শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নষ্ট মেয়ে

মৃধা মুহাম্মাদ আমিনুল
  ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০

নষ্ট মেয়ে নাম বিছানা থেকে, অসভ্য জানোয়ার চোখের সামনে থেকে সর। দুর হ বে. মা. (রেগেমেগে কথা বললেন আমার স্বামী) আজকেই আমাদের বিয়ে হয়েছে আজকেই বাসর। বাসর রাত জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ রাত হিসেবে জানতাম, বাসর রাত নিয়ে ধনী-গরিব সবারই আলাদা আলাদা স্বপ্ন থাকে। এই রাত নিয়ে আমার হাজারো কল্পনা জমা ছিল। এ রাতটা আমার জন্য খুব স্পেশাল রাত হবে বলে ভেবে রেখেছিলাম।

সত্যি খুব স্পেশাল রাত হয়েছে, বাবার তিন কন্যার মাঝে আমিই বড়, বাবা মেয়ে সন্তান পছন্দ করত না, তবুও ভাগ্যের নির্মম পরিহাস আমাকে তার ঘরেই পাঠালেন সৃষ্টিকর্তা। আমার জন্মের পর বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করেন, মায়ের সঙ্গে সব সম্পর্ক বাতিল করে দেয়, অভাব-অনটনে বড় হয়েছি আমি, সাজুগুজু করার খুব শখ ছিল আমার। খেলাধুলা, নাচ-গান, গাছে চড়া আমার শখের বাহিরে নয়।

আমার বয়স যখন ৯ বছর তখন বাবা বাড়িতে আসেন, মায়ের কাছে অনুনয়-বিনয় করে ক্ষমা চায়, মা তাকে থাকার জন্য সম্মতি পোষণ করেন। কিন্তু বাবা আমাকে একদম সহ্য করতে পারতেন না। অথচ তার দ্বিতীয় বউয়ের একটা ছেলে ছিল তাকে সব সময় আগলে রাখতেন। ছেলেটাকে রেখে ওর মা এক ভ্যানচালকের সঙ্গে পালিয়ে গেছেন।

তখন এসব বুঝতাম না, এখন বুঝতে পারছি সব। দিন দিন সমাজ কত ধ্বংসের পথে চলছে, দেখতে দেখতে আমার বয়স এখন ১৮ বছর। আর আজকেই আমার সঙ্গে এমন আচারণ করছে আমার স্বামী।

আমার বিয়ে হয় মামার পছন্দ করা ছেলের সঙ্গে, ছেলে কৃষি কাজ করে, আমি বিয়েতে হঁ্যা বা না সম্মতি পোষণ করার কোনো সুযোগ পাইনি। মামা মায়ের কাছে বলেছে, আর মা আমাকে বলছে, তোর পলাশের সঙ্গে বিয়ে। গ্রামের বিয়েগুলো কত নাচ গান হয় আমার বিয়েতে একটা কাকও নাচল না।

আশা ছিল বাবার বাড়ি সারা জীবন কষ্ট করেছি, স্বামীর সঙ্গে ঙ্গুখে আমরণ কাটিয়ে দেব। কিন্তু তা আর হলো কই? আমার জামাই বাসর রাতেই আমাকে সন্দেহের তীর নিক্ষেপ করলেন। আমি নাকি বেশ্যা। আমার সতীত্ব নাকি আমি বিলিয়ে দিয়েছি।

তার কথাগুলো চুপচাপ শোনা ছাড়া আমার কিছুই করার ছিল না আর। আমি নারী, আমি জন্ম থেকেই অবহেলিত। সমাজে কি আমার মূল্য কখনো দেবে না ইসলামের মতো করে কেউ।

ইসলামের মহান বাণী সুরাতুন নুর এর ২৬নং আয়াত কি মানুষ জানে না যেখানে আলস্নাহ নিজে বলেছেন 'দুশ্চরিত্রা নারী দুশ্চরিত্র পুরুষের জন্যে; দুশ্চরিত্র পুরুষ দুশ্চরিত্রা নারীর জন্যে; সচ্চরিত্রা নারী সচ্চরিত্র পুরুষের জন্যে এবং সচ্চরিত্র পুরুষ সচ্চরিত্রা নারীর জন্যে। লোকে যা বলে এরা তা হতে পবিত্র; এদের জন্যে আছে ক্ষমা এবং সম্মানজনক জীবিকা।'

মূূলনীতি বলে দেওয়া হয়েছে যে, পবিত্র ও চরিত্রবতী নারী পবিত্র ও চরিত্রবান পুরুষের জীবন সঙ্গী হবে। আর বদ চরিত্র পুরুষের জন্য বদ চরিত্রের অধিকারী জীবন সঙ্গিনী হবে। আমার জামাই কি জানে না সে পবিত্র নাকি অপবিত্র। সে পবিত্র হলে তো আমিও পবিত্র।

আলস্নাহর শপথ আমি সত্যি পবিত্র, তবে কি এই সমাজের মানুষ প্রথম মিলনে রক্তপাত না হলে আমাকে পতিতাদের সঙ্গে তুলনা করবে? বর্তমান বিজ্ঞানের যুগে এটা বলা কতটুকু যৌক্তিক আমার বোধগম্য নয়।

মানুষ এখনো পড়ে আছে অ্যানালগ যুগে। তারা জানে না এসব অধিকাংশ নারীর ক্ষেত্রেই, হাইমেন (সতীপর্দা) আপনা-আপনিভাবে অপসারিত হয়ে থাকে, যেমন ব্যায়াম করলে, সাঁতার কাটলে, বাইসাইকেল চালালে, গাছে চড়লে, এমন কি ঘোড়ায় চড়লেও। হাইমেন বা সতীচ্ছদ নামের পর্দা যে কোনো ভারী কাজ করলেও আপনা থেকেই ছিঁড়ে যেতে বা উধাও হয়ে যেতে পারে, এমন কি নাচানাচি করলে কিংবা মাসিক চলাকালীন সময় ট্যাম্পুন ব্যবহার করলেও।

এই সংবাদ আমার জামাইয়ের কর্ণকুহরে সাময়িক সময়ের জন্যও কখনো পৌঁছেনি। আমার অশ্রম্নসিক্ত নয়নে কেঁদে কেঁদে বললাম, বিশ্বাস করুন আমি আমার সতীত্ব আমানত হিসেবে সংগ্রহে রেখেছি। চুপ কর বে, (চোখ রাঙিয়ে বলল আমার স্বামী) আমি আর কিছু বলার সাহস করলাম না, সে একা একা বলতে লাগল। আসছে সে সৎ। যদি সৎ হতো এই সাদা বিছানার চাদরে রক্ত নেই কেন?

কথাগুলো এভাবেই লেখা ছিল ফেরিওয়ালা মামার ঝোলা থেকে পড়ে যাওয়া লাল টুকটুকে এই ডাইরির প্রথম পাতা থেকে শুরু করে। আমি সবটা পড়ে অবাক হলাম।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে