শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীনের শিল্পকর্মে গ্রামীণ জীবন

জোবায়ের আলী জুয়েল
  ০২ জুন ২০২৩, ০০:০০

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন আমাদের অহংকার, বাঙালির গর্ব। বাংলাদেশের মানুষ তাকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভালোবেসে উপাধি দিয়েছে শিল্পাচার্য। গ্রামীণ পটভূমিতে তার বিখ্যাত চিত্র কর্মগুলোর মধ্যে রয়েছে- দুর্ভিক্ষ, চিত্রমেলা, সংগ্রাম (গরু), ঝড়, মইটানা, গুনটানা, গাঁয়ের বধূ, বেঁদেনী, পাইন্যারমা, সাঁওতাল রমণী, মা, নদী ও নৌকা নিয়ে অনেক জলরঙ-ছবি। আদিবাসীদের জীবন ও প্রকৃতির ছবি, নবান্ন, ৬৫ ফুট দীর্ঘ আবহমান বাংলার এক বিশাল ছবি, '৭০-এর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের ছবি, মনপুরা-৭০, ৩০ ফুট দীর্ঘ এক মর্মস্পর্শী স্কেচ চিত্র এবং আরও অনেক ছবি। জয়নুল আবেদীনের ৮০০ শত ছবির সংগ্রহ রয়েছে বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরে।

সমগ্র পঞ্চাশ ও ষাটের দশক ধরে জয়নুল আবেদীনের কর্মে রিয়ালিজম, নান্দনিকতা পলস্নীর বিষয়বস্তু, আবহমান বাংলার গ্রামীণ জীবনের এক নিবিড় পটভূমির চিত্র তার শিল্প অনাবিল সৌন্দর্য নিয়ে ফুটে উঠেছে। প্রাকৃতিক ও মানুষের তৈরি প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামরত নরনারীর বলিষ্ঠ শারীরিক গঠন স্মরণ করিয়ে দেয় ব্যক্তিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে আধুনিকতাবাদের গুরুত্বপূর্ণ ধারণাকে। জয়নুলের কর্ম কেন্দ্রায়িত হয়েছে সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে গ্রামীণ নর-নারীর শ্রম ও সংগ্রাম ও সেই সঙ্গে তাদের ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে।

১৯৬৯ সালের গণ-অভু্যত্থানের বিজয়কে ভিত্তি করে আঁকা ৬৫ ফুট দীর্ঘ স্ক্রল পেইন্টিংয়ে চাইনিজ ইংক, জলরঙ ও মোমের ব্যবহার। গ্রামের বাহান্ন উৎসব এবং ১৯৭০ সালের প্রলঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারানো হাজারো গ্রামীণ মানুষের স্মৃতির উদ্দেশ্য আঁকা ৩০ ফুট দীর্ঘ 'মনপুরা' পেইন্টিংটির মধ্যে তার কর্মের বৈচিত্র্য লক্ষ্য করা যায়। তার চিত্রকর্মে ফুটে উঠেছে প্রকৃত ও মানবজীবনের চিত্র, গ্রাম্য পলস্নী রমণীর ব্যক্তিগত মুহূর্তের অন্তরঙ্গ দৃশ্য। তার শিল্পকর্মের পরিধি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে তিনি লোক শিল্পকলার সীমাবদ্ধতা উপলব্ধি করেছেন নিবিড়ভাবে। এখানে ডাইমেনশনের অভাব, আলো-আঁধারির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক অনুপস্থিত এবং তাদের গতিময়তার অভাব লক্ষ্যণীয়। এ সীমাকে অতিক্রম করে জয়নুল আবার ফিরে যান প্রকৃতির কাছে, গ্রামীণ জীবনে। জীবনের দৈনন্দিন সংগ্রামের সঙ্গে রীতি-বৈচিত্র্যের সমন্বয় ঘটিয়ে যেখানে বাস্তবতা থাকবে মুখ্য কিন্তু অবয়ব হবে আধুনিক। জয়নুলের কাছে 'আধুনিকতাবাদ' বলতে শুধুই বিমূর্ততা ছিল না বরং তার কাছে আধুনিকতা শব্দটি ছিল সুগভীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য যেখানে গ্রামীণ সামাজিক উন্নয়ন ও ব্যাক্তিক প্রকাশই মুখ্য।

১৯৪৩ সালে সারা বাংলায় দুর্ভিক্ষ শুরু হয়। জয়নুল রাস্তায় পড়ে থাকা দুর্ভিক্ষের হাড্ডিসার মানুষের ছবি ও স্কেচ আঁকলেন। তার ছবিতে ফুটে উঠল গ্রামের বাস্তব চিত্র। এ ছবি গ্রামবাংলার জীবনের প্রতিচ্ছবি। মানুষ আর কুকুরের একই ডাস্টবিন থেকে খাবার কুঁড়ে খাচ্ছে। কাক ও শকুন ঠুকড়ে খাচ্ছে মানুষের লাশ। এসব ছবি এতো বাস্তব, জীবন্ত ও করুণ যে, মানবতাবাদী শিল্পী হিসেবে দেশ-বিদেশে তার খ্যাতি ও সুনাম ছড়িয়ে পড়ল। চিত্র কর্মগুলো জয়নুলকে ভারতব্যাপী খ্যাতি এনে দেয়। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা এগুলো মানুষের দুর্দশা, কষ্ট ও প্রতিবাদকে সামনে এনে বাস্তবধর্মী চিত্র অঙ্কনে তার স্বকীয়তাকে বিকশিত করে।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম তমিজউদ্দিন আহমদ। মাতার নাম জয়নাবুন্নেসা। জয়নুল ১৯৪৮ সালে ঢাকা প্রতিষ্ঠা করেন আর্ট ইনস্টিটিউট। ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এই ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ পদে অভিষিক্ত থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে সুন্দরভাবে গড়ে তোলেন। ১৯৭৪ সালে দিলিস্ন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করেন।

জয়নুল আবেদীন অনেক জাতীয় দায়িত্ব পালন করে গেছেন। শহীদ মিনার, সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধ ও শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা তারই স্বপ্ন ও উদ্যোগের ফসল। সোনার গাঁয়ে লোক শিল্প জাদুঘরও তিনি প্রতিষ্ঠা করেন।

শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন বাংলাদেশের গ্রামকে ভালোবাসতেন। তাই তিনি বার বার এই দেশের মানুষের গ্রামীণ জীবনের পটভূমি ও তাদের সুখ-দুঃখের ছবি এঁকেছেন। তিনি কঠোর শ্রম দিয়ে গড়ে তোলেন ঢাকা আর্ট কলেজ।

জয়নুল আবেদীন ১৯৭৬ সালের ২৮ মে দুরারোগ্য ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় মৃতু্যবরণ করেন। মৃতু্যকালে তার বয়স হয়েছিল ৬২ বছর। তারই প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা ঢাকা আর্ট কলেজের প্রাঙ্গণে তাকে সমাহিত করা হয়। তিনি সেখানেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে