মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪, ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

মহাকালের কবি শঙ্খ ঘোষ

রনি অধিকারী
  ২৩ এপ্রিল ২০২১, ০০:০০
মহাকালের কবি শঙ্খ ঘোষ

শঙ্খ ঘোষ (১৯৩২-২০২১)। একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বাঙালি কবি ও সাহিত্য সমালোচক। তিনি একজন বিশিষ্ট রবীন্দ্র বিশেষজ্ঞ। তার প্রকৃত নাম চিত্তপ্রিয় ঘোষ। তার পিতা মনীন্দ্রকুমার ঘোষ এবং মাতা অমলা ঘোষ। ১৯৩২ সালে ৫ ফেব্রম্নয়ারি জন্মগ্রহণ করেন। মৃতু্য : ২১ এপ্রিল, ২০২১ কলকাতা। বংশানুক্রমিকভাবে পৈত্রিক বাড়ি বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বানারিপাড়া গ্রামে। শঙ্খ ঘোষ বড় হয়েছেন পাবনায়। পিতার কর্মস্থল হওয়ায় তিনি বেশ কয়েক বছর পাবনায় অবস্থান করেন এবং সেখানকার চন্দ্রপ্রভা বিদ্যাপীঠ থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। ১৯৫১ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বাংলায় কলা বিভাগে স্নাতক এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।

কর্মজীবনে তিনি বঙ্গবাসী কলেজ, সিটি কলেজ, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়, দিলিস্ন বিশ্ববিদ্যালয়, শিমলাতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্স স্টাডিজ ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়সহ বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাংলাসাহিত্যে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৯২ সালে অবসর নেন।

বাবরের প্রার্থনা কাব্যগ্রন্থটির জন্য তিনি ভারতের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার সাহিত্য অ্যাকাদেমি পুরস্কার লাভ করেন। ২০১৬ সালে লাভ করেন ভারতের সর্বোচ্চ সাহিত্য সম্মাননা, জ্ঞানপীঠ পুরস্কার। তার উলেস্নখযোগ্য গ্রন্থগুলি হলো- মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে, এ আমির আবরণ, উর্বশীর হাসি, ওকাম্পোর রবীন্দ্রনাথ ইত্যাদি।

১৯৬০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে আইওয়া রাইটার্স ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করেন। পুরস্কার : ১৯৭৭ সালে 'মূর্খ বড়, সামাজিক নয়' নরসিংহ দাস পুরস্কার, ১৯৭৭ সালে 'বাবরের প্রার্থনা'র জন্য সাহিত্য অ্যাকাদেমি পুরস্কার, ১৯৮৯ সালে 'ধুম লেগেছে হৃদকমলে' রবীন্দ্র পুরস্কার, সরস্বতী পুরস্কার, 'গন্ধর্ব কবিতাগুচ্ছ', ১৯৯৯ সালে 'রক্তকল্যাণ' অনুবাদের জন্য সাহিত্য একাদেমি পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে বিশ্বভারতীর দ্বারা দেশিকোত্তম পুরস্কার, ২০১১ সালে ভারত সরকারের পদ্মভূষণ পুরস্কার, ২০১৬ সালে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার।

দেশে দেশে কালে কালে 'প্রবাহিত মনুষ্যত্ব'র প্রতি কবি শঙ্খ ঘোষের অটুট ভালোবাসা একটা মমতাময় ধমনি রেখে দেয় তার কবিতার অন্তরালে। তখন, এরকমই অভিমান আর ক্রোধে মিশে গিয়ে তৈরি হয়ে ওঠে তার ছোটো একেকটি কবিতা।

নাচো হার্লেমের কন্যা, নরকের উর্বশী আমার বিস্ফারিত স্তনচূড়া, নগ্ন উরু, লিতবসনা

মাতলামোর সভা আনো, চার দিকের নিরানন্দ হতাশায়, হীন অপমানে,

নাচো ঘৃণ্য নিগ্রো, নাম মুছে দিতে মাতলামোর জাত নেই,

পৃথিবীর সব বেশ্যা সমান রূপসি।

নাচো রে রঙ্গিলা, রক্তে এক করতে স্বর্গ ও হার্লেম।

যেমন আমাদের অভিজ্ঞতারও আছে দিন আর রাত্রি, যেমন দিনের অনেক রৌরব, আমরা মুছে নিই রাত্রিবেলার নির্জন আত্মক্ষালনে, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের পরিণত কবিতাতেও তেমনি আমরা দেখতে পাব সেই দুই ছায়াপাত। সামাজিক যে কোনো ঢেউয়ের আঘাতে কেঁপে ওঠেন এই কবি, বিবেচনার কোনো সময় পাওয়ার আগেই ঝাঁপ দিয়ে পড়েন স্রোতে, ভেঙে ফেলতে চান সব ব্যক্তি, সমাজ, প্রতিষ্ঠান কারোই মুক্তি নেই তার সর্বনাশা রোষ থেকে। কিন্তু এসব ভয়ংকর মুহূর্তেও তিনি হঠাৎ এক-একবার এসে দাঁড়াতে পারেন সেই ঘুমন্ত সীমায়-

ভুবনেশ্বরী যখন শরীর থেকে/একে একে তার রূপের অলঙ্কার

খুলে ফেলে, আর গভীর রাত্রি নামে/তিন ভুবনকে ঢেকে।

এই হলো তার কবিতার রাত্রি, এটিই তার কবিতার আত্মস্থ অবকাশ, এখানে তার কবিতার পলিমাটি। এই পলি আছে বলেই তার ওপর জেগে ওঠা সমস্ত দিনের শস্য একটা স্বতন্ত্র আলো পেয়ে যায়, হয়ে ওঠে সমকালীন অন্যান্য এক বিক্ষোভের চেয়ে অনেক স্বতন্ত্র। তারও আছে চিৎকার, কিন্তু অনায়াস সত্য থেকে উঠে আসে বলে তার সেই চিৎকারে প্রায়ই লিপ্ত থাকে একটা মন্ত্রের স্বাদ।

অন্ন বাক্য অন্ন প্রাণ অন্নই চেতনা/অন্ন ধ্বনি অন্ন মন্ত্র অন্ন আরাধনা

অন্ন চিন্তা অন্ন গান অন্নই কবিতা,/অন্ন অগ্নি বায়ু জল নক্ষত্র সবিতা।

অন্ন আলো অন্ন জ্যোতি সর্বধর্মসার/অন্ন আদি অন্ন অন্ত অন্নই ওংকার

সে অন্নে যে বিষ দেয়, কিংবা তাকে কাড়ে/ধ্বংস করো, ধ্বংস করো, ধ্বংস করো তারে।'

এই কবিতা একটা সমগ্র বিশ্বের জাতীয় স্স্নোগান হয়ে উঠবার যোগ্য। তার কবিতা অসমান, অনেক সময়েই তার কবিতা বরং তুলে নিয়ে আসে ঈষৎ ভাঙা চলন, যার ছন্দে ছবিতে শব্দের ব্যবহারে হঠাৎ কখনো মনে হতে পারে যে অশুদ্ধ হলো সুর। কিন্তু সেটাই যেন তার আনন্দ, যেন কিউবার কবি নিকোলাস গ্যিয়েনের মতো তিনিও আজ বলে উঠতে পারেন নিজেকে অশুচি বলেই ঘোষণা করছি আমি। এই কবিও একদিন 'নিজের মধ্যে নিহিত থেকে অর্কেস্ট্রা বাজানোর ভঙ্গি জানছিলেন, যুক্ত ছিলেন তার ভাষার মডার্নিজমের আন্দোলনে আর তার থেকে আজ বেরিয়ে এসে এখন তিনি চার পাশে দেখতে পান এক বিশাল চিড়িয়াখানা। কবি শঙ্খ ঘোষের কবিতা পড়লে পাঠকের মনে হতে পারে যেন তিনি হেঁটে চলেছেন ধান কেটে নেওয়া কোনো জমির ওপর দিয়ে; থেকে-থেকে কাঁটাবিঁধে পায়ে, পিঠে এসে লাগে রোদ্দুরের ফলা, সেখানে নেই কোনো সমতল মসৃণতা বা শিল্পসুষমার কোনো সচেতন আয়োজন। এর অন্তর্গত কবিতাগুলো পড়তে পড়তে পাঠক কেবলই ঘূর্ণির মতো ঘুরতে থাকবেন এই পাঁচ-দশ বছরের কলকাতার গস্নানিময় ইতিবৃত্তে, সমস্ত ভারতবর্ষের নিরন্তন পচন-লাঞ্ছনায়। আর সেই পটভূমি মনে রাখলে এই অসমান ঊষর আঘাতময় শিল্প ধরনকে মনে হয় অনিবার্য, অনিবার্য মনে হয় এর আপাত শিল্পহীনতা। আপাত, কিন্তু সম্পূর্ণত নয়, কেননা, অনেক দিনের কাব্যময়তাকে যিনি রেখে দিয়েছেন তার ভেতরে, আজ এই স্পষ্ট ভর্ৎসনার উচ্চারণের সময়েও তার ভাষা হয়ে ওঠে এরকম 'আকাশের দিকে আমি উল্টো করে ছুড়ে দিই কাঁচের গেলাস' অথবা 'ব্রাহ্মমুহূর্তে কারা ছায়ার মতো ছেড়ে গেছে ঘর' কিংবা 'কলকাতার ফুটপাথে রাত কাটায় এক লাখ উন্মাদ হ্যামলেট/তাদের জননী জন্মভূমি এক উলঙ্গ পশুর সঙ্গে করে সহবাস' আর 'আমাদের সন্তানের মুন্ডহীন ধড়গুলি তোমার কল্যাণে ঘোর লোহিত পাহাড়।' তখন বুঝতে পারি কবির যোগ্য সমস্ত ইন্দ্রিয় তার ভেতরে কাজ করে যায় কী রকম সন্তর্পণে, বুঝতে পারি কোথায় আছে পুরানো সেই কবির সঙ্গে আজকের কবির নিবিড় কোনো যোগ।

সত্তরের উত্তাল সময়ের দিনগুলোতেও বুদ্ধিজীবী মহল ঠিক আজকের মতোই ক্ষমতার গা ছুঁয়ে নিজেকে সুরক্ষিত রাখতেই ব্যস্ত ছিল। সব রকমের রাজনৈতিক ধান্দাবাজির সঙ্গে নিজেদের নৈতিকতাকে ঠিকঠাক টিউনিং করিয়ে নেওয়ার বিষয়ে কেই বা পিছিয়ে ছিল কতটুকু? গুটিকয়েক ব্যতিক্রমী মানুষ ছাড়া? তাই আজ যখন বেআব্রম্ন বুদ্ধিজীবীদের নির্ভেজাল মুখচ্ছবিগুলো সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে একেকটি ঘটনার অভিঘাতে সময়ের প্রতিবিম্বে, তখন বিস্মিত হওয়ারও কোনো উপায় অবিশিষ্ট থাকে না আর। এটাই তাদের আসল মুখচ্ছবি। এটাই তাদের ডিএনএ। কেবলই নিজের অবস্থানটুকু পাকা করে নেওয়ারই ধান্দা। সেই ধান্দায় আর কাউকে চেনার দরকারই বা কি? দায়ই বা কার? সরকারি খেতাবের মোহ, সরকারি অনুদানের ভাগ পাওয়ার লোভ, এদের খর্ব করে রাখে। যে যার শিরদাঁড়া বন্ধক রেখেই স্তবকতার প্রতিযোগিতায় পরস্পর গুঁতোগুঁতি করে ক্ষমতার নেক নজরে থাকাতে চায়। জীবনানন্দের ভাষায়, 'কেবলই আসন থেকে বড়ো নবতর সিংহাসনে যাওয়া ছাড়া গতি নেই কোনো'। সেই গতির অভিমুখেই পড়েছিল পরিবর্তন চাইয়ের সেই গগন বিদারী পোস্টার। পড়েছিল আমাদেরই বেকুব বানানোর পরিকল্পনায়। স্বভাবতই ইতিহাস বিস্মৃত জাতি হিসেবে আমরা চোখের দেখাটুকুকেই অন্ধ বিশ্বাসে ভরসা করে ফেলে ছিলাম। আমরা চোখবুঁজেই দেখেছিলাম।

\হচোখ তো আমাদের বন্ধই ছিল। ছিল বলেই, কবি শঙ্খ ঘোষ লিখেছেন, 'দেখ খুলে তোর তিন নয়ন'। দুচোখের সাধ্যেও না হলে বিবেক নৈতিকতার দৃষ্টিকেও খোলাতে হবে। নয়তো কত ধানে কত চাল বোঝা যাবেই বা কি করে। কিন্তু মুশকিল হলো, আমাদের চোখের উপরেই যারা অধিকারের ঠিকা নিয়ে নিয়েছে, পরিবর্তনের রায়কে হাতিয়ার করে; তারাও তো আর চুপচাপ বসে বসে দেখতে থাকবে না ঘটনার গতি প্রকৃতির জল মাপতে মাপতে। তাই তাদেরও ভাতঘুম ছুটে গিয়েছে। শুরু হয়ে গিয়েছে হম্বিতম্বি। তর্জন গর্জন। এই কোলাহল যতটা না কবির জন্য, তার থেকে অনেক বেশি করেই আমাদের মতো সাধারণ জনসাধারণের জন্যই। এক আধজন কবি কী দেখলেন, সেটা তত বড়ো কথা নয়, ক্ষমতার অধিষ্ঠানকে কুক্ষিগত করে রাখতে চাওয়ার শক্তিগুলোর কাছে। অনেক বড়ো হলো তিনি কি দেখাতে চাইলেন। কাদের দেখাতে চাইলেন, সেটাই। কারা সব দেখে ফেললে আখেরে আম ও বস্তা দুইই খোয়ানোর ষোলআনা সম্ভাবনা, সেটাই। এইটাই এত হম্বিতম্বির আসল রহস্য। তাই খুব সঠিক অর্থেই গর্জন শোনা গিয়েছে, এ কোন শঙ্খ ঘোষ উঠে এলো বলে। কোন এক শঙ্খ ঘোষের উঠে আসাটাও বড়ো কথা নয়। বড়ো কথা পেটেন্ট নেওয়া উন্নয়নের ওপর কথা বলার স্পর্ধিত উচ্চারণটাই। যেখানে উন্নয়ন ও তার প্রচারই শেষ সত্য। তার উপরে থাকতে পারে না কোনো উচ্চারণই। কবি সেখানে গৌণ। আরও গৌণ সেই কোনো এক শঙ্খ ঘোষ। কারণ তারা তো চিরকালই একা। একলাসেরে। ভয় তাই তাদেরকে নিয়ে নয়। ভয় জনমতকেই। আর সেই জনমতকেই ক্রমাগত ধারাবাহিক ভাবে বিভ্রান্ত করে রাখার উদ্দেশ্যেই দেশের বুদ্ধিজীবীদের এতটাই প্রয়োজন ক্ষমতার ভরকেন্দ্রে থাকা বা থাকতে চাওয়া শক্তিগুলোর কাছে। এত সরকারি খেতাবের মহোৎসব, এত সরকারি অনুদানের, এত উপঢৌকেনের ছড়াছড়ি কোনো কিছুই এমনি এমনি তো নয়। জনগণের টাকাতেই জনগণকে বিভ্রান্ত করে রাখার প্রকল্পে ব্যয় অকাতরে। ফলে বুদ্ধিজীবীদের চিরকালই পৌষমাস। রাজা আসে রাজা যায়, বুদ্ধিজীবীদের পৌষমাস চলতেই থাকে চলতেই থাকে। আবার সেই পৌষ মাসের ওপরেই নির্ভর করে কতটা মসৃণভাবে চলতে থাকবে রাজনৈতিক ক্ষমতার জয়রথ। সেই জয়রথের দুর্বার গতিকেই থমকে দিতে পারে এমন কোনো কার্যক্রমই অনুমোদন যোগ্য নয়। নয় বলেই বুদ্ধিজীবীদের ওপরেও অলিখিত নির্দেশ বর্তায়, জনগণকে বিভ্রান্ত করার। শঙ্খ ঘোষেদেরও তখন একলা একা চলতেই হয়। আশপাশের ভিড়গুলোও ক্রমশ পাতলা হতে হতে একসময় হারিয়ে যায়। যেতে থাকে। এটাই রাজনীতি। এটাই বুদ্ধিজীবী সংস্কৃতি। এই বাংলায়।

মূলধারার বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের এই সংস্কৃতি আদৌ জনবিচ্ছিন্নও নয়। অর্থাৎ বাঙালির জাতিগত চরিত্রের বিপরীত কোনো ধরন নয়। বরং আমাদের জাতীয় চরিত্রেরই পরিমার্জিত এক্সেটেনশন বলা যেতে পারে। হয়তো এর পেছনে নৃতাত্বিক কোনো কারণও থাকতে পারে। সেটা বিশেষজ্ঞদের পর্যালোচনার বিষয়। আমাদের প্রচলিত প্রবাদেই আছে, শক্তের ভক্ত নরমের যম। কথাটা আদৌ কথার কথাও নয়। সত্যই আমাদের জাতিগত প্রকৃতিই হলো শক্তের ভক্ত হয়ে ওঠা। শক্তির ক্ষমতার ভরকেন্দ্রের কাছে নিজেকে অতি সহজেই নত করার এই প্রবৃত্তি ও প্রকৃতির কারণেই বাঙালি বহুবার বিদেশি শক্তির পদানত হয়েছে। এটাই বাঙালির ধর্ম। স্বভাবতই ক্ষমতার কাছে নতি স্বীকারের পেছনে সহজে নানান রকমের নৈতিক অনৈতিক সুযোগ-সুবিধা অর্জনের ধান্দা থাকাই স্বাভাবিক। অন্তত মূলধারার বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের জীবন ও প্রকৃতি, কর্ম ও ধর্ম ঠিকমত পর্যালোচনা করলে সেই সত্যই উঠে আসে না কি? এই প্রবণতা সাধারণ বাঙালির রয়েছে। আমাদের ব্যক্তিগত জীবন প্রণালির পরতে পরতেই এই ধান্দাবাজির সূত্রগুলো সুপ্ত থাকে। সুযোগ-সুবিধা মতো সেগুলো মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এবং ওঠার এই বিষয়টিও, মূলধারার বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের সময়জ্ঞানের মতোই ঠিকঠাক ঘটে থাকে অধিকাংশ সময়েই। সেই ঘটার মধ্যেই আমদের ব্যক্তিজীবনের সাফল্য নির্ভর করে অধিকাংশ সময়েই। কখন শীতঘুম দেব। আর কখন জেগে উঠব। কিন্তু এসবে কিছুই আসে যায় না কবি শঙ্খ ঘোষদের। তারা নিজের নিজের সীমিত সাধ্যের মধ্যে দিয়েই চিরকালই অসাধ্যকে সাধন করার সাধনায় অক্লান্ত। সেখানেই তাদের জীবনবোধের ভরকেন্দ্র। যে আলো হাতে সীমাহীন অন্ধকারের বুকচিরে সত্যকে তুলে আনেন তারা নিজেদের অনন্যতায়, মহাকালে নির্ধারিত হয় তার আসল মূল্য। সেখানেই ভবিষ্যতের প্রজন্ম তাদের সঠিক আসনেই খুঁজে পায়। যে আসনের নাগাল পায় না কোনো যুগেরই মূলধারার বুদ্ধিজীবী কুল। এইভাবেই নির্ধারিত হয় মহতের আসল পরিচয়। এভাবেই ধরা পড়ে যায় ক্ষুদ্রের সব দুর্বলতা। যেখানে কোনো রাজনৈতিক ক্ষমতারই আর খবরদারি চলে না। সত্যকে নিজেদের স্বার্থে দুমড়ে মুচড়ে নেওয়ার। এই কারণেই বলে বিদ্যান সর্বত্র পুজ্যতে। কিন্তু রাজার পুজো তার চামচাদের কাছেই। আজকে যারা কোন শঙ্খ ঘোষ বলে চোখ পাকিয়ে হুঙ্কার দিচ্ছেন, আর যারা সেই হুঙ্কারেও নিজেদের শীতঘুমের কোনো রকম ব্যাঘাত ঘটাচ্ছেন না, এই দুই পক্ষই মহাকালের নিয়মে অতিদ্রম্নত অতীত হয়ে যাবেন। মিলিয়ে যাবেন ঘটমান বর্তমান থেকেই। কিন্তু ভবিষ্যৎ এসে বাঁচিয়ে রাখবে শুধুমাত্র সেই শঙ্খ ঘোষদেরই, যারা সময় মতো নিঃশঙ্কায় নির্দ্বিধায় নিঃসঙ্কোচে সময়মতো উচ্চারণ করতে পারেন, 'রাজা তোর কাপড় কোথায়?'

মূলধারার বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের শীতঘুম দেখে, বিস্ময়েরও কিছু নেই। হা হুতাশ করারও কিছু নেই। কারণ বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য, প্রকৃতিগত নয়। বিদ্যাবুদ্ধিজনিত কলানৈপুণ্যগত মাত্র। পরিবর্তনের ভরা সেই মুখচ্ছবিগুলো যেমন ক্ষমতা বদলের পদধ্বনি শুনতে পেয়েছিলেন সময়মতো, সময়মতোই শীতঘুম থেকে গা ঝাড়া দিয়ে উঠে একটি হাত ছেড়ে দিয়ে আরেকটি হাত ধরে ফেলেছিলেন অতি সূক্ষ্ণভাবে; ঠিক তেমনই একবার নতুনতর হাতের নাগাল পেয়ে গেলেই আবারও তাদের শীতঘুম ভেঙে যাবে। যাবেই এবং সময়মতোই। হঁ্যা সেদিনই তারা সেই কোনো এক শঙ্খ ঘোষের পাশে এসেই আবারও ভিড় বাড়াবেন। বাড়াবেন সেই জনগণকেই নতুন দিশায় বিভ্রান্ত করতে। ঠিক যেমনটি সেকালের নিয়মে করেছিলেন এক মীরজাফর। পলাশীর প্রান্তরে। সিরাজের হাত ছেড়ে বিদেশি বণিকের হাত ধরার তাগিদে। কেননা, দিন বদলের গন্ধ এরাই আগে পান। সেখানেই এদের আসল বৈশিষ্ট।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে