বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বিদ্রোহী কবি নজরুলের মা

জোবায়ের আলী জুয়েল
  ২৬ মে ২০২৩, ০০:০০

নজরুলের পিতা কাজী ফকির আহমদের সঠিক জন্ম তারিখ পাওয়া যায় না। তিনি বাংলা ১৩১৪ সালের ৭ চৈত্র ইংরেজি ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে পরিণত বয়সে পরলোক গমন করেন। বয়স হয়েছিল ষাট বছর। তিনি আরবি, ফারসি জানতেন- তবে তার বাংলা ও উর্দু ভাষার ওপর রীতিমতো দখল ছিল। তার হস্তাক্ষর ছিল অতীব সুন্দর। চুরুলিয়া অঞ্চলের নামকরা দলিল লিখিয়ে ছিলেন তিনি। উচ্চাঙ্গের মিলাদ পাঠক বলেও তার সুনাম ছিল। কাজী ফকির আহমদের পিতার নাম কাজী আমিনুলস্নাহ।

কাজী ফকির আহমদ সুপুরুষ ছিলেন। পিতার ওয়ারিশ সূত্রে প্রায় চলিস্নশ বিঘার মতো চাষের জমি পেয়েছিলেন। কিন্তু শেষ বয়সে এক বসতবাড়ি ছাড়া তার বিষয় সম্পত্তি কিছুই ছিল না। তবে বিষয় সম্পত্তি হাতছাড়া হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ছিল পাশাখেলা। এই খেলা তাকে প্রবল ভাবে পেয়ে বসেছিল। তার এই পাশা খেলার অন্যতম জুড়ি ছিলেন মহানন্দ আশ নামক এক বণিক, তার কাছেই কাজী ফকির আহমদ তার বেশির ভাগ সম্পত্তি হেরেছেন পাশা খেলায়।

কাজী ফকির আহমেদ প্রথম স্ত্রীর নাম কাজী সৈয়দা খাতুন। তিনি চুরুলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। তার গর্ভে একমাত্র কন্যা সাজেদা খাতুন। সৈয়দা খাতুনের মৃতু্যর পর ফকির আহমদ বিবাহ করেন জাহেদা খাতুনকে। তিনি চুরুলিয়ার পার্শ্ববর্তী ভূড়ি গ্রামের উচ্চ বংশজাত মহিলা ছিলেন। তিনি অতি দয়াবতী রমণী ছিলেন। জাহেদা খাতুনের গর্ভে তিন পুত্র এবং এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়। কাজী সাহেব জান, কাজী নজরুল ইসলাম, কাজী আলি হোসেন ও বোন উম্মে কুলসুম। কাজী সাহেব জান পিতার দারিদ্য বশত উচ্চশিক্ষা লাভের সুযোগ পাননি। পিতার মৃতু্যর পর অন্ন সংস্থানের জন্য রানীগঞ্জের কয়লা খনিতে চাকরি নিয়ে ছিলেন। দীর্ঘদিন কয়লা খনিতে নিযুক্ত থাকায় তার স্বাস্থ্য ভঙ্গ হয় এবং অসুখে ভুগে পঞ্চাশ বছর বয়সে পরলোক গমন করেন। কাজী সাহেব জানও অবসরে দলিল লেখকের কাজ করতেন।

কাজী আলি হোসেন পড়াশুনা করেন কাজী পাড়ায় মক্তবে। পারিবারিক সূত্রে দলিল লেখকের কাজে পরবর্তীকালে নিযুক্ত হন এবং আইন আদালত বিষয়ে পাকাপোক্ত হয়ে ওঠেন। এলাকার কৃষক- শ্রমিকদের হয়ে সমাজ সেবকের কাজ করতে গিয়ে গ্রামের তৎকালীন জমিদার জোতদারদের রোষানলে পড়েন এবং ১৯৫১ সালের ৭ জানুয়ারি নিজ গ্রামে প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হন।

কাজী নজরুল কিশোর বয়সে সেই যে গৃহত্যাগ করলেন তারপর মায়ের সঙ্গে দেখা হয় তার দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর পর পল্টন থেকে ফিরে। ১৯২০ সালে একবার চুরুলিয়ায় গেলে সেখানে সপ্তাহ কাল ধরে অবস্থান করেন তিনি। এ সময় মায়ের সঙ্গে তার নানা বিষয়ে অনেক আলাপ হয়। শেষে কথায় কথায় ভীষণ ঝগড়া বেঁধে যায়। এই ঝগড়ার কারণ জানা যায়নি। নজরুল ও পরবর্তী সময়ে এ বিষয়ে কাউকে কিছু বলেননি। ঝগড়ার পর তিনি বাড়ি ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন। এরপর তার মা যতদিন জীবিত ছিলেন কত অনুরোধ করেছেন কত আব্দার ধরেছেন ছেলেকে এক নজর দেখার জন্য কিন্তু নজরুলের জেদ আর অভিমান এতটা তীব্র ছিল যে মায়ের অনুরোধ তিনি আর রাখেননি। ইহকালে মায়েরও আর ছেলের মুখ দেখা হয়নি।

শোনা যায়, নজরুলের মা জাহেদা খাতুন ছিলেন অপূর্ব সুন্দরী। সে সময় তাঁর বয়সও ছিল কম। একজন বয়স্কা সুন্দরী বিধবা রমণী সম্মানের সঙ্গে নিজের ইজ্জত আব্রম্ন রক্ষা এবং নিজের ও সন্তানদের ভরণপোষণের নিশ্চয়তার জন্য যদি মৃত স্বামীর ভাইকে বিয়ে করেই থাকেন তাহলে অবস্থার প্রেক্ষাপটে সেটাকে কোনো অন্যায় বলা চলে না। তা ছাড়া ইসলামের দৃষ্টি কোণ থেকে এ ধরনের বিয়েকে বরং উৎসাহিতই করা হয়েছে। তবে একথা মিথ্যে নয় যে, উভয় বঙ্গের গ্রামীণ পরিবেশের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থা এতটাই অনুদার যে, সম্পূর্ণ বৈধ হলেও এ ধরনের বিয়েকে অনেকে কিছুটা হেয় চোখেই দেখে থাকে। সম্ভবত, নজরুল ও সেই মানসিকতার ঊর্ধ্বে উঠে মায়ের দ্বিতীয় বিয়েকে মেনে নিতে পারেননি। এমন ও হতে পারে নজরুলকে তার মায়ের দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে কেউ হাসি-মসকরা করেছিল- যা তার মনে গেঁথে গিয়েছিল এবং যা তিনিই কখনোই ভুলতে পারেননি।

তবে মায়ের সঙ্গে নজরুলের ঝগড়া এবং অভিমানের কারণ জানা না গেলেও অনুমান করা শক্ত নয় যে, মায়ের কোনো আচরণের নজরুল একটা প্রচন্ড মানসিক আঘাত পেয়েছিলেন- যার দরুন আর কোনো দিন চুরুলিয়া ফিরে যেতে রাজি হননি। এমন কি ১৯২৮ সালের ৩০ মে চুরুলিয়ায় মায়ের মৃতু্যর খবর পেয়েও নজরুল গ্রামের বাড়িতে যাননি। শেষবারের মতো মায়ের মুখ খানি দেখেননি। অবশেষে একবুক কষ্ট নিয়ে জাহেদা খাতুন এ পৃথিবী থেকে চিরবিদায় গ্রহণ করেছেন। মা জাহেদা খাতুন পুত্র নজরুলকে এক নজর দেখার জন্য অন্তিম বাসনা প্রকাশ করেছিলেন। জাহেদা খাতুনের মাতৃ হৃদয়ের এই অতৃপ্ত হাহাকার কি নজরুল জীবনে কোনোই প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেনি? কে জানে নজরুলের ৩৪ বছরের জীবন্ত-মৃত অবস্থার জন্য তার মায়ের অতৃপ্ত আত্মার অভিশাপই দায়ী কিনা। জীবদ্দশায় কবি কখনোই এ সম্পর্কে মুখ খোলেননি। ফলে নজরুলের জীবনে এটি আজো অমীমাংসতি অধ্যায় হিসেবেই রয়ে গেছে। অভিমান বশে মায়ের সঙ্গে নজরুল সম্পর্ক ছিন্ন করলেও পরবর্তী সময়ে নজরুলের বুভুক্ষু মন কিন্তু সবর্দা কাঙালের মতো কেঁদে ফিরেছে মাতৃস্নেহের সামান্যতম পরশ পাওয়ার জন্য। তাই আমরা দেখতে পাই বিভিন্ন সময়ে কতিপয় মহীয়সী নারীকে তিনি প্রাণ ভরে মা বলে সম্মোধন করেছেন। তাদের কবি যেমন মায়ের মতোই অন্তর দিয়ে ভক্তি শ্রদ্ধা করেছেন। তেমনি তারাও তাকে পুত্রবৎ স্নেহ করেছেন। নজরুলের মা সম্মোধনে যারা ধন্যা হয়েছিলেন তাদের মধ্যে দৌলতপুরের আলী আকবর খানের মেজো বোন নার্গিসের খালা আম্মা এখতারুন্নেসা খানম, বিপস্নবী হেমপ্রভা দেবী, হুগলীর মিসেস এম রহমান, কুমিলস্নার বিরজা সুন্দরী দেবী এবং দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের স্ত্রী বাসন্তী দেবী অন্যতমা, নজরুল নার্গিসের বিয়ের ব্যাপারে যখন খাঁ পরিবারের সবাই ছিলেন গররাজি তখন এই এখতারুন্নেসাই সবার ওপরে প্রভাব বিস্তার করে সেই বিয়েকে সম্ভব করে তুলেছিলেন। ১৯২১ সালের ১৭ জুন নজরুলের সঙ্গে নার্গিস বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন (বিয়ে নিয়ে অনেক মতানৈক্য আছে)। এ সময় এখতারুন্নেসা খানম মায়ের মতোই নজরুলের সব আব্দার পূরণ করতেন। এখতারুন্নেসা ছাড়া আর কাউকে কবি পাত্তাই দিতেন না। নজরুলকে তিনি এতটা আপন করে নিয়েছিলেন যে, ভাইদের কাছে প্রাপ্য তিনি তার পৈত্রিক সম্পত্তি নজরুলের নামে লিখে দেওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি ছিলেন নিঃসন্তান।

বহুনারীর মাতৃস্নেহ আদর, মমতা, শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা পেয়েছেন কবি। এমনি ধরনের আরেক অগ্নিকন্যা হেম প্রভাবকে নজরুল 'মা' বলে ডাকতেন। এই হেমপ্রভাকে নিয়ে কবি রচনা করেন 'হৈমপ্রভা' কবিতাটি। ১৩৩২ বঙ্গাব্দের ২৯ ফাল্গুন কবি মাদারীপুরে মৎস্যজীবী সম্মেলনে অংশগ্রহণ করেন। প্রগতিশীল শান্তি আন্দোলন ও নারী জাগরণের অগ্রসেনানী হেমপ্রভাও ওই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। কবি এই মহীয়সী নারীকে নিয়ে ১৯২৬ সালে রচনা করেন হৈমপ্রভা কবিতাটি।

কোন অতীতের আঁধার ভেদিয়া

আসিলো আলোক জননী।/প্রভায় তোর উদিল প্রভাত

হেমপ্রভা হল ধরণী/এসো বাংলার চাঁদ সুলতানা

বীর মাতা বীর জায়া গো।/তোমাতে পড়েছে সকল কালের

বীর নারীদের ছায়াগো/শিব সাথে সতী শিবানী সাজিয়া

ফিরছি শ্মশানে জীবন মাগিয়া,/তব আগমনে নব বাঙালীর

কাটুক আঁধার রজনী

(সংক্ষেপিত)

প্রমীলা নজরুলের বিয়ে হয় ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল, তাদের যখন বিয়ে হয় তখন প্রমীলার বয়স ১৪ আর নজরুলের ২৩। মানিকগঞ্জ জেলার শিবালয় উপজেলার ঐতিহ্য বাহী তেওতা গ্রামে প্রমীলা সেন গুপ্তার জন্ম। পিতার নাম বসন্ত কুমার সেন গুপ্ত। নজরুলের শাশুড়ির নাম গিরিবালা দেবী। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণের মেয়ে। নজরুল তার নিজের শাশুড়ি গিরিবালা দেবীকে কোনো দিন মা বলে ডাকেননি। তাকে ডাকতেন মাসিমা বলে। তিনি নজরুলকে সম্মোধন করতেন নুরু বলে। শ্রীযুক্ত গিরিরবালা দেবী তার স্বামী বসন্ত কুমার সেন গুপ্তের দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী ছিলেন এবং একটি মাত্র সন্তান প্রমীলা জন্মাবার পরেই তিনি বিধবা হয়েছিলেন। তার স্বামী বসন্ত কুমার সেন গুপ্তের প্রথমা স্ত্রী বর্তমান থাকা অবস্থাতেই তিনি গিরিবালা দেবীকে বিয়ে করেছিলেন। গিরিবালা দেবীর 'জা' ছিলেন বিরজা সুন্দরা দেবী।

প্রমীলার জেঠী বিরজা সুন্দরী দেবীকে যে নজরুল 'মা' বলে সম্মোধন করতেন সে কথা তো সবারই জানা। তিনিই নজরুলকে হুগলী জেলে নিজ হাতে লেবুর রস পান করিয়ে দীর্ঘ ৩৯ দিনের অনশন ভঙ্গ করিয়ে ছিলেন। সেদিন নজরুলের অনশন ভাঙিয়ে জেল থেকে বাইরে এসে অপেক্ষামান জনতার উদ্দেশে বিরজা সুন্দরী দেবী বলেছিলেন- 'খাইয়েছি পাগলকে, কথা কি শোনে। বলে না, অন্যায় আমি সইব না' শেষ পর্যন্ত আমি হুকুম দিলাম, আমি 'মা'। মার আদেশ সব ন্যায় অন্যায় বোধের ওপরে। লেবুর রস খাইয়ে এসেছি।' ১৯২৬ সালের অক্টোম্বর মাসে প্রকাশিত হয় কবির বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ 'সর্বহারা'। কবি এই গ্রন্থটি বিরজা সুন্দরী দেবীকে উৎসর্গ করেন। উৎসর্গ কবিতাটিতে নজরুল লিখেন-

'মা (বিরজা সুন্দরী দেবী)র শ্রী চরণার বিন্দে'

সর্বসহা সর্বহারা জননী আমার।/তুমি কোনো দিন কারো করনি বিচার।

কারেও দাওনি দোষ, ব্যথা বারিধির/কুলে বসে কাঁদো মৌনা কন্যা ধরণীর।/হয়তো ভুলেছো মাগো, কোন একদিন,/এমনি চলিতে পথে মরু-বেদুইন।/শিশু এক এসেছিল, শ্রান্ত কণ্ঠে তার

বলেছিল গলা ধরে 'মা হবে আমার?'

বিরজা সুন্দরী দেবী সপরিবারে কলকাতা চলে আসার পর কবি নিয়মিত তার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। ১৯৩৮ সালে কলকাতায় এই মহীয়সী নারী দেহ ত্যাগ করেন। নজরুল এ সময় তার শয্যাপাশে উপস্থিত ছিলেন।

বহরমপুর জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর যে পরিবারের সঙ্গে কবির পরিচয় হয়, সে পরিবারের কর্ত্রী সুনীতি বালাকেও কবি মায়ের আসনে রাখেন। নজরুল জীবনে সাহিত্য যেমন ছিল। ঠিক তেমনটি ছিল নারীর অবদান। কবি তার সুখ-দুঃখ অভিমান মুখে প্রকাশ না করে সাহিত্যের মাঝে তুলে ধরেছেন। মায়েদের নিয়ে লিখেছেন একের পর এক কবিতা। এই কবির সাহিত্য মানেই নারীর অবদান। এটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

হুগলীর এক মহীয়সী নারী বিশিষ্ট সমাজ সেবিকা এবং লেখিকা মিসেস এম রহমানকেও নজরুল অপরিসীম শ্রদ্ধা ভক্তি করতেন। তাকেও মা বলে ডাকতেন। তার প্রকৃত নাম মোছাম্মদ মাসুদা খাতুন। জন্ম ১৮৮৪ সালে। হুগলীর সরকারি উকিল খান বাহাদুর মজহারুল আনওয়ার চৌধুরীর কন্যা এই মিসেস এম রহমান নজরুর ইসলামকে বিশেষ স্নেহ করতেন। তার স্বামী ছিলেন স্বনামধন্য বিখ্যাত সাংবাদিক ও সাহ্যিতিক মুজিবর রহমান। সেকালে যা ছিল অস্বাভাবিক চিন্তা হিন্দু মেয়ে প্রমীলা ও মুসলমান ছেলে নজরুলের মধ্যে বিয়ে। বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে নজরুল প্রমীলার ক্ষেত্রে তিনি তাই বাস্তাবায়ন করেন। কলকাতায় নজরুল-প্রমীলার বিয়ে হয় ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল। বিয়ের পর নব দম্পত্তির বসবাসের জন্য তিনিই হুগলীতে নজরুলকে বাসাভাড়া করে দেন। এই বিদুষী মহিলা ১৯২৬ সালের ২০ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। তার মৃতু্যতে শোকাহত নজরুল রচনা করেন 'মিসেস এম রহমান' নামের বিখ্যাত কবিতাটি। কবিতাটির শেষ পদের ৬টি চরণ এখানে তুলে ধরা হলো-

তোমার মমতা মানিক আলোকে চিনিনু তোমারে মাতা,

তুমি লাঞ্ছিতা বিশ্ব-জননী! তোমার আঁচল পাতা।

নিখিল দুঃখী নিপীড়িত তরে, বিষ শুধু তোমা দহে,

ফনা তব মাগো পীড়িত নিখিল ধরণির ভার বহে।

আমারে যে তুমি বাসিয়াছ ভালো ধরেছ অভয়-ক্রোড়ে,

সপ্ত রাজার রাজৈশ্বর্য মানিক দিয়াছ মোরে।

এই কবিতার প্রতিটি ছত্রে যেন মাতৃশোকে বিহ্বল কবির কান্না উথলে উঠেছে। এ সময় নজরুল ইসলাম সওগাত সম্পাদক মোহাম্মদ নাসিরুউদ্দীনকে একটি পত্রে লিখেছিলেন মা'র (মিসেস এম. রহমান) মৃতু্য সংবাদ পেয়ে আমার সবকিছু গুলিয়ে গেল। বাড়িতে কান্নাকাটি পড়ে গিয়েছিল। আপন পেটের ছেলে চেয়েও বেশি স্নেহ করতেন আমায়। আমি তার প্রতিদানে কিছুই দিতে পারিনি। আমি আজ দেউলিয়া যেন জীবনের জোয়ার-ভাটা দেখছি শুধু।

এখানে উলেস্নখ্য, নজরুল যখন একজন পাতানো মায়ের মৃতু্যতে শোকের বন্যা বইয়ে দিচ্ছেন তখন গর্ভধারিণী মায়ের কোনো খোঁজখবর রাখারও প্রয়োজন মনে করছেন না। এ সময়ে কবির নিজের 'মা' জীবিত ছিলেন। নজরুলের 'মা' জাহেদা খাতুন মারা যান ১৯২৮ সালের ৩০ মে।

এই সময় আরেকজন মহীয়সী নারীকে তিনি প্রাণ ভরে 'মা' বলে সম্মোধন করতেন। তিনি হচ্ছেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সহধর্মিণী বাসন্তী দেবী। তিনিও তাকে সন্তানতুল্য স্নেহ করতেন। দেশ বন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের (জন্ম ১৮৭০ খ্রি. মৃতু্য ১৬ জুন ১৯২৫ খ্রি.) বাড়িতে গেলে বাসন্তী দেবী নিজ হাতে খাবার পরিবেশন করে কাছে বসে কবিকে খাওয়াতেন।

দেশ বন্ধুর মৃতু্যর পরে কবি নজরুল শোকগাথামূলক যে চিত্তনামা কাব্যগ্রন্থটি রচনা করেন সেটিও উৎসর্গ করেছিলেন বাসন্তী দেবীর নামে 'ইন্দ্র পতন' কবিতায় নজরুল চিত্তরঞ্জন দাসের মৃতু্যকে স্মরণ করে লিখেলেন-

জন্মিলে তুমি মোহাম্মদের আগে, হে পুরুষ বর!

কোরানে ঘোষিত তোমার মহিমা, হতে পয়গাম্বর!

যে জ্যোতি পারেনি সহিতে স্বয়ং মুসা ও কোহ-ই তুরে,

সেই জ্যোতিঃ তুমি রেখেছিলে তব নয়ন মণিতে পুরে।

(সংক্ষেপিত)

যাই হোক, আমরা দেখতে পাচ্ছি মায়ের মৃতু্য সংবাদ শুনে, যিনি গ্রামের বাড়িতে যাননি, তিনিই আবার পাতানো মায়ের মৃতু্যতে কেঁদে বুক ভাসাচ্ছেন।

অদ্ভুত রহস্য ভরা এই মানুষের মন। খেয়ালী কবি নজরুলের খামখেয়ালি তো আর কম ছিল না। কে জানে মায়ের সঙ্গে বিরোধ জিইয়ে রেখে মাকে কষ্ট দিয়ে নিজে কষ্ট পেয়ে অন্য মহিলাদের প্রাণ ভরে 'মা' ডেকে তার বুভুক্ষু হৃদয়ের মাতৃস্নেহের তৃষ্ণা মেটানোর বিষয়টিও তেমনি খেয়ালিপনা ছিল কিনা।

উপরোক্ত আলোচনা থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে, চির ক্ষুব্ধ, চির অভিমানী খেয়ালি নজরুল নিজের মায়ের থেকে দূরে সরে গিয়ে মাতৃস্নেহ পাওয়ার জন্য উন্মাদের মতো ছুটে বেরিয়েছেন এবং যার কাছেই সে স্নেহটুকু পেয়েছেন তাকেই হৃদয়ের সবটুকু শ্রদ্ধা, ভালোবাসা উজাড় করে দিয়ে প্রবল আবেগে আঁকড়ে ধরেছেন। কিন্তু এতদসত্ত্বেও এই পাতানো নকল মায়েরা কি মাতৃস্নেহের কাঙাল কবির মায়ের অভাব সবটুকু পূরণ করতে পেরেছেন কী ?

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে