বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কোথায় মা

তাপস কুমার বর
  ০৬ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

রাস্তার মধ্যিখানে একটা নীরব শ্রোতা দাঁড়িয়ে কাঁদছে। সামনে একটা বটগাছ। গ্রীষ্মের প্রচন্ড দাবদাহে গাছপালা এক ফোঁটা জলের জন্য ধুঁকছে। একটা ভিখারি বুড়িমা, পরনে ছেঁড়া বস্ত্র, মাথার চুল উসকো-খুসকো। হাঁপাতে হাঁপাতে বীরু দাদুর চায়ের দোকানের কাছে এসে দাঁড়িয়ে গেল। চায়ের দোকানে বসে থাকা নিরু, স্বপন দাদা, পরমেশ্বর কাকা ও আব্দুল চাচা সবাই ভিখারি মায়ের দিকে তাকিয়ে এক সুরে বলল...

\হ'কিছু বলবেন, কাউকে খুঁজছেন?'

-ভিখারি মা, বলল না না কাউকে খুঁজছি না। আমাকে কিছু খাবার কিনে দেবেন বাছা সব, আজ সারা দিন কোথাও কিছু খাবার জোটেনি, জল খেয়ে আর কত দিন চলবে! আব্দুল চাচা বীরু দাদুকে বলল, বীরু উনাকে একটা চা, বিস্কুট ও একটা রুটি দাও তো, আমি পয়সা দিয়ে দিচ্ছি। নিরু, স্বপন দাদা ও পরমেশ্বর কাকা বলল, আব্দুল চাচা খুব দয়ালু মানুষ, কষ্ট দেখলে মায়ায় পড়ে যান। নিরু বলল, এই জন্য তো আব্দুল চাচার একটা 'বৃদ্ধাশ্রম' আছে। উনি ওখানে কত বৃদ্ধ মা-বাবাকে স্থান দিয়েছেন তার বৃদ্ধাশ্রমে...

\হ'তুমি আমাদের পাড়ার গর্ব আব্দুল চাচা। কত হারিয়ে যাওয়া মানুষ, তোমার স্পর্শে নতুন জীবন ফিরে পেয়েছে!'

-বৃদ্ধা মায়ের দিকে তাকিয়ে, আব্দুল চাচা বলল, কোথা থেকে আসছেন মা। বৃদ্ধা বুড়িমা, চোখের অশ্রম্ন ফেলতে ফেলতে বলল, বাবা তোমরা কত ভালো। আমার কাছে সব থেকেও আমি আজ পথের ভিখারি বাবা! গবাই বৃদ্ধা মায়ের কথা শুনে খুব মায়া হলো। সবাই তার জীবনের ঘটনা শুনতে চায়। বৃদ্ধা মা বলল, আমার জীবনের ঘটনা খুব দুঃখের। তাই কাউকে বলি না। কেউ শুনে হাসে, কেউ বা উপহাস করে। পরমেশ্বর কাকা বলল না বুড়িমা আপনি বলুন, আপনার কষ্ট আমরা ও ভাগ করে নিতে চাই। বৃদ্ধা বুড়িমা বলা শুরু করল জীবনের ঘটনা।

\হবুড়িমার বাড়ি মহেশপুর গ্রামে। বুড়িমার নাম বিমলা দেবী। বিমলা দেবীর বিয়ে হয়েছিল এক কৃষক পরিবারে। তারা মধ্যবিত্ত পরিবার। তাদের সম্পতি ভালোই ছিল। কিন্তু হঠাৎ কয়েক মাস যেতে না যেতেই বিমলা দেবীর স্বামী পরেশ বাবু ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এদিকে তাদের এক ছেলে অমল ও এক মেয়ে শ্রম্নতি তারা খুব ছোট্ট ছোট্ট। পরেশ বাবু এতটাই অসুস্থ হয়ে পড়লেন যে, পরিবারের জায়গা বিক্রি করেও বিমলা দেবী স্বামীকে শেষ পর্যন্ত বাঁচাতে পারলেন না...

\হ'জীবনের গতি স্তব্ধ। হারিয়ে গেছে আনন্দ! থমকে যেতে যেতে এক দিন সব হবে স্তব্ধ!'

-স্বামীর কাজ সেরে উঠতে গিয়ে বিমলা দেবী বেশ দেনাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এদিকে ছোট্ট দুটো ছেলের পড়াশোনার খরচ, সংসার খরচ চালাতে না পেরে, অন্যের বাড়িতে বাড়িতে কাজ করা শুরু করল। ওখান থেকে টাকা নিয়ে দেনা শোধ করলেন বিমলা দেবী। এই ভাবে অনেক পরিশ্রম করে ছেলেমেয়ে দুজনকেই মানুষের মতো মানুষ করে তুলল। ছেলে অমল ও মেয়ে শ্রম্নতি দুজনে পড়াশোনা করে আজ তারা সরকারি চাকরিজীবী। ছেলে অমল সরকারি অফিসার ও মেয়ে প্রাইমারি শিক্ষিকা। আজ যে মায়ের জন্য তারা জীবনে সফল। আজ সেই মায়ের জীবন একটা যাযাবরের মতো...

\হ'ধুঁকে ধুঁকে রাস্তায় চলি। বুকের বামপাশে ভীষণ ব্যথা। মৃতু্য যদি এসে যেত, হয়তো শান্তি পেয়ে যেতাম।'

-এই কথা শুনে সবাই নীরব, সবাই বলল তারপর কি হলো বুড়িমা। বুড়িমা বলল, ছেলেমেয়েদের কাছে অনেকবার গেছি, ওরা রাখতে চায় না। বৃদ্ধা মাকে ওদের কাছে রাখলে, ওদের সম্মানে 'চাঁদকলঙ্কের মতো দাগ লেগে যাবে।' বাড়িতে ছেলে, বৌমা ঠিক মতো খেতে দেয় না। বারবার অপমান করে। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা এখনো 'বিনোদনে মজে গেছে, নিজের মাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেও তাদের লজ্জা লাগে।' মেয়ে শ্রম্নতির বাড়িতে কয়েক মাস আগে গিয়েছিলাম। কিন্তু মেয়ে বলল...

\হ'মা এই নাও দুশ' টাকা। তুমি অন্য কোথাও চলে যাও। আমাদের তো এই অবস্থা দেখতেই পাচ্ছ। তার উপর একজন জুটলে আমাদের সংসারটা চলবে কী করে?' সেদিনও বিমলা দেবী অবাক হয়েছেন। মনে পড়ে যায়, সেই ছোট্টবেলার 'সেই শ্রম্নতি কি আজকের সেই শ্রম্নতি? আজ তারা স্বার্থপরের মতো নিজেদের ভাবে। নিজের মাকেও ভুলে গেছে...

\হ'আমি স্বপ্ন দিয়ে গড়েছি তিলে তিলে স্বপ্ন। আজ সেই স্বপ্ন আমাকে স্বার্থের আগুনে ভুলে গেছে!'

-সেদিন বীরু দাদুর চায়ের দোকানে সবাই নীরব। যে মা তার সন্তানের জন্য নিজের জীবনও শেষ করে দেয়। সেই সন্তান-সন্ততিরা কেন এই মায়ের জন্য...'খোলা বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়!'

\হআজ এই বিমলা দেবীর মতো আরও কত বিমলা, আজও অত্যাচারিত। এইভাবে কেন তাদের ছুড়ে ফেলা হয়? এই প্রশ্ন বীরু দাদুর চায়ের দোকানে নিরু, পরমেশ্বর কাকা, স্বপন দাদা ও আব্দুল চাচার মনে বারবার প্রশ্নগুলো দাগ কেটে গেছে। আজও এই প্রশ্ন নীরবতার গুপ্তগুহায় কখনো কখনো স্বার্থপর হয়ে ওঠে।

\হআব্দুল চাচার চোখের কোনে বিমলা দেবীর এই কথা শুনে জল এসে গিয়েছিল। চাচা বলল...

\হ'এই সমাজকে শিক্ষা দিতে গেলে নিজেকে নীরব থাকলে হবে না। প্রতিবাদ করতে হবে, এই রকম অত্যাচারীর স্বার্থের বিরুদ্ধে!'

-মা তো একটা পবিত্র শব্দ। যে কখনো নিজেকে ভাবে না। অন্য সন্তানের জন্যও বিপদে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক দিন এই অমল ও শ্রম্নতি তারা ভুল বুঝতে পারবে। যেদিন ওরাও এক দিন মা, বাবা হবে। মা-বাবার যন্ত্রণা, ব্যথা, অনুভব করতে জানবে। সেদিন ওদের চোখের সামনের কালো পর্দাটা সরে যাবে। আব্দুল চাচা, বৃদ্ধা ভিখারি বিমলা দেবীকে আর রাস্তায় রাস্তায় ঘুরতে দেবে না। তিনি তার 'বৃদ্ধাশ্রমে' বিমলা দেবীকে নিয়ে যান। সেখানে অনেক বৃদ্ধা মা-বাবা আনন্দে খেলছে, আবার কেউ নীরবতায় বসে আছে একাভাবে। সবাই বিমলা দেবীকে দেখতে পেয়ে ছুটে এসে বলছে...

\হ'এ সমাজ কি এখনো মাকে বুঝে উঠতে পারেনি? কেন তাদের জন্য শেষ বয়সে আসতে হয় বৃদ্ধাশ্রমে!' চোখের কোনে অশ্রম্নর ফোঁটাগুলো বিন্দু বিন্দু হয়ে ঝরে পড়ছে...

\হ'যেদিন তোমাদের ঘুম ভাঙবে, সেদিন জানবে! পৃথিবীতে তোমার সবচেয়ে কাছের আপন 'তোমার মা-ই ছিল সবচেয়ে কাছে!'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে