শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

রবীন্দ্রনাথের ছোটগল্পে প্রকৃতি চিত্রণ

আ. শ. ম. বাবর আলী
  ০৫ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

রবীন্দ্রনাথের জন্ম ইট-কাঠ ঘেরা কলকাতা শহরে হলেও তার কর্মজীবনের বেশি সময় কেটেছে শহরের বাইরে পলস্নী প্রকৃতির অবগুণ্ঠন তলে। কলকাকলিমুখর পলস্নী বনানীর ছায়াতলে। অধিকতর সময় অতিবাহিত করেছেন কুষ্টিয়ার ছায়াঘেরা শিলাইদহ আর পাবনার শাজাদপুরে। বলা যেতে পারে, গ্রামবাংলার পলস্নী প্রকৃতির মাঝেই ছিল তার নিত্যদিনের জীবনযাপন। সে প্রকৃতি বনবনানী স্রোতমান নদীঘেরা। সে নদী প্রমত্ত পদ্মা, বসতি করেছেন পদ্মা উপকূলের কুঠিবাড়ীতে। বোটে সওয়ার হয়েছেন পদ্মা নদীর বুকে। এমনিভাবে মিশে একাত্ম হয়েছেন পলস্নী ও প্রকৃতির সঙ্গে। প্রকৃতির অণু-পরমাণুতে। আর তার প্রভাব পড়েছে তার সব লেখায়, বিশেষ করে তার অনন্য সৃষ্টি  ছোটগল্পে।

রবীন্দ্রনাথের লেখা বহুল আলোচিত একটি ছোটগল্প 'পোস্টমাস্টার'। এ গল্পে কলকাতা থেকে নতুন চাকরি নিয়ে নতুন পোস্টমাস্টার এসে যোগদান করলেন এক অজ পাড়াগাঁয়ে উলাপুরে। তখন বর্ষাকাল। গ্রাম্য প্রকৃতির নতুন সম্ভার। রবীন্দ্রনাথের লেখায় উলাপুরের সে প্রকৃতির বর্ণনা এ রকম-

'একদিন বর্ষাকালে মেঘমুক্ত দ্বিপ্রহরে ঈষৎ-তপ্ত সুকোমল বাতাস দিতেছিল; রৌদ্র ভিজা ঘাস এবং গাছপালা হইতে এক প্রকার গন্ধ উত্থিত হইতে ছিল, মনে হইতে ছিল, যেন ক্লান্ত ধরণির উষ্ণ নিঃশ্বাস গায়ের ওপরে আসিয়া লাগিতেছে এবং কোথাকার এক নাছোড়বান্দা পাখি তাহার একটা একটানা সুরের নালিশ সমস্ত দুপুরবেলা প্রকৃতি দরবারে অত্যন্ত করুণ স্বরে বারবার আবৃত্তি করিতেছিল... সেদিনকার বৃষ্টিধৌত মসৃণ চিক্কণ তরু পলস্নবের হিলেস্নাল এবং পরাভূত বর্ষার ভগ্নাবশিষ্ট রৌদ্রশুভ্র স্তূপাকার মেঘস্তর বাস্তবিকই দেখিবার বিষয় ছিল...'

এমনি আর এক বর্ষা প্রকৃতির চিত্র আছে 'খোকাবাবুর প্রত্যাবর্তন' গল্পে, যদিও সে চিত্র আর একটু অন্য রকমের। সে বর্ষকাল আনন্দের নয়, উদ্বেগের। প্রশান্ত পলস্নী-প্রতিমার নয়, প্রমত্ত পদ্মার। সে প্রকৃতির রূপ এমন-

'বর্ষাকাল আসিল। ক্ষুধিত পদ্মা উদ্যান গ্রাম শস্যক্ষেত্র এক এক গ্রাসে মুখে পুরিতে লাগিল। বালুকাচরের কাশবন এবং ঝাউবন জলে ডুবিয়া গেল। পাড় ভাঙার অবিশ্রাম ঝুপঝাপ শব্দ এবং জলের গর্জনে দশদিক মুখরিত হইয়া উঠিল, এবং দ্রম্নতবেগে ধাবমান ফেনারাশি নদীর তীব্র গতিকে প্রত্যক্ষগোচর করিয়া তুলিল।'

'ছুটি' গল্পে গ্রামবাংলার প্রকৃতিচিত্র-

'প্রকান্ড একটা ধাউস ঘুড়ি লইয়া বোঁ বোঁ শব্দে উড়াইয়া বেড়াইবার সেই মাঠ, 'তাইরে নাইরে নাইরে না' করিয়া উচ্চৈঃস্বরে স্বরচিত রাগিনী আলাপ করিয়া অকর্মণ্যভাবে ঘুরিয়া বেড়াইবার সেই নদী তীরে, দিনের মধ্যে যখন-তখন ঝাঁপ দিয়া পড়িয়া সাঁতার কাটিবার সেই সংকীর্ণ স্রোতস্বিনী, সেইসব দল-বল উপদ্রব স্বাধীনতা এবং সর্বোপরি সেই অত্যাচারিণী মা অহর্নিশ তাহার নিরুপায় চিত্তকে আকর্ষণ করিত।'

'অতিথি' গল্পের মূল চরিত্র তারাপদ। তারাপদ ভীষণ প্রকৃতি প্রেমিক। গ্রামবাংলার প্রকৃতির রূপ তাকে মোহিত করে। প্রকৃতির এক দুর্লভকালকে দেখে সে এমনিভাবে-

'বর্ষার নদী পরিপূর্ণতার শেষ রেখা পর্যন্ত ভরিয়া উঠিয়া আপন আত্মহারা উদ্দাম চাঞ্চল্য প্রকৃতি মাতাকে যেন উদ্বিঘ্ন করিয়া তুলিয়াছিল। মেঘ-নির্মুক্ত রৌদ্র নদী তীরের অর্ধ নিমগ্ন কাশ তৃণ শ্রেণি এবং তার ঊর্ধ্বে সরল সঘন ইক্ষুক্ষেত্র এবং তাহার পদ-প্রান্তে দূর-দিগন্তত্ম চুম্বিত নীলাঞ্জন বর্ণ বলরেখা সমস্তই যেন কোনো এক রূপকথার সোনারকাঠির স্পর্শে সদ্যোজাগ্রত নবীন সৌন্দর্যের মতো নির্বাক নীলাকাশের মুগ্ধ দৃষ্টির সম্মুখে পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছিল। ঢালু সবুজ মাঠ পস্নাবিত পাটের ক্ষেত, গাঢ় শ্যামল আমন ধানের আন্দোলন, ঘাট হইতে গ্রমাভিমুখী সংকীর্ণ পথ, ঘন বন বেষ্টিত ছায়াময় গ্রাম তাহার চোখের ওপর আসিয়া পড়িতে লাগিল। নদী তীরে বাছুর লেজ তুলিয়া ছুটিতেছে, গ্রামে টাট্টু ঘোড়া সম্মুখের দুই দড়ি বাঁধা পা লইয়া লাফ দিয়া ঘাস খাইয়া বেড়াইতেছে, মাছরাঙা জেলেদের জাল বাঁধিবার বংশদন্ডের উপর ঝপ্‌ করিয়া সবেগে জলের মধ্যে ঝাঁপাইয়া মাছ ধরিতেছে, ছেলেরা জলের মধ্যে পড়িয়া মাতামাতি করিতেছে, মেয়েরা উচ্চকণ্ঠে সহাস্য গল্প করিতে করিতে আবক্ষ জলে বসনাঞ্চল প্রসারিত করিয়া দুই হস্তে তাহা মার্জনা করিয়া লইতেছে, কোমর-বাঁধা মেছুনিরা চুপড়ি লইয়া জেলেদের নিকট হইতে মাছ কিনিতেছে।'

এ ধরনের গ্রাম্য প্রাকৃতিক বর্ণনা তার লেখা অনেক ছোটগল্পে আছে। রবীন্দ্রনাথ তার কলমের টানে গ্রামবাংলার যেন গোটা প্রকৃতিকে উপস্থাপিত করেছেন তার এসব গল্পে। সজীব প্রকৃতিকে আরও জীবন্ত করে হাজির করেছেন পাঠকের চোখের সামনে। এমনকি প্রাকৃতিক  গোপনে বিদ্যমান প্রাকৃতিক চিত্রকে দক্ষ শিল্পীর মতো জীবন্ত প্রকাশ ঘটিয়ে দেওয়ার কৃতিত্বকে অর্জন করে নিয়েছেন তিনি বাংলার প্রকৃতির প্রতি আপন অপাত্য ভালোবাসার আত্মগুণে।

এক্ষেত্রে একটা বিষয় লক্ষণীয় যে, বাংলার প্রকৃতির যে রূপকে রবীন্দ্রনাথ অবলোকন ও উপলব্ধি করেছেন, তার অনেকটাই বর্ষা ও নদী। এটি মোটেই বিস্ময়কর নয়। কারণ, প্রাকৃতিক বাংলার বিশেষত্ব তো এ দুটোই। বর্ষার মাধুর্য তাকে বিশেষভাবে ভাবিত করেছে। তার মানসপটের স্বপ্নিল কল্পনাজালকে বিস্তৃত করেছে। আর নিত্যদিনের সহচর পদ্মাই তো তাঁর কাছে প্রতিনিধিত্ব করেছে নদীমাতৃক বাংলার।

তবে একথা সত্যি যে, গ্রামবাংলার প্রতি ভালোবাসা থেকেই গ্রাম্য প্রকৃতির প্রতি তার এ মোহমুগ্ধতা। জীবনের বেশির ভাগ তিনি অবস্থান করেছিলেন তিনি গ্রামাঞ্চলে। ভালোবেসেছিলেন গ্রামকে, গ্রামীণ প্রকৃতিকে। একথা বলা মোটেই অতু্যক্তি হবে না যে, গ্রামাঞ্চলের প্রাকৃতিক পরিবেবেশেই সৃষ্টি হয়েছিল তার সৌন্দর্যময় শৈল্পিক জীবন। অর্থাৎ যে প্রকৃতিকে নানাভাবে ধারণ করেছিলেন তিনি তার বিভিন্ন লেখায়, মূলত সেই প্রকৃতিই তো তাকে অনুপ্রাণিত করেছে তার সৃষ্টির শৈল্পিক সত্তাকে। তার শান্তিনিকেতনের প্রতিষ্ঠিতি তো তার এই প্রকৃতিপ্রেম, চিন্তা এবং ভাবনা থেকেই। গ্রামীণ পরিবেশে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে প্রতিষ্ঠিত শান্তিনিকেতন তো রবীন্দ্রনাথের প্রাকৃতিক মুগ্ধতারই প্রতিফলন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে