শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

শহীদুল জহিরের প্রথম উপন্যাস জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা

আশরাফ আহমেদ
  ২২ জুলাই ২০২২, ০০:০০

আধুনিক বাংলা সাহিত্যে জাদু বাস্তবতার স্বাতন্ত্র্য চর্চার জন্য সুপরিচিত কথাশিল্পী শহীদুল জহির। নিত্যনতুন ভাষাবিন্যাস এবং রীতি-ব্যবহারে গল্প বলার কৌশলের মধ্য দিয়ে বাংলা সাহিত্যে তিনি স্বতন্ত্র অবস্থান তৈরি করেছেন। অনতি দীর্ঘ ৫৪ বছরের জীবনে তিনি বাংলা সাহিত্যে বেশ কিছু অতুলনীয় উপন্যাস ও গল্প সংযোজন করেছেন। 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা' শহীদুল জহিরের প্রথম উপন্যাস। গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৮৮ সালে। এই উপন্যাসটির মাধ্যমেই মূলত শহীদুল জহির সাহিত্য জগতে তার আগমনী বার্তা জানান দেন। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি যোগ করেছেন স্বতন্ত্র রীতি-পদ্ধতি, যা 'শহীদুল জহিরীয়' ধারা নামে পরিচিত। সেই স্বতন্ত্র কথাসাহিত্য রীতির অনন্য এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারী উপন্যাস 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা'।

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত এটি একটি নাতিদীর্ঘ উপন্যাস। পুরো লেখার ভাঁজে ভাঁজে একাত্তর পূর্ববর্তী বাংলাদেশ থেকে শুরু করে যুদ্ধকালীন এবং পরবর্তী সময়ে স্বৈরাচারের শাসনগ্রহণ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘাত-প্রতিঘাতের চিত্র ফুটে উঠেছে। সেই সঙ্গে ফুটে উঠেছে জীবনের বাস্তবতা, মুক্তিযুদ্ধের কথা ও মানবমনের অন্তর্দাহের কথা।

গ্রন্থটিতে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে বর্ণনা করা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন পাকিস্তানি হানাদারদের তান্ডবলীলার কাহিনি ও সাধারণ বাঙালিদের জাতীয়তাবাদী চেতনার কথা। ক্ষমতার লোভে কিছু পথভ্রষ্ট বাঙালির মানসিকতা কতটা বিকৃত হতে পারে সেটিও তিনি এই উপন্যাসে তুলে ধরেছেন।

উপন্যাসের নায়ক কিংবা মূল চরিত্র হলো আবদুল মজিদ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনায় বিশ্বাসী এক বাঙালি তরুণ। আরেকটি চরিত্র বদু মাওলানা। যে ছিল তৎকালীন সময়ের এক ঘৃণ্য রাজাকার। পুরুষ হত্যা আর নারী ধর্ষণে সে ছিল পাকিস্তানি মিলিটারিদের সহযোগী। গ্রামে মানুষের লাশ আর নারীদের ধর্ষণ দেখে যার হৃদয় এতটুকুও কাঁপেনি। মিষ্টি হাসির অন্তরালে, ধর্মের দোহাই দিয়ে সে এসব নোংরা কাজ ও অপকর্ম করত। মজিদের বোনও ছিল ধর্ষিতাদের মধ্যে একজন। বোনকে হাজারো চেষ্টা করে পাকিস্তানি পশুদের হাত থেকে বাঁচাতে পারেনি সে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ সময়ে পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে বদু মাওলানা পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। এরপর সাধারণ ক্ষমার সুযোগ গ্রহণ করে সে স্বাধীনতার মাত্র বছর দুয়েক পরই দেশে ফিরে আসে।

মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দলের স্থানীয় নেতা ছিলেন আবদুল আজিজ। যুদ্ধের সময় যার বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছিল রাজাকার বদু মাওলানা। সেই আজিজই বদু মাওলানা ফিরে আসার পর মজিদের কাঁধে হাত রেখে বলে, রাজনীতি করতে হলে অতীতের অনেক কিছু ভুলে যেতে হয়। লোমহর্ষক স্মৃতির কথা জলাঞ্জলি দিয়ে কীভাবে শুধু ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য দুই মেরুর দুটি লোক আবার একত্রে মিশে যেতে পারে- এটা ভেবে মজিদের বিশ্বাসের স্তম্ভ ভেঙে গুঁড়িয়ে যায়। এসব নৃশংস ঘটনাই মজিদের মর্মপীড়ার কারণ। মাত্র ১৫ বছরের ব্যবধানে এসব নির্মম কাহিনি যা অনেকেই ভুলতে বসলেও মজিদের মতো কিছু বাঙালি আজও ভুলতে পারেনি।

'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা' বইটিতে লেখক বদু মাওলানা চরিত্রকে দিয়ে একাত্তরের রাজাকারদের অমানবিকতার চিত্র তুলে ধরেছেন। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক বেশিরভাগ গল্প-উপন্যাসে কেবল মুক্তিযুদ্ধকালীন করুণ কাহিনির কথা বর্ণনা করা হয়। কিন্তু শহীদুল জহির এ উপন্যাসে মুক্তিযুদ্ধ ও তৎপরবর্তী সময়ের তান্ডবলীলার বাস্তবচিত্রগুলোও ফুটিয়ে তুলেছেন। 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা' মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার এক বাস্তব দলিল।

বাঙালি মুক্তিযুদ্ধ করেছিল, বর্তমানে যারা বাংলাদেশের বাসিন্দা তাদের কেউ কেউ মুক্তিযুদ্ধ দেখেছেন, কেউ কেউ দেখেননি। মানুষ-সমাজ-দেশ স্বাধীনতার ধারাবাহিকতায় এগিয়ে গেছে, পরিবর্তিত হয়ে গেছে অনেক কিছু- আমাদের জীবন এবং জীবনের আকাঙ্ক্ষা, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিন্যাস। আমরা ব্যস্ত হয়েছি, আমরা ব্যস্ত থেকেছি বর্তমান নিয়ে, ভবিষ্যৎ চিন্তায় মুক্তিযুদ্ধের ঘটনা সরে গেছে দূরে।

\হশহীদুল জহির- বাংলা সাহিত্যের এই জাদুকরের নাম আমার কাছে নবতম প্রেমের সমার্থক হয়ে ওঠে যেদিন ই-বই এ, কম্পিউটারের পর্দায় 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা'র প্রথম বাক্যটি দৃষ্টিগোচর হয়- '১৯৮৫ সালে একদিন লক্ষ্ণীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের যুবক আবদুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেল পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে ফট করে ছিঁড়ে যায়।' এই লাইনটির মধ্যে প্রথমেই যা নজরে পড়ে, বা বলা যায় এক ধাক্কায় যে ভঙ্গিমাটি এটি তৈরি করে নিতে সক্ষম হয়, তা একটি নির্দিষ্ট গদ্যরীতি, যার সঙ্গে প্রবন্ধের বাক্যগঠনে 'সেদিন সাতটি লাশ নিয়ে লক্ষ্ণীবাজারের জনতা নির্বাক হয়ে বসেছিল; লক্ষ্ণীবাজারের রাস্তা মৃতের মতো নিঃশব্দ ছিল, রাস্তায় একটি কুকুর ছিল না, আকাশে একটি পেঁচা উড়ে আসে নাই, বাতাসে ডানার শব্দ করে। তাদের মনে হয়েছিল, তারা সৃষ্টির আদি থেকে কোনো শব্দ শোনে নাই' এটা কি উপন্যাস ছিল? নাকি কোনো কাব্যগ্রন্থ? তবে উপন্যাসের চেয়ে কাব্যগ্রন্থ বেশি মনে হয়েছে আমার।

কারণ লেখার ধরনই ছিল এমন! বইটা পড়া শেষ করে ব্যালকনিতে বসে চা খেতে খেতে, বইটির ভালো লাগা অংশগুলো পড়তে পড়তে এসব ভাবছিলাম। উপন্যাসের প্রথম লাইনটিই যেন আমার পাঠকসত্তাকে নতুন করে জাগিয়ে তুলেছে!

শহীদুল জহির পাঠ করলাম এই প্রথমবার; এবং আমি মুগ্ধ, অভিভূত!

মূলত বইপত্র পড়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আবেগকে পুরোপুরি বুঝতে পারা আমার পক্ষে যেমন কোনোদিনই সম্ভব হবে না, ঠিক তেমনি মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগ ও তিতিক্ষার মহিমাকে বাংলাদেশের জনসাধারণ যদি ধীরে ধীরে ভুলে যেতে থাকে, কিংবা মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত গুরুত্ব যদি বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে ক্রমশ স্তিমিত হতে থাকে, তাহলে সেই বিস্মৃতি যে আসলে কতটা মর্মান্তিক, সেটাও আমার পক্ষে অনুধাবন করা কোনোদিনই পুরোপুরি সম্ভব হবে না।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাসাহিত্যে অনেক উপন্যাস রচিত হয়েছে, একাত্তরের রণাঙ্গনের সাহসিকতা, পাকিস্তানিদের বর্বরতা, সাহসী যোদ্ধাদের অপরিসীম ত্যাগ, যুদ্ধের বিভৎসতা, বিপর্যস্ত মানবতা সবকিছুর নিখুঁত ছবি আঁকতে চেয়েছেন লেখকরা, যার অনেকই বেশ সফল। শহীদুল জহিরের 'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা' সেই বর্ণনাময় মুক্তিযুদ্ধের উপন্যাস নয়। যেখানে সাহসী কোনো বীরের গল্প নেই, ৯ মাসের রণাঙ্গনের যুদ্ধের বর্ণনা নেই। তবু উপন্যাসটি হয়ে ওঠেছে মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতায় দেখা বর্তমান বিশ্লেষণ আর তার মনস্তাত্ত্বিক উপাখ্যান।

কাফকা'র গল্প নিয়ে একটা কথা প্রচলিত যে, তার অনেক গল্পের প্রথম লাইন পড়েই মানুষ চমকে উঠতে পারে। আমার মনে হতো, এটা বাগাড়ম্বর। প্রথম লাইন দিয়ে কিছু বিচার করা চলে না। কিন্তু জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা এমন এক উপন্যাস- যার প্রথম লাইনে ভাষা-শৈলীর যে চমক তাতে নড়েচড়ে বসতে হয়, আর সেটা বজায় থাকে শেষতক! বইটা পড়তে পড়তে শামসুর রাহমানের কবিতাটার কথাই মনে হচ্ছিল। 'রাজনীতিতে চিরদিনের বন্ধু অথবা চিরদিনের শত্রম্ন বলে কিছু নেই।'

'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা' বইটার টপিক খুব জটিল, মুক্তিযুদ্ধকালীন এক রাজাকারের পুনরায় দেশের রাজনীতিতে জাঁকিয়ে বসার গল্প এটি। বুঝতেই পারছেন এই বিষয়ে লেখা মোটেও সহজ নয়। আপনি যদি প্রথাগত কোনো স্টাইলে এই বিষয়ে কোনো উপন্যাস লিখতে চান, তাহলে তা অখাদ্য-কুখাদ্য হওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। আর এখানেই আমি অবাক হয়েছি। এত কঠিন একটা বিষয়কে এরকম সহজ ভাষায় লেখা সম্ভব হলো কী করে? বইটা পড়ার সময় রাজাকারদের অত্যাচারের কাহিনি পড়ে যারপরনাই রাগ উঠবে।

এই মুহূর্তে আমার সবচেয়ে এটি প্রিয় বই বলা চলে। শহীদুল জহির হচ্ছেন শহীদুল জহির। তার সঙ্গে আর কারও তুলনা চলে না। তার পথে সে একাই। সে পথে নেই কারও চলার অধিকার অর্জনের ক্ষমতাও। বইটা এক কথায় অসাধারণ একটা বই কিংবা হতে পারত খুব সাধারণ।

সময় ও বাস্তবতা অনেক সময় আমাদের অনেক কিছু ভুলে যেতে দেয় কিংবা ভুলে যেতে বাধ্য করে; কিন্তু চাইলেও কি আমরা সবটাই ভুলতে পারি? একাত্তরের মাত্র এক দশক পরেই স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সময় যখন আমরা বিপরীত মেরুর দুই রাজনৈতিক দলের এক হয়ে যাওয়া দেখি, তখন আমরা বুঝতে পারি যে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সত্যও আসলে পরিবর্তিত হয়- 'রাজনীতিতে চিরদিনের বন্ধু অথবা চিরদিনের শত্রম্ন বলে কিছু তো নেই, কাজেই অতীত ভুলে যাওয়া ছাড়া আর কিই-বা করার থাকে মানুষের।'

১৯৮৫ সালের কোনো এক দিনে লক্ষ্ণীবাজারের আবদুল মজিদের জুতা ছিঁড়ে যায়। সেই ছেঁড়া জুতা হাতে নিয়ে মজিদ দেখতে পায় আবুল খায়ের জনগণকে ধন্যবাদ দিচ্ছে। কেন দিচ্ছে ধন্যবাদ বদু মওলানার পুত্র? সে কথা শুনে বোঝে, জনগণ নাকি খায়েরদের দলের হরতাল কর্মসূচি সফল করেছে- এ কথা শুনে আবদুল মজিদের মনে পড়ে যায় খায়েরের পিতা বদু মাওলানার কথা, একাত্তরের কথা। একাত্তরে বদু মাওলানা গড়ে তোলে ছয় সদস্যের রাজাকারবাহিনী। (না) পাকবাহিনী এলে বদু মাওলানার তোড়জোর বেড়ে যায়। নিজ এলাকা লক্ষ্ণীবাজারে সে খুন করে কিছু মানুষকে, নির্যাতনের গল্পটা মুক্তিযুদ্ধ নিয়া, আবার বছর পনেরো পরের একটা সময় নিয়াও। আবদুল মজিদের জুতা ছিঁড়ে গেলে গল্পটা শুরু হয়।

মুক্তিযুদ্ধের এক যুগেরও বেশি সময় পর, যখন দেশে সামরিক শাসন চলে, সেই সময়টায় কোনো এক রাজাকারের বাচ্চার চিৎকারে আবদুল মজিদ বিপন্ন বোধ করতে থাকলে আমরা গল্পের ভেতরে প্রবেশ করতে থাকি। যতটুকু গল্পে আছে, এর চেয়ে ভালোভাবে লেখা, উপস্থাপন করা সম্ভব কি-না জানি না। এত আবেগের একটা গল্পে এত সুন্দর করে হিউমার ঢুকিয়ে দিয়ে ৩৬ পৃষ্ঠার একটা মহাকাব্য বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই ধরনের নেরেটিভের সঙ্গে পরিচয় ছিল না, এজন্য ভালালাগাটা একটু বেশিই, একটু অন্যরকম। ...বুঝলাম কী সুন্দরভাবে হাসাতে হাসাতে কলিজার ভিতর দিয়ে তীর ঢুকায়ে দেওয়া যায়।

মুক্তিযুদ্ধ আমাদের জাতীয় জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। কিন্তু ৯ মাসের ওই যুদ্ধটাই কি মুক্তি নিশ্চিত করেছে? বা প্রশ্নটা একটু অন্যভাবে করে যদি বলি, যে স্বাধীনতা আমরা ৯ মাসে অর্জন করেছিলাম তা কি ধরে রাখতে পেরেছি? ব্যক্তিগত ও রাজনৈতিক জীবনে যে ঘাত-প্রতিঘাত এসেছিল তা কি সবাই ভুলে গিয়েছে? যদি না ভুলে গিয়ে থাকে তবে সেই ঘটনার স্মৃতি মানুষ বর্তমানে কিভাবে ব্যবহার করছে? এই প্রশ্নগুলো সামনে রেখেই স্বাধীনতার দেড় দশক পরে শহীদুল জহির রচনা করেছেন এই নাতিদীর্ঘ রাজনৈতিক বা মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাসটি।

শহীদুল জহিরকে শুধুমাত্র সাহিত্যিক বলতে আমি নারাজ। তার প্রত্যেকটি কাজ একেকটি বিমূর্ত শিল্পকর্ম। আপনি কখনো মাস্টারক্লাস কোনো পেইন্টিং কিংবা ভাস্কর্য দেখে থাকলে খেয়াল করবেন, ব্যাখ্যাতীত ওই শিল্পকর্মগুলোকে দেখে আপনার ভেতর কেমন একটা বোধের জন্ম হচ্ছে, যেটা অনেক চেষ্টা করার পরও আপনি বিশ্লেষণ করতে পারছেন না। কিন্তু এই বিশ্লেষণ না করতে পারার অপারগতায় আপনার বিন্দুমাত্র খারাপ লাগা কাজ করছে না; বরং মনে হচ্ছে এর বিমূর্ততাই এর সৌন্দর্যকে সূচকীয় হারে বাড়িয়ে দিচ্ছে। শহীদুল জহিরের লেখাও ঠিক তেমন।

মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা আমার পড়া এখন পর্যন্ত সবচেয়ে পরিপূর্ণ বই। গল্পটা ছোট একটা গ্রামের কয়েকজন গ্রামবাসীকে ঘিরে, কিন্তু এতটাই গভীর পড়ার পর আধাঘণ্টা ঝিম ধরে বসেছিলাম। কাহিনি নিয়ে কিছু বলতে চাচ্ছি না, যারা পড়তে চান, কাহিনি না জেনে পড়ে ফেলুন, সবকিছুই আছে এই গল্পে।

'জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা' শহিদুল জহিরের প্রথম উপন্যাস। উপন্যাসের শর্তমতে বইটিকে উপন্যাস না বলে উপন্যাসিকা বলা চলে। উপন্যাস বলি আর উপন্যাসিকা, বইটিতে তিনি গল্পশৈলির এমন সফল প্রয়োগ করেছেন যে, বইটি পড়ে অভিভূত না হয়ে উপায় থাকে না। উপন্যাসটির প্রথম লাইন পড়েই পাঠক একটি ঘোরের মধ্যে পড়ে যায়। শুরুটা হয় এভাবে- '১৯২৫ সালে এক দিন লক্ষ্ণীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের যুবক আব্দুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেল পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে ফট করে ছিঁড়ে যায়।

উপন্যাসের প্রথম লাইন দিয়ে যে পাঠককে চমকে দেওয়া যায় তার প্রথম উদাহরণ হিসেবে আমি সবসময় মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুলনাচের ইতিকথা বইটিকে সামনে নিয়ে আসি। হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা হারু ঘোষের দিকে আকাশের দেবতার কটাক্ষ দিয়ে শুরু হওয়া উপন্যাসটি পরে যত যাই বলে যাক না কেন, প্রথম লাইনের সেই হতভম্ব অবস্থার রেশ কাটে না কিছুতেই। বহুদিন পরে শহীদুল জহিরের জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা পড়তে শুরু করে আবার যেন সেই প্রথম লাইনের ধাক্কাটি খেলাম।

'১৯২৫ সালে একদিন লক্ষ্ণীবাজারের শ্যামাপ্রসাদ চৌধুরী লেনের যুবক আব্দুল মজিদের পায়ের স্যান্ডেল পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গতি বিধানে ব্যর্থ হয়ে ফট করে ছিঁড়ে যায়। আসলে বস্তুর প্রাণতত্ত্ব যদি বৈজ্ঞানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হতো তাহলে হয়তো বলা যেত যে, তার ডান পায়ে স্পঞ্জের স্যান্ডেলের ফিতে বস্তুর ব্যর্থতার জন্য নয়; বরং প্রাণের অন্তর্গত সেই কারণে ছিন্ন হয়, যে কারণে এর একটু পর আব্দুল মজিদের অস্তিত্ব পুনর্বার ভেঙে পড়তে চায়।'

এই দেশের রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মতোই আমাদের জীবনও চিরকাল অস্থিতিশীলভাবেই বয়ে চলেছে। প্রতিবারের কোন্দলে আমরা হারাই...প্রিয়জন হারাই, নিজেদের প্রয়োজনীয়তা হারাই? তারপর দোষীরা আশ্রয় নেয় চেতনার ছায়াতলে যা কি-না আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে? কিছুকাল পরে সবাই ভুলে যায় কিছু প্রাণ খোয়া গেছে? শুধু ক্ষত থেকে যায় যারা হারায় তাদের? তবুও আমরা কিছু করি না, প্রতিবাদ করি না? ক্ষতস্থানে ধুলো জমে জমে পুরনো হয়ে যায় ব্যথা... কালেভদ্রে মাথাচাড়া দেয় আর তখন আমরা পালিয়ে বেড়াই, জোর করে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে