শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নজরুলের জেলজীবন

ধূমকেতুর একটি সংখ্যায় কবি নজরুল দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বললেন, 'সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ টরাজ বুঝি না, কেননা, এ কথাটার মানে এক এক মহারথী একেক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশিদের অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা, শাসনভার থাকবে ভারতীয় দের হাতো। তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে বুচকা পুঁটলি বেঁধে সাগর পাড়ি দিতে হবে।'
এস ডি সুব্রত
  ২৬ মে ২০২৩, ০০:০০

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সাম্যবাদের কবি, অসম্প্র্রদায়িক চেতনার কবি, বিদ্রোহের কবি। কেউ কেউ তাকে স্বাধীনতার কবি বলেও উলেস্নখ করেছেন। ভারতের আজাদি আর বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে নজরুলের কবিতা ও গান অনুপ্রেরণা দিয়েছে, সাহস ও শক্তি যুগিয়েছে। কবির বড় হওয়ার সময়টাতে বিশ্ব রাজনীতিতে পরিবর্তনের হাওয়া, সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতান্ত্রিক বিপস্নব, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা আন্দোলন। নজরুলের ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগদান এবং সেখান থেকে ফিরে এসে কলকাতায় কমরেড মুজাফ্‌ফর আহমদ ও দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের সাহচর্য তাকে মানবধর্মের পথে ধাবিত করে এবং সাহিত্যে মনোনিবেশ করেন। পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গেও যুক্ত হন। পত্রিকা এবং লেখালেখির কারণে নজরুলকে দু'বার কারাগারে যেতে হয়। প্রথমবার ১৯২৩ সালে কারাগারে যান ধূমকেতু পত্রিকায় 'আনন্দময়ীর আগমনে' এবং 'বিদ্রোহীর কৈফিয়ত' কবিতার জন্য। সে সময় এক বছরের জেল হয়, কিন্তু জেল খেটেছিলেন এগার মাস। দ্বিতীয়বার ১৯৩০ সালে 'প্রলয় শিখা' কাব্যগ্রন্থের জন্য। ১৯২২ সালের ১১ আগস্ট নজরুলের সম্পাদনায় ধূমকেতু পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ধূমকেতুতে কখনো লিখেন সম্পাদকীয়, কখনো কখনো কবিতা, আবার কখনো প্রবন্ধ। ধূমকেতুর একটি সংখ্যায় কবি নজরুল দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বললেন, 'সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ টরাজ বুঝি না, কেননা, এ কথাটার মানে এক এক মহারথী একেক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশিদের অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা, শাসনভার থাকবে ভারতীয় দের হাতো। তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে বুচকা পুঁটলি বেঁধে সাগর পাড়ি দিতে হবে।' নজরুলের এমন লেখা সম্পর্কে কমরেড মুজাফ্‌ফর আহমদ বলেন, অনেকে হয়তো নিজেদের বৈঠকখানায় বসে পরিপূর্ণ স্বাধীনতার ইচ্ছা পোষণ করেছেন। কিন্তু নজরুলের মতো এমন দ্ব্যর্থহীন ভাষায় খবরের কাগজে কেউ দেশের স্বাধীনতার কথা তুলে ধরেছিলেন তা আমার জানা নেই। নজরুল ধূমকেতুতে একটি কবিতা লিখেছিলেন, 'আনন্দময়ীর আগমনে'। কবিতার কিছু পংক্তি এরকম....'আর কতকাল থাকবে বেটি মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল?/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী ব্যক্তি চাড়াল।/দেব শিশুদের মারছে চাবুক বীর যুবকদের দিচ্ছে ফাঁসি, /ভূ-ভারত আজ কসাইখানা, আসবি কখন সর্বনাশী?/মাদিগুলোর আদি দোষ ঐ অহিংসা বোল নাকি নাকি/ খাড়ায় কেটে কর মা বিনাশ নপুংসকের প্রেমের ফাঁকি। /অনেক পাঁঠা মোষ খেয়ছিস রাক্ষুসী তোর যায়নি ক্ষুদা /আয় পাষাণী এবার নিবি আপন ছেলের রক্ত সুধা। /ময় ভূখাহুমায়ি বলে আয় এবার আনন্দময়ী

কৈলাস হতে গিরি রাণীর মা দুলালী কন্যা আয় !

আয় উমা আনন্দময়ী।'

ঊনআশি পংক্তির দীর্ঘ কবিতা। ভীরুদের প্রতি প্রচন্ড ধিক্কার ও ব্রিটিশদের প্রতি দুর্বার ঘৃণা আর দেশপ্রেমীদের বিদ্রোহের ডাক। সরকারের টনক নড়ল। পুলিশ আসল ধূমকেতু অফিসে। পত্রিকা বাজেয়াপ্ত হলো। কবিতা নিষিদ্ধ হলো। কবির বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা হলো। অনেকেই তাকে পালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিল। তিনি রাজি হলেন না। পরে অবশ্য কলকাতা পুলিশের চোখের আড়াল হয়েও রেহাই পাননি। কুমিলস্নার ঝাউতলা থেকে গ্রেপ্তার হলেন। নিয়ে আসা হলো কলকাতায়। বিচারের রায় হলো এক বছরের সশ্রম কারাদ-। কবিতা লেখার জন্য কোনো বাঙালির এই প্রথম কারাবরণ। বিচারাধীন অবস্থায় কয়েক মাস ছিলেন কলকাতার প্রেসিডেন্সি জেলে। আদালতে রাজবন্দি হিসেবে নজরুল যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন তা পরবর্তী সময়ে 'রাজবন্দির জবানবন্দি' নামে খ্যাত। পরে বদলি করা হয় আলীপুর সেন্ট্রাল জেলে কলকাতায়। জেলে বসে লিখেন বিখ্যাত কবিতা 'সৃষ্টি সুখের উলস্নাসে'।

'আজ সৃষ্টি সুখের উলস্নাসে/ মোর মুখ হাসে মোর চোখ হাসে মোর টগবগিয়ে খুন হাসে /আজ সৃষ্টি সুখের উলস্নাসে/.......বাঁধ ডেকে ঐ জাগল জোয়ার দুয়ার ভাঙ্গা কলেস্নালে!'/কলেস্নাল পত্রিকায় ছাপা হলো আটচলিস্নশ পংক্তির এই কবিতা।

মাস কয়েক পরে নজরুলকে বদলি করা হলো হুগলি জেলে। হুগলি জেলে নজরুলের রাজবন্দির মর্যাদা কেড়ে নেয়া হলো। রাখা হলো সাধারণ বন্দি হিসেবে। হুগলি জেলে নজরুল একটা গান রচনা করলেন রবীন্দ্রনাথের একটা দেশাত্মবোধক গানের প্যারোডি করে।

'তোমারি জেলে পালিছ ঠেলে তুমি ধন্য ধন্য হে

আমারি গান তোমারি ধ্যান তুমি ধন্য ধন্য হে।

রেখেছ শাস্ত্রী পাহাড়া দোরে

আঁধার কক্ষে জামাই আদরে

বেঁধেছ শিকল প্রণয় ডোরে

তুমি ধন্য ধন্য হে।'

হুগলি জেলে বসেই নজরুল লিখেছিলেন শিকল পরার গান।

'এই শিকল পরা ছল মোদের এ শিকল পরা ছল

এই শিকল পরেই শিকল তোদের করবরে বিকল।'

হুগলি জেলে নজরুল অনশন শুরু করেন। কেউ তার অনশন ভাঙাতে পারেননি। ক্রমশ স্বাস্থ্যের অবনতি হতে লাগল। শেষে ৩৯ দিনের মাথায় বিরজা সুন্দরী দেবীর অনুরোধে অনশন ভেঙ্গেছিলেন কবি।

এরপর কবিকে পাঠানো হলো বহরমপুর জেলে। সেখানে রাজবন্দির মর্যাদা দেয়া হলো। এখানে কবির পরম সঙ্গী হলেন নরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী। কবি সঙ্গীতবহুল ছোট একটা নাটক লিখেছিলেন এ জেলে বসে। এক বছরের মেয়াদ শেষ হলে বহরমপুর জেলে থেকে মুক্তি পায় ১৫ ডিসেম্বর। তাকে জেল খাটতে হয়েছিল বার মাসের পরিবর্তে এগার মাস।

নজরুলকে দ্বিতীয়বার কারাদন্ডের আদেশ হয় প্রলয় শিখা কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯৩০ সালে। বিশেষ করে প্রলয় শিখা কাব্যগ্রন্থের নবভারতের হলদিঘাট ও যতিন দাস কবিতার জন্য। তবে সেবার নজরুলকে জেল খাটতে হয়নি। হাইকোর্টে আপিল করলে কারাদন্ডের আদেশ স্থগিত হয়। প্রলয় শিখা ব্রিটিশ শাসকদের বিচলিত করে ফেলে। বইটির ২০টি কবিতায় প্রতিবাদের ঝড় ছিল। এর মধ্যে 'নবভারতের হলদিঘাট' ও 'যতীন দাস' নামের দুটি কবিতা শাসকদের কাছে বেশি আপত্তিকর লেগেছিল। আইন অমান্য আন্দোলন নিয়ে গান্ধী ডারউইন চুক্তির আওতায় সব রাজবন্দির সঙ্গে নজরুলও মুক্তি পান।

প্রলয় শিখা কাব্যগ্রন্থে কবির কণ্ঠে ধ্বনিত হয়।

'ভাঙ্গি মন্দির ভাঙ্গি মসজিদ

ভাঙ্গিয়া গির্জা গাহি সঙ্গীত

একই মানবের একই রক্তমেশা

কে শুনিয়ে আর ভজনালয়ের হ্রেষা।'

প্রলয় শিখা কাব্যগ্রন্থের 'নবভারতের হলদিঘাট' কবিতাটি বাঘা যতীনের বীরত্বগাথাকে কেন্দ্র করে রচনা করেছিলেন। কবিতার কিছু পংক্তি তুলে ধরা হলো

বালাশোর বুড়ি বালামের তীর /নবভারতের হলদিঘাট/

উদয় গোধূলি রঙ্গে রাঙ্গা হয়ে/ উঠেছিল যথা অস্তপাঠ/দেবকী মাতার বুকের পাথর/নড়িল কারায় অকস্মাৎ/বিনামেঘে হলো দৈত্যপুরীর /প্রাসাদে সেদিন বজ্রপাত/নাচে ভৈরব শিবানী প্রমথ/জুড়িয়া শ্মশান মৃতু্যনাট/বালাশোর-বুড়ি বালামের তীর/নব ভারতের হলদিঘাট/ভাবি ভারতের না চাহিতে আসা/নবীন প্রতাপ নেপোলিয়ন/ওই যতীন্দ্র রণোন্মত্ত/শনির সহিত অশনি রণ।/নবভারতের হলদিঘাট কবিতায় নজরুল বাঘা যতীনকে নেপোলিয়নের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

যতীন দাস কবিতায় নজরুল লিখেছেন-

আসিল শরৎ সৌরাশ্বিন/দেবদেবী যবে ঘুমায়ে রয়

পাষাণ স্বর্গ হিমালয় চূড়ে/শুভ্র মৌলি তুষারময়।/

/মহিষ ুঅসুর-মর্দিনী মাগো/জাগো এইবার খড়গ ধরো/দিয়াছি যতীন অঞ্জলী /নব- ভারতের আঁখি ইন্দিবর।

প্রলয় শিখা কাব্যগ্রন্থের উলিস্নখিত কবিতা দুটি ব্রিটিশ শাসকদের চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছিল। যার ফলে কবির বিরুদ্ধে কারাদন্ডের আদেশ হয়। অবশ্য এই কারাদন্ড থেকে শেষ পর্যন্ত নজরুল মুক্তি পেয়েছিলেন। দ্বিতীয়বার কারাদন্ডের আদেশ হলেও কারাবরণ করতে হয়নি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে