শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কঙ্কাল, রবীন্দ্রনাথ ও পুনঃপাঠ

লুৎফর রহমান
  ০৫ মে ২০২৩, ০০:০০

১৯১৩ সালে ৮১ বছর বয়সে কবি এজরা পাউন্ড রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে বলেছিলেন, 'উদ্ধৃতির জন্য যে কবিতাই তুলি পরেরটা পড়ে ভাবী বুঝি ভুল করলাম'। আমরা ভুল করি না, কারণ আমরা তার ভিতর-বাহির এতটাই জানি যে, কখনো পড়িই না! পড়ি না তাই ভুলও করি না। পড়লেও ভুলভাবে পড়ি কিংবা ব্যাখ্যা করি। কবি শঙ্খ ঘোষের 'পাঠক' প্রবন্ধ পড়ে অন্তত এরূপই উপলব্ধি হয়েছে। জীবদ্দশায় রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং অকাট্য যুক্তিতে সমালোচকদের কত আখ্যা-ব্যাখ্যার ভ্রান্তি চিহ্নিত ও অগ্রাহ্য করেছেন তার দৃষ্টান্ত রবীন্দ্র-রচনাবলিতে সংরক্ষিত। কঙ্কাল প্রকৃতপক্ষে জীবদেহের হাড়ের কাঠামো, অস্থিপঞ্জর। মাংস মজ্জাশূন্য হাড়ের খাঁচা। ডাক্তারি বিদ্যাচর্চার বাইরে তার কোনো ব্যবহারিক গুরুত্ব খুব একটা নেই। মানবদেহের হাড়হাড্ডির হিসাব বা নাম-পরিচয় বা অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞান দেওয়ার উদ্দেশ্যে এ গল্প রচনা করা হয়েছে তা নয়- প্রত্যেকটা কঙ্কালের পেছনে থাকে এক-একটা জীবন্ত মানুষ। তাদের জীবন সম্পর্কে আমরা কিছুু জানি না অথচ তার কঙ্কাল বিষয়ে আমরা নানা তথ্য মুখস্ত করি। একটি কঙ্কালের জীবিতকালের যে স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা, প্রেম-কামনা-বাসনাপূর্ণ জীবনগল্পে সেই জীবনের কথা, তার জবানিতে বর্ণনা করা হয়েছে। কঙ্কালের সঙ্গে এ অঞ্চলে বসবাসকারী ভূত-প্রেতের নিবিড় যোগ : সামন্ত বিশ্বাস এই যে, অপঘাতে মৃতু্য হলে যে ব্যক্তির মৃতু্য হয় তার অতৃপ্ত আত্মা বসবাস স্থানে আবার আসে, বারবার। তার কঙ্কালকে খোঁজে। হত্যাকারীর ওপর প্রতিশোধ নেয়। অতএব, অপঘাতে কেউ, যে ঘরে মরেছে সে ঘর পরিত্যক্ত ঘোষণা করে পরিবারটি। আমরাও এই অনগ্রসর, সংস্কার-কুসংস্কারের শিকড়-বাঁকড় সমাচ্ছন্ন সমাজে শৈশব, কৈশোর এমনকি যৌবনবেলা কাটিয়ে এসেছি। ভূত-প্রেত নিয়ে গল্পে আসর জমিয়েছি, সমাজ নিয়ে সমাজের প্রচলিত বিধিবিধান জীবনের জন্য কত বড় প্রতিবন্ধক তা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন বোধ করিনি। পরিণত বয়সে কঙ্কাল আবার পাঠ করলাম। মনে হলো- কঙ্কালটা চোখের ওপর থেকে, ভাবনার দরজা থেকে পলকে উধাও হলো। দেখলাম এ গল্পে রবীন্দ্রনাথ কঙ্কালটি সম্পর্কে একটি শব্দও লেখেননি। শুনিয়েছেন, বলেছেন যে নারীর এই কঙ্কাল, তার জীবন ইতিহাস। না, তাও নয়, সেই নারী যে সমাজে বাস করত, যে গোঁড়া সমাজের সে প্রতিনিধি, যে সমাজের প্রচলিত বিধিবিধান, ভ্রান্ত শাস্ত্রনীতি তাকে কঙ্কালে পরিণত করেছে এবং বিনষ্ট করে চলেছে তার মতো অসংখ্য নারীর জীবনকে সেই সমাজের চিত্রঅঙ্কন করা লেখকের উদ্দেশ্য। সেই কঙ্কালসার সমাজের ভ্রান্তিগুলো, ক্ষমতাধর সমাজনিয়ন্তার চোখে মূর্ত করতেই রবীন্দ্রনাথ এই গল্প রচনা করেছেন। প্রেতাত্মার নাম শুনে বেহুঁশ আমরা আড়ালে থাকা দুর্ভাগা এক নারীর যন্ত্রণা কাতর অস্তিত্বের উপস্থিতিকে দেখতেই পাইনি। অন্তত আমার বেলায় এই-ই সত্য। গল্পে লেখক একটি পক্ষের প্রতিনিধি। সেই পক্ষেই তিনি ওকালতি করেন, যেমন- হৈমন্তী গল্পে লেখক হৈমন্তীর শ্বশুরের বিপক্ষে। অর্থাৎ বাল্যবিয়ে ও পণপ্রথার বিরুদ্ধে। তা হলে গল্পে বিষয় বা ঝঁনলবপঃ হলো- পণপ্রথার বা বাল্যবিয়ের কুফল। 'কঙ্কাল' গল্প যার জীবনকাহিনী সেই মেয়েটি বিধবা। বিধবা বলে তার প্রেমিক ডাক্তার বড় অঙ্কের যৌতুকের লোভে, সমাজের ভয়ে বিধবা প্রেমিকাকে প্রত্যাখ্যান করেছিল। আর সেই যন্ত্রণায় বিধবা যুবতী আত্মহত্যা করে। কিন্তু তার আগে সে তার প্রেমিককেও বিষ প্রয়োগে হত্যা করে। আজ সে নেই আছে তার কঙ্কাল। আছে কঙ্কালসার সেই সামন্ত সমাজ। গল্পকারের মনে হয়েছে- বুঝি সে নারী অপূর্ণজীবন স্বপ্নের, অচরিতার্থ প্রেমের অতৃপ্তি নিয়ে যৌবনের অপূর্ব ঐশ্বর্যভরা দেহের কাঠামোটির কাছে রোজ রাতেই আসে। আত্মা তো, অশরীরী অমর। কঙ্কাল গল্পের উপস্থাপনা অংশটি লেখক স্বীকার করেছেন সত্যি ঘটনা। কঙ্কালটি বাস্তব সত্য, মেয়েটি অমূর্ত সত্য তার চেতনায়। গল্পের প্রথম দুটি অনুচ্ছেদের বাস্তব সত্যের ওপর কল্পনার রঙ চড়িয়েছেন লেখক। পরবর্তীকালে 'পুণ্যস্মৃতি' নামক রচনায় কীভাবে 'গল্পটি মাথায়' এলো তা বর্ণনা করেছেন রবীন্দ্রনাথ। কঙ্কাল সত্য, সেই অনেক বছর পরে রাত্রিযাপনের ঘটনা সত্য। কঙ্কালটি যে এক মেয়ের তা কাব্য সত্য। রোজ রাতে তার এই ঘরে আসার প্রসঙ্গ এবং কঙ্কালটির জীবিত মানুষের মতো আত্মকাহিনী বর্ণনার ঘটনা কবি কল্পিত। সেই গল্পে বাস্তব পারিবারিক, সামাজিক জীবনের যে তথ্য আছে তা এরূপ- মেয়েটি এক সম্পদশালী পরিবারের সন্তান। বাল্যবিয়ের শিকার। বিয়ের দুই মাস পরই তার স্বামীর মৃতু্য হয়। বিধবা হয়ে সে চিরকুমারব্রত গ্রহণকারী ভাইয়ের সংসারে জীবন কাটাতে থাকে। ধীরে ধীরে বালিকা থেকে কিশোরী এবং তারপর যুবতীর রূপযৌবনে পরিপুষ্ট ষোলোকলা চন্দ্র হয়ে ওঠে বিধবা মেয়েটি। নিঃসঙ্গ সেই নারী আপন সৌন্দর্যে মুগ্ধ ছিল। তার অনন্য রূপের বর্ণনা সে গল্প লেখককে শোনায়। অনেক বছর পরে, ডগমগ এই যুবতী জ্বরে আক্রান্ত হলে ভাইয়ের একমাত্র ঘনিষ্ঠ ডাক্তার বন্ধুর সঙ্গে তার পরিচয় হয়। অসূর্যম্পশ্য এই নারী প্রথম দর্শনেই ডাক্তারের প্রতি প্রেমাসক্ত হয়। কিন্তু তা গোপন থাকে মনে। কারণ সে বিধবা। পুরুষের প্রেম তার জন্য নয়। শাস্ত্রের অমূলক দোহাই দিয়ে সেকালের সমাজ বিধবার প্রেম, বিবাহ নিষিদ্ধ করেছে। দেহে যৌবন টগবগ করবে কিন্তু তার জন্য অন্তরে প্রেম আসা শাস্ত্রীয় বিধানে (?) পাপ, সামাজিক বিচারে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু প্রেম মানব স্বভাবের অন্তর্গত- মনোদৈহিক উপলব্ধি, প্রয়োজনও বটে। প্রেম তো অদৃশ্য, তাই অদৃশ্য মনে দিনে-ক্ষণে বাড়ে। এক্ষেত্রেও তাই হলো- মেয়েটির প্রেমের শিকড় ডাক্তারের অস্তিত্বের গহিনে বিস্তৃত হলো। ডাক্তার নিজেও তাকে ভালোবাসত। একদিন মেয়েটি জানতে পারে, রাতের লগ্নে ডাক্তারের বিয়ে। ডাক্তারের স্ত্রী হবে অন্য কোনো নারী, এটা ছিল তার কাছে সহ্যাতীত। মৃতু্য ছাড়া তার মুক্তির পথ ছিল রুদ্ধ, জানত সে। বিষ প্রয়োগে ডাক্তারকে হত্যা করে, নিজে আত্মহত্যা করবে এটাই ছিল মেয়েটির সিদ্ধান্ত। বিষ মিশানো থাকায় চা পানে মৃতু্য হয় ডাক্তারের। অতঃপর বিয়ের সাজে সজ্জিত মেয়েটি বকুলতলায় বিছানা পাতে এবং বিষ পান করে। প্রেমিক-প্রেমিকার সঙ্গে প্রেমেরও মৃতু্য ঘটে। আত্মকাহিনী শেষ হতেই কাক ডাকে। সকাল। নিত্যবাস্তবের রুক্ষ্ণতার ধাক্কায় লেখকের কল্পবাস্তব ঝনাৎ শব্দে গুঁড়িয়ে যায়। আখ্যান শেষে সহৃদয় পাঠক, দ্বিধা বিভক্ত- একপক্ষ একটি আত্মাকে প্রেতের বেশে তার দেহ কাঠামো খুঁজতে খুঁজতে একটি অন্ধকার ঘরে এসে বিনিদ্র লেখকের সঙ্গে গল্প বলে শুনে গালাগাল করে, বলে গাঁজাখুরি! আবার ভাবে- কী ভয়ঙ্কর, লেখকের সাহস কত! এই শ্রেণির পাঠকের বিশ্বাস যুক্তি খোঁজে না- যুক্তি ও বিজ্ঞানকে সজারুর কাঁটা জ্ঞানে তাদের বিশ্বাস দৌড়ে পালায়। তারাই চাঁদের গায়ে পৃথিবীতে বসবাসরত ও জীবন্ত তার মতোই আরেকজন মানুষের মুখচ্ছবি দেখে। সমাজ নামক কঙ্কাল, বিশ্বাস নামক কঙ্কাল, সামাজিকপ্রথা নামক কঙ্কালের তারাই রক্ষাকর্তা, প্রতিপালক। হাজার বছর ধরে তারাই এসব কঙ্কালের ইজারাদার। ক্ষণেকের জন্যও তারা এগুলোকে কাঁধ থেকে নামায় না। আশ্চর্য আত্মসচেতন এই নারী। এবং এটাই জৈবনিক স্বাভাবিক প্রবণতা। যৌবন অযাচিত শূন্যতায় এভাবেই ভরে তোলে যুবক পুরুষ ও যৌবনবতী নারীর মন। হোক সে সধবা বা বিধবা কামনার কেউটে তার জীবদেহে ছোবল দেবেই। যে সমাজ রক্ত-মাংসের মানুষের দ্বারা পরিচালিত, তার ব্যবস্থাপক গোষ্ঠী এই চিরায়ত সত্যকে অগ্রাহ্য করতে পারে না। যে সমাজ কৃচ্ছ্রতা সাধনের মধ্যে মুক্তি খোঁজে, সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করে গার্হস্থ্য জীবন থেকে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে সে সমাজে এই সমানুভূতি সম্পন্ন মন থাকতে পারে না- তো! গল্পের নায়িকা এই মেয়েটি ধর্ম সম্প্রদায়ের নীতির ছাঁচে সৃষ্ট নয়- কামনা-বাসনা ইত্যকার ষড়রিপুর তাড়নায় অস্থির মানবী। ভালোবেসেছে সে এক পুরুষকে। তাকে ঘিরেই তার যাবতীয় আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন-কল্পনা পলস্নবিত হয় আর কিছু নয়। যে সুখ নিজের জন্য নিষিদ্ধ তা অন্যকে ভোগ করতে দেখলে রক্ত-মাংসের অধিকারী সবাই ঈর্ষান্বিত হবেই। প্রতিশোধের আগুন ব্যক্তি মনে দাউদাউ জ্বলে। মেয়েটি বিধবা, এটা তার অপরাধ নয়; কিন্তু সমাজ তার বিয়ের অধিকার হরণ করেছে। জীবনকে, যৌবনকে ভোগের অধিকার হরণ করেছে। সেই সমাজেই মেয়েটির চোখের ওপর তার প্রেমের পাত্রকে নিয়ে অন্য কোনো নারী সুখভোগ করবে তা হতে পারে না। তাই এর মীমাংসা প্রয়োজন। অতঃপর ভিন্ন চিত্র পাঠকের চোখের ওপর- যার দেহাবশেষ এই কঙ্কাল সে বলেছে, 'আমি আমার সেই কঙ্কালটা কোথায় গেছে তাই খুঁজিতে আসিয়াছি'। হারালে খোঁজা মানব স্বভাব। খুঁজতে কোথায় এসেছে আত্মাটি? সমাজের দেওয়ালে তার কঙ্কাল খুঁজতে এসেছে। কঙ্কালের জীবন্তরূপ যে মেয়েটি অতঃপর সে তার মানুষরূপ থেকে কঙ্কালে পরিণত হওয়ার গল্প শোনাচ্ছে এই গল্পের মূল কথককে। তারপর প্রশ্নোত্তরের মধ্য দিয়ে গল্পটি এগিয়েছে। মৃত যুবতী লেখককে যে গল্প শোনায় তাতে আছে- ক. তার বাল্যবিয়ের গল্প, খ. বালিকার স্বামী ভীতি, স্বামীর অকাল মৃতু্যর খবর; গ. সেকালের নিয়ম অনুযায়ী বিধবা হয়ে বাবার বাড়ি চলে আসার কথা; ঘ. বালিকা থেকে যুবতী হওয়ার পর রূপযৌবনের ঐশ্বর্যর কথা; ঙ. দাদার ডাক্তার বন্ধু শশীশেখরের প্রতি মুগ্ধতা, ভালোবাসার কথা; চ. বারো হাজার টাকা পণ নিয়ে ডাক্তারের বিয়ে ঠিক হওয়ার কথা এবং ছ. মেয়েটির অপূর্ণ জীবনে ব্যর্থতার গস্নানি সহ্য করতে না পেরে, আত্মহত্যা এবং তার পূর্বে জীবনের প্রথম ও একমাত্র প্রেম শশী শেখরকে অন্যের অধিকারে যেতে না দেওয়ার সিদ্ধান্তে তাকেও বিষ প্রয়োগে হত্যা করার কথা। সমাজের ওপর সে প্রতিশোধ গ্রহণ করেছে। গল্পের ভাষা চরিত্রের জীবনের মতো সহজ-সরল। দীর্ঘবাক্য কিন্তু তা সরল। কখনো যৌগিক। জটিল নয়। অসমাপিকা ও সমাপিকা ক্রিয়ার ব্যবহারে তা অত্যন্ত গতিশীল। চরিত্রের ভাষা এবং লেখকের ভাষা এখানে অভিন্ন। কারণ চরিত্রই তার জীবনের গল্পটির বর্ণনাকারী বা কথক। দুজন কথক গল্পটি বলছে একজন আরম্ভকারী ও ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাটকের ঠ্যাটার মতো প্রশ্নকর্তা। অন্যজন যার জীবনের গল্প সেই নারী। দুজনই উত্তম পুরুষের কথা বলছে। উত্তম পুরুষের কথা বরাবর আত্মকেন্দ্রিক, আমিত্ব থাকে ভাষার কেন্দ্রে। ভাষাও হয় অন্তর্মুখী। কঙ্কাল গল্পেও এ রীতি অনুসৃত। ভাষায় যা বলা হয়নি- বিধবা মেয়েটির নিঃসঙ্গ পরিবেশ, দুঃখময় জীবন ও নতুন যে পরিস্থিতির মধ্যে সে প্রবেশ করে- বিধবার প্রেম, বিবাহ, নিষিদ্ধ জানার পরও সে ডাক্তারের প্রেমে আচ্ছন্ন হয়েছে। ব্যক্তি হিসেবে সে অধিকার তার রয়েছে; কিন্তু শশীশেখরের জীবনে প্রবেশের সামাজিক অধিকার বা ছাড়পত্র তার নেই। ফলে সে নিজেই তার ট্র্যাজিক পরিণতির স্রষ্টা- সমাজ সহায়ক শক্তি। কারণ সমাজ ও সামাজিক বিধিনিষেধ তাকে ওই অবস্থায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য দায়ী- অতএব গল্পটি সামাজিক ট্র্যাজেডির অন্তর্গত। তাই বাইরের জগতের প্রতি এর ভাষার কোনো আগ্রহ নেই। মনের কথার ভাষা, তাই এর অবস্থান অন্তরে-অন্তরে চোখ মেলে অন্তর দিয়েই মেয়েটির নিরুপায় অস্তিত্বের দহনকে অনুভব করতে হয়। এই গল্পে নায়িকার আত্মা শ্রোতাকে জিজ্ঞেস করেছে, 'মনে করো এইখানেই গল্পটা যদি শেষ হয় তাহা হইলে কেমন হয়।' গল্পরসের পরিপূর্ণতা আসে না তাতে। মেটে না, সাহিত্যের, সাহিত্যিকের সামাজিক দায়। সেই কথাটিই রবীন্দ্রনাথ মৃত নারীর জবানিতে বলেছেন। গল্পে উত্তম পুরুষ প্রথম বক্তা যখন ওই প্রশ্নের উত্তরে বলেছে, 'মন্দ হয় না। একটু অসম্পূর্ণ থাকে বটে; কিন্তু সেইটুকু আপন মনে পূরণ করিয়া লইতে বাকি রাতটুকু বেশ কাটিয়া যায়।' মূল গল্পটি তখনো বাকি। মেয়েটির জীবনের অবশিষ্ট কথাই এই গল্প। কঙ্কালের ছায়া-সত্তা সে জন্যই বলে, 'কিন্তু তাহা হইলে গল্পটা যে বড় গম্ভীর হইয়া পড়ে। ইহার উপহাসটুকু থাকে কোথায়। ইহার ভিতরকার কঙ্কালটা তাহার সব দাঁত-কটি মেলিয়া দেখা দেয় নাই।' নারীর জীবনালেখ্যের ভিতর থেকে সমাজের কঙ্কালটি বের করে আনা তখনো বাকি। গল্পকারের উদ্দেশ্য-বীজটি সেখানেই উপ্ত। বাল্যবিধবাদের সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা, অর্থনৈতিক নিশ্চয়তার কোনো ব্যবস্থা করেনি সেকালের বিধানদাতা সমাজ। সম্ভ্রম, সম্মানের ব্যক্তিক মর্যাদা নেই যে সমাজে, নেই অর্থনৈতিক সচ্ছল জীবনের নিশ্চয়তা সে সমাজ বিধান দেয় কোন অধিকারে? সমাজসচেতন ব্যক্তির বিবেক এই প্রশ্ন করতেই পারে। নাগরিকের অধিকার যথাযথভাবে রক্ষা না করে সমাজ কখনো বিধান দাতার স্বৈরাচারনীতি গ্রহণ করতে পারে না। আধুনিক এবং পরবর্তীকালের সমাজনীতি, রাষ্ট্রনীতি তা ন্যায্য মনে করে না। অসঙ্গত সাব্যস্ত করে। গল্পের 'কঙ্কালটা তাহার সব দাঁত-কটি মেলিয়া দেখা' দিলেই তো আমাদের অনড় সমাজপদ্ধতির অন্তর্গত অন্তঃসারশূন্যতা এবং মানবসৃষ্ট সমাজে মানুষের অমানবিক বিধিবিধানের নরকে কীভাবে মানবতা পুড়ে ভস্মীভূত হচ্ছে তা প্রত্যক্ষ করা সম্ভব। এবং গল্পকার রবীন্দ্রনাথের আলোচ্য 'কঙ্কাল' গল্পটি আমাদের স্বকালের সমাজের সর্বস্তরে অসংখ্য 'কঙ্কাল' আমাদের কণ্ঠহার হয়ে কীভাবে দৃশ্যমান তা দেখিয়ে দেয়। গল্পটি পাঠের পর অন্তরচোখে তাকালে দেখবেন আমাদের জীবনের সর্বত্র প্রাণহীন, অস্থিচর্মসার বেশুমার সামাজিক কঙ্কাল- তা নিয়েই জীবন ও যাপনে মানুষ দিশেহারা। প্রেমহীন সম্পর্কের কঙ্কাল নিয়ে কৃত্রিম এক দাম্পত্য জীবন বয়ে চলেছি আমরা। হত্যা করছি সেই নারী কিংবা পুরুষকে যার জন্য একদিন অস্তিত্ব বিসর্জন দেওয়াও ছিল অতি সাধারণ বিষয়। এই কঙ্কাল সমাজের প্রেমিক-প্রেমিকা, স্বামী-স্ত্রী, পিতা-মাতা, সন্তানের গলায় ঝুলে আছে। আমরা কেউ স্ত্রীকে হত্যা করছি, কেউ একই ছাদের নিচে প্রেমহীন এক অস্বাভাবিক আত্মপ্রতারণার আশ্রয়ে শূন্যতায় ঝুলে বেঁচে আছি। কুসংস্কার কঙ্কালের স্তূপ আমাদের ব্যবহারিক জীবনের প্রতিটি আচরণে 'দাঁত-কটি মেলিয়া দেখা' দিলেও আমরা তা সরানোর তাগিদ বোধ করছি না। ফতোয়াবাজি কঙ্কাল জীবনের অমিত সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করছে; প্রথার, শাস্ত্রের কঙ্কাল জীবনের পথকে কণ্টকাকীর্ণ করে তুলেছে। নীতিহীন রাজনীতির কঙ্কাল গলায় সুবেশ সমাজ-রাষ্ট্র সেবকের নখরে ছিন্নভিন্ন জাতীয় জীবনের সম্ভাবনাময় অগ্রগতির বাড়ন্ত লতা। গণতন্ত্রের হাড়হাড্ডির মালা জপে বড় ক্লান্ত আমরা। সমাজপদ্ধতি রূপ পাঁচ হাজার বছরের ক্ষয়িষ্ণু কঙ্কাল কোলে নিয়ে পরম মমতায় তাকে আঁকড়ে ধরে আমরা বাঁচার কসরৎ করছি ক্রমবিবর্তনশীল বিজ্ঞানভিত্তিক মস্তিষ্ক শক্তির ওপর নির্ভরশীল রোবটিক সময়-বৃত্তে। আর এই সমাজেরই উনিশ শতকীয় রূপ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আমাদের দেখিয়েছেন 'কঙ্কাল' গল্পের ক্যানভাসে। গল্প কঙ্কাল, যেন অস্থিচর্মসার বাঙালি সমাজের আরেক রূপ।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে