন্দিত হিজড়াকে।

পরিস্থিতির শিকার অপরাধীকে সংশোধিত নবজীবনের সন্ধানে রেখেছেন কারাগারের বাইরে। নিজস্ব বিচারিক অধিক্ষেত্রে আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন লক্ষ্য করে গভীরভাবে ভেবেছেন প্রিয় মাতৃভূমির সব মানুষকে নিয়ে। সেই লক্ষ্যে জাতীয় ও অনলাইন পত্রিকায় লিখেছেন পরিবর্তনের জন্য চিহ্নিত এবং পরীক্ষিত বিষয়গুলো নিয়ে। তারই সংকলন এই বইটি।

বাস্তব উপাদানে বহুমাত্রিক ভাবনায় রচিত প্রবন্ধগুলো পড়ে একবার মনে হবে এগুলো বিচার বিভাগের জন্য দরকার। পরক্ষণেই মনে হবে এগুলো প্রবেশন অফিসার বা কারা কর্তৃপক্ষের জন্য দরকার। আবার কখনো মনে হবে এগুলো পুলিশের জন্য দরকার। তবে প্রকৃত অর্থে প্রবন্ধগুলো আমার, আপনার এবং সমাজের সবার জন্য দরকার।

নিজ নিজ অধিক্ষেত্রে ছোট ছোট গুরুত্বপূর্ণ কর্মের দ্বারা সমাজকে সুন্দর করার লক্ষ্যে বইটি আমাদের জন্য যেমন একটি গুরুত্বপূর্ণ রিমাইন্ডার, তেমনি ভাষার মাসে হতে পারে প্রিয়জনের জন্য একটি মূল্যবান উপহার।

বইটির প্রতিটি প্রবন্ধই যেন এক একটি অর্জনের সাফল্যগাথা। ১৫৯ পৃষ্ঠায় ঠাঁই পাওয়া অনুগল্প 'কৃতজ্ঞতাবোধ' এর নায়ক কাঠগড়ায় দাঁড়ানো সদ্য স্নাতক যে ছেলেটা মামলার জন্য পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টরের চাকরিতে যোগদান করতে পারছিল না, আজকে সে সুপারিশ প্রাপ্ত সহকারী পুলিশ সুপার। পরশ্রীকাতর সমাজের প্রতিহিংসার আগুনে পুড়ে অংকুরেই ছাই হতে যাওয়া ছেলেটার জীবন লেখকের বিচারিক দক্ষতার সত্য শুভ্র তুলির নিখুঁত আঁচড়ে ঘুরে দাঁড়িয়েছে ফিনিক্স পাখির মতো। এই ক্ষেত্রে সেই মহান বিচারকের ভূমিকা বর্ণনা করা যেতে পারে চন্দ্রজয়ী অভিযাত্রী নীল আর্মস্ট্রংয়ের সেই বিখ্যাত শব্দবন্ধে 'ঞযধঃ'ং ড়হব ংসধষষ ংঃবঢ় ভড়ৎ ধ সধহ, ড়হব মরধহঃ ষবধঢ় ভড়ৎ সধহশরহফ.'

সেদিন বিচারক যদি দ্রম্নত মামলাটি শেষ না করতেন তবে ছেলেটা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়তো; হয়তোবা আজকের স্বমহিমায় প্রস্ফুটিত কল্যাণের কান্ডারি সে হতে পারতো না। বিচারকের সমানুভূতিশীল আচরণে সেই ছেলেটার স্থান আজ কাঠগড়া থেকে একটি অমর প্রবন্ধে।

ন্যায়বিচারের অন্বেষণের অনুরণন ছুঁয়ে যাক সব চিন্তাশীল প্রাণ; প্রতিফলিত হোক সমানুভূূতিশীল সামাজিক পরিবর্তন।

লেক্সিলেন্স প্রকাশনী কর্তৃক প্রকাশিত বইটি বইমেলার ২৩৭নং স্টলে পাওয়া যাবে। বইটির প্রচ্ছদ মূল্য : ৪০০ টাকা হলেও ইউনিভার্সেল বুক হাউস, আমিন বুক হাউস, রহিম ল' বুকসহ সারাদেশে পাওয়া যাবে ২৬০ টাকায়। এছাড়াও অনলাইনে পাওয়া যাবে যঃঃঢ়ং://িি.িভধপবনড়ড়শ.পড়স/খবীপবষষবহপবইউ এবং গনন ঙহষরহব গধৎশবঃরহম পেজের মাধ্যমে।

বইয়ের নাম: ন্যায়বিচারের অন্বেষণে

লেখক: মো. সাইফুল ইসলাম, বিচারক (যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ), বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস।

প্রকাশক: লেক্সিলেন্স

পাওয়া যাচ্ছে অমর একুশে বইমেলার ২৩৭ নং স্টলে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে