শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১

হাবিবুল হাসানের উপন্যাস :স্বাতন্ত্র্যের সন্ধান

সরকার মাসুদ
  ০২ জুন ২০২৩, ০০:০০

কবি থেকে চিত্রনির্মাতায় বিবর্তিত হওয়ার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আছে, যেমন বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত কিন্তু নাট্যকর্মী থেকে ঔপন্যাসিক ও কবিতে লক্ষণীয়ভাবে বিবর্তিত হওয়ার উদাহরণ বাংলাদেশে একজনই, তিনি হাবিবুল হাসান। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হাবিবুল হাসান সত্তরের দশকে আবির্ভূত হন নাট্যঅভিনেতা ও নাট্যকাররূপে। তার কয়েক বছরের মধ্যে ব্যতিক্রমী অভিনয় এবং অপ্রচল ভাবনাঋদ্ধ একাধিক টেলিভিশন নাটক রচনার জন্য ভিন্ন ধাঁচের শিল্পী হিসেবে স্বীকৃতিও পান। এই খ্যাতি তিনি ভোগ করেছেন বহু বছর। যুক্ত ছিলেন ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গেও। পৃথিবীর অনেক বড় মাপের শিল্পীর মতো হাবিবও এতেই তুষ্ট থাকলেন না। খুঁজলেন আত্মপ্রকাশের ভিন্ন মাধ্যম। রাতদিন লিখে চললেন। নব্বই দশকের মাঝামাঝি প্রকাশ পেল তার প্রথম উপন্যাস 'তোমার মুখের ছবি।' পরে আরও তিনটি উপন্যাস বেরিয়েছে। সেগুলো হচ্ছে 'লতা খন্দকারের নিজস্ব জীবন (১৯৯৭), 'বাংলাদেশের ধ্বংসাবশেষ (২০০৯), তখন সে আমাকে শাড়ি আর ফুল কিনতে শিখিয়েছিল' (২০১৬)। এছাড়া অংকুর' (১৯৯৪) ও 'আমার কবিতার মতো প্রধানমন্ত্রী নেই' (২০০৮) শিরোনামে তার দু'টি কাব্যগ্রন্থও আছে।

হাবিবুল হাসানের উপন্যাস নিয়েই আজকের এই আলোচনা। প্রথম উপন্যাস 'তোমার মুখের ছবি' (১৯৯৫)-এর ভিন্নধর্মী প্রচ্ছদে গ্রন্থনামের নিচেই 'একটি আত্মজীবনীমূলক তথ্যভিত্তিক উপন্যাস কথাগুলো লেখা হয়েছে। হঁ্যা, বইটি আত্মজীবনীমূলক বটে। তথ্যও আছে। সবচেয়ে বেশি আছে আত্মকথন। কথনভঙ্গিটি স্মৃতি, বিশ্লেষণ, শিল্প ও জীবনসম্পর্কিত গূঢ় ভাবনা, অনিকেত পরিস্থিতিজাত অনুভব প্রভৃতি মিশেলে গড়ে উঠেছে। লেখক এমনভাবে, এমন ভাষায় সবকিছু বলছেন, একটানা বলে যাচ্ছেন যেন সামনে একজন শ্রোতা বসে আছেন। আবার উপন্যাসের শেষে ইতি হাবিবুল হাসান, ঢাকা, বাংলাদেশ। লেখা আছে। এর অর্থ, এই গ্রন্থ একটা সুদীর্ঘ চিঠির মতো করে লেখা হয়েছে এমন বোঝাতে চাইছেন গ্রন্থকার। শ্যামলিস্থ নিজেদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসার পর বাসাবো, পুরান ঢাকা, ফার্মগেট কত জায়গায় তিনি কত রকম মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, ভালো-মন্দ কত কিছু তার মনে গাঢ় ছাপ ফেলেছে এসব চিত্তস্পর্শী হয়ে উঠেছে এই গ্রন্থে। কয়েকটি জায়গা থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করছি -

১। এই মিথ্যে ডায়েরি ও হাত আমি একদিন পুড়িয়ে ফেলব। আমি সিলভিয়া পস্নাথের মতো মরে যাব, আমি কবি সুলতানের মতো শুধু মরিয়মকে নিয়ে লিখব। আমি কেউ নই। আমি বস্তুত তোমার হতে চাই। (পৃ:১৭)।

২। জহরদার (চিত্রপরিচালক জহিরুল হক) ওই চলে যাওয়া থেকে আমার মনে হয়েছিল একটা মানুষ কত একা। নদীর তীর ধরে তার চলে যাওয়া আর শেষ পাই। এসব চলে যাওয়া আমার প্রেমের সঙ্গে যুক্ত হয় (পৃ:৩৬)

৩। প্রযুক্ত ও ক্ষমতা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একটা বিশেষ শ্রেণির প্রাচুর্য, অহেতুক উন্মাদনা ও নানাকরম উচ্চাকাঙ্ক্ষিত ও অস্ত্রব্যবসার ক্ষেত্র তৈরির পক্ষে কাজ করেছে। (পৃ:১৮)

৪। মানুষ যে যা করে তাকেই শ্রেষ্ঠ ও প্রয়োজনীয় ও মনে করতে পারে। এটা তার গুণও হতে পারে। কিন্তু ক্ষেত্রবিশেষে তার গুণই তার দোস হয়ে যেতে পারে। (পৃ:২৪)

কবি জীবনানন্দ দাশ 'অপ্রেম' শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন অনেকবার। 'তোমার মুখের ছবি' একটি সুন্দর, অপ্রেমের উপন্যাস যার ভেতর প্রেমের অনুভব, জীবনদর্শন, জীবন সমালোচনা, নিঃসঙ্গতা, মৃতু্যভাবনা ইত্যকার বহুকিছুর আছে। ওইযে ৪১ নং পৃষ্ঠার একস্থানে লেখক শেষের কবিতা প্রসেঙ্গ বলছেন অমিত আর লাবণ্য আসলে, এখন বলছি, বিশেষ করে অমিতের মধ্যে প্রেমের যে আধুনিক, দার্শনিকও ধরা-ছোঁয়ার বাইরের স্বাপ্নিক রূপ ধরা পড়েছে তা প্রেমের একটি আধুনিক ও নান্দনিক রূপ যা মানুষ আবিষ্কার করেছে অনেক কিছু দিয়ে।' প্রেমের বা অপ্রেমের সেই 'আধুনিক ও নান্দনিক রূপই আমরা প্রত্যক্ষ করি 'তোমার মুকের ছবিতে'।

'লতা খন্দকারে নিজস্ব জীবন' উপনঅসের লিখনশৈলী প্রথমটির মতো নয়। এটা আগেরটির মতো উত্তম পুরুষে রচিত হয়নি। লতা নামের এক পূর্ণবয়স্ক নারীর জীবনের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, আকাঙ্ক্ষা-অভিরুচি, অনুভব ঔদাস্যের ভিন্নমাত্রিক প্রতিভাস এই উপন্যাস। লতা একজন উচ্চাশী কবি যিনি রবিশঙ্করের সেতার শোনেন, দেশি ও আন্তর্জাতিক অপরাজনীতর সমালোচনা করে, নানারকম অব্যবস্থাপনার কথা উলেস্নখ করেন, তসলিমা নাসরিন, হুমায়ন আজাদ প্রমুখ ও তাদের একপেশে পাঠকদের কান্ডজ্ঞানহীনতা তুলে ধরেন, অর্পণা সেনকে গৌতম ঘোষের চেয়ে অনেক বড় নির্মাতা মনে করেন আর ভাবেন সাহিত্যক্ষেত্রে তিনি নিজে একটা কান্ড ঘটিয়ে দেবেন। লতা খন্দকারের মধ্যে আমরা হাবিবুল হাসানের ছায়া অনেকখানিই দেখতে পাই।

লেখক তো বলেছেনই 'এই উপন্যারে প্রধান চরিত্র লতা ও হাবিবুল হাসান। লতার স্বামী সংসার আছে। স্বামী আতিফের সঙ্গে তার সম্পর্ক অম্স্ন-মধুর। সে ঠিক পতিপরায়না স্ত্রী নয়। কখনো কখনো সঙ্গমের 'গভীর তৃষ্ণা' জাগলেও শেষ পর্যন্ত স্বামীর ঘরে যায় না এবং নির্ঘুম রাত কাটায়। সে 'যৌনতা দিয়ে জীবনকে বুঝতে' চায় না। কিন্তু স্বামী-সন্তান সংসারের প্রতি তার টানও আছে। নানা বৈপরীত্য, ভাবমনস্কতা, দার্শনিকতা, নিঃসঙ্গতা-সঙ্গতা ও হর্ষ-বিষাদের চমৎকার সমন্বয় ঘটেছে এই চরিত্রটিতে। আতিফ, লিলি, বাবু, নীলকণ্ঠ প্রভৃতি চরিত্র যেন ড্রয়িংয়ের কয়েকটি অব্যর্থ আঁচড়ে অংকিত। লতা চরিত্রটিই সবচেয়ে ভালোভাবে চিত্রিত হয়েছে। আলাদা সত্তা আছে। আতিফের এই দৃষ্টিকোন লতার কাছে স্বচ্ছ ও স্বাভাবিক মনে হয়। তাই ওদের মধ্যে কোনো প্রকৃত বিরোধ নেই।' অন্যদিকে ১৯নং পৃষ্ঠায় লতা খন্দকার সম্বন্ধে লেখকের ভাষ্য; 'বনমালী তুমি পরজনমে হইয়ো রাধা... গানটির সঙ্গে লতা একমত নয়। লতার তো যুগে যুগে নারীই হতে ইচ্ছে করে এই ভারতবর্ষের হিমালয় পাহাড়ের এই ধারে; প্রকৃত কবিদের দেশে মৌসুমি বায়ু নিয়ন্ত্রিত এই মিঠা পানির অঞ্চলে।'

মানুষের ভাববিহবলতা, চিন্তা মগ্নতা- এক কথায় মনোজগতের যে ছবি এখানে আছে তা অনবদ্য। আর পারিবারিক যৌনতার যে বর্ণনা পরিবেশিত হয়েছে, যেভাবে যে ভাষায় হয়েছে তা মনে করিয়ে দেয়। বিশ্ববরেণ্য নির্মাতাদের চলচ্চিত্রের শয্যা-দৃশ্য।

প্রচলিত সংজ্ঞা অনুসারে 'বাংলাদেশের ধ্বংসবিশেষ'কে উপন্যাস বলা যাবে না। এখানে গল্পের আরম্ভ আছে, মাঝামাঝি অবস্থা ও পরিণতি নেই। সে অর্থে কোনো গল্পই নেই। তবে হঁ্যা, কোথাও কাথাও গল্পের স্বাদ পাওয়া যায়। গ্রন্থজুড়ে অসংখ্য ঘটনার উলেস্নখ্য আছে। এসব ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ ও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের অভিজ্ঞতা, অপরাজনীতি, ব্যক্তিগত নানা স্মৃতি, প্রশাসনের ঔদাসীন্য ইত্যাকার বহুকিছু। যেন অসংখ্য স্কেচের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে গ্রন্থটি। ভাঙা-ভাঙা গল্পের ভেতর দিয়ে বা বলা চলে গল্পের ছদ্মবেশে লেখক এখানে কঠিন সমালোচনা করেছেন। রাষ্ট্রযন্ত্রের কুকীর্তি, প্রশাসনিক দুর্নীতি, 'রানীর মতো প্রধানমন্ত্রী' (খালেদা জিয়া)'র ভন্ডামি, ক্ষমতালিপ্সু ও যেকোনো মূল্যে ক্ষমতা টিকিয়ে রাখা নেতা-পাতি নেতার ইতর কর্মকান্ড, ধর্মান্ধতা ও ধর্ম ব্যবসা, মার্কিন রাজনীতি ও আন্তর্জাতিক মোড়লদের মাতব্বরি... এ রকম বহু বিষয়ের দিকে আমাদের মনোসংযোগ ঘটাতে চেয়েছেন তিনি। 'বাংলা দেশের ধ্বংসবিশেষ' পড়তে পড়তে আমার মনে পড়েছে গুনআর গ্রাসের ঞযব ঋষড়ঁহফবৎ (রাঘব বোয়াল) উপন্যাসটির কথা সেটাকে সমালোচনা-উপন্যাস বলা চলে। আর এ জন্যই লেখক ১৮নং পৃষ্ঠায় লিখেছেন 'বর্তমানকালে বাংলাদেশে এ গ্রন্থ কেউ লিখবে না বা লিখতে পারবে না।' কেন না খালেদা-হাসিনা, তাদের গঠিত সরকার, তাদের অধীনে সংঘটিত দুর্নীতি... কোনো কিছুকেই ছেড়ে কথা বলেননি তিনি। লেখক যেমন ১৫ আগস্টকে খালেদা জিয়ার জন্মদিন বানানোর তীব্র নিন্দা করেছেন, তেমনি ভোটের স্বার্থে শেখ হাসিনার ধর্মের ইমেজকে (মাথায় কালো কাপড় বাঁধা) ব্যবহার করা ঠিক হয়নি সেকথাও বলেছেন।

সমালোচনা কীভাবে এসেছে এই গ্রন্থে তার আরও কিছু নমুনা:

ক. শুধু ক্ষমতার জন্য ক্ষমতায় থাকতে চেয়েছে যারা তারাইতো ধ্বংস করেছে বাংলাদেশ (পৃ: ১৩)

খ. অটল বিহারী বাজপেয়ী কি করেছেন? বাবরি মসজিদ আর রাম মন্দিরের রাজনীতি কোরে ক্ষমতায় এসেই তিনি বলেছেন: আমাদের সভ্যতার উৎস সিন্ধু সভ্যতা। এসব কথা আগে বলেননি কেন? বললে আর ক্ষমতায় আসা যেত না। কাজেই ক্ষমতায় এসেই তিনি লাল কুর্তা পরে মুসলমানদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গেছেন সেটা নিতান্তই লোক দেখানো (পৃ: ২৮)।

গ. বিএনপি যত বড় দলই হোক ঐতিহ্য ও ইতিহাসগত কারণে বিএনপি রাজনৈতিক দল নয়। ক্ষমতার ভেতর থেকে কোনো দল গঠন করলে সেটা রাজনৈতিক দল হয় না। (পৃ: ৩৭)

গ. এরা (তরুণ প্রজন্ম) ব্যান্ড শিল্পী জেমসের অটোগ্রাফ নেয়... বড় জোর টিভি স্টার তৌকির আহমেদকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর অল্প বয়সে প্রেমের নামে কত যে নিম্নমানের কাজ করে ওরা জানে না। এরা আইজেনস্টাইন, সত্যজিৎ রায়, অর্পণা সেন, অরুন্ধতি রায়ের খবর রাখে না। নাম শুনেছে শুধু রবীন্দ্রনাথের, ওই পর্যন্তই। রবীন্দ্র চর্চার শুদ্ধ সংস্কৃতি থেকে এরা অনেক দূরে শুধু ভরে তোলে দোকানপাট আর মেলা। (পৃ: ৪৫)

নিন্দা-সমালোচনার পাশাপাশি এই বইয়ে প্রশংসাও দেখতে পাচ্ছি : (১) শেখ হাসিনা একবার নিজে থেকেই কবিতা উৎসবের মঞ্চে উঠে এসেছিলে। এই যে একজন নেত্রী কবিতামঞ্চে কবি ও শিল্পীদের এত কাছে চলে এলেন, এই দৃশ্য সবটাই রাজনৈতিক নয়। (পৃ: ৩৮)

(২) বাংলাদেশের প্রথম নায়ক শেখ মুজিব। জলবায়ুর কেন্দ্রে ছিল তার উপস্থিতি। সাদা ঝকঝকে পাঞ্জাবিতে আর কালো মুজিব কোটে এত সুন্দর আর দেখায়নি কোনো বাঙালিকে। বিদেশিদের সঙ্গে যখন হেটে যেতেন তখন ওই সময়ে তাকেই সবচেয়ে মিষ্টি আর লম্বা দেখাত।' (পৃ: ৪৭)

আনন্দপ্রদ, ক্ষোভউদ্রেকী ও অভাবনীয় অনেক কিছুই আছে এই গ্রন্থে, যেমন সেলিম আল দীনের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাৎ, তার ব্যক্তিত্বের পরিচয় তুলে ধরা, টিএসসিতে সেলিমেরই নাটক 'জন্ডিস ও বিবিধ বেলুন'-এর মঞ্চস্থ হতে দেখার অনুভূতি, টিভি চ্যানেলে গুলিবিদ্ধ বেনজির ভুট্টোর বাঁচার জন্য হামাগুঁড়ি দেওয়ার ও শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারের পর প্রিজনভ্যানে তোলার সময় তার হাতে ধরা পানির বোতলটির টলমল করার অদৃষ্টপূর্ব বর্ণনা। হাবিবুল হাসানের নিজস্বতাঋদ্ধ গদ্যে কবিতা কীভাবে মিশে গেছে তারও উদাহরণ দেওয়ার প্রয়োজন আছে : ক. সেই যখন শাড়ি আর কামিজের ফাঁকে ঝরে পড়ত আর্টস বিল্ডিংয়ের ইটের দেয়ালের ফাঁকে ফাঁকে ... (পৃ: ২৯) খ. তানসেনের গানের মতো বৃষ্টি নেমেছে। এখন তুমি কোথায় আছ? হঠাৎ চমকে উঠি, ঝটকা লাগে তুমি ঠিক আমার পাশে বসে আছ সত্যি সত্যি! (পৃ: ৪৬)

স্পষ্টবাদিতা, রোমান্টিকতা, সাহসিকতা, দার্শনিকতা ও গভীর কাব্যপ্রীতি হাবিবুল হাসানের লেখক চারিত্রের বৈশিষ্ট্য যা আবার দেখা দিয়েছে চতুর্থ গ্রন্থ তখন সে আমাকে শাড়ি আর ফুল কিনেত শিখিয়েছিল'তে। এটাও প্রথম গদ্যের বইয়ের মতো উত্তম পুরুষে রচিত। এখানেও গল্প আছে তবে তা ধারাবাহিক নয়। গল্প বলতে, নানা ঘটনার উলেস্নখ করতে করতে লেখক নানা মন্তব্যে জুড়ে দেন, ক্ষোভ বা আনন্দের অনুভূতি ব্যক্ত করেন। এভাবেই এগিয়েছে এই গ্রন্থও। বক্তব্যের ক্ষেত্রে লেখক খুবই অকপট ও সরাসরি বিশেষ করে যেসব জায়গায় তিনি দেশবাস্তবতা তুলে ধরেছেন। আর প্রেম-অপ্রেম, একান্ত ব্যক্তিক অনুভব ও শিল্পভাবনার ক্ষেত্রে তিনি অনেকটাই অপ্রত্যক্ষ। আমি মনে করি, এই দুই পন্থা তার কথা গদ্যের স্টাইল তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। হাজির করছি কয়েকটি দৃষ্টান্ত :

১. সে (হুমায়ুন ফরিদী) আর হুমায়ূন আহমেদ দু'জনেই কিশোর-কিশোরীদের বিপথে যেতে সাহায্য করেছে। (পৃ: ১০)

২. বাংলাদেশের বয়স বাড়ছে প্রতিবন্ধী শিশুর মতো। (পৃ: ১২)

৩. ধর্ম যেভাবে গত সময়গুলো ধরে রাষ্ট্রের মাথায় উঠে বসেছে তাতে রাষ্ট্রের এক সময় এগুলো পরিষ্কারভাবে ভাবতে হবে। ধর্মের প্রকোপ থেকে মানুষকে নিরপেক্ষভাবে বাঁচাতে হবে। (পৃ: ১৯)

৩. আধুনিক যুগ একটু হলেও বিটকেলে; দুষ্টু ছেলের মতো। সে কেটে-চিরে দেখতে চায় সবকিছু সেই পন্ডিত অথবা ডোমের মতো। (পৃ:২৩)

৪. আমার টাকা থাকবে কীভাবে? আমিতো লিখি। লিখি মানে লেখাকে শিল্পকর্ম হিসেবে নেই ... সমস্যাটা এখানে। (পৃ: ১৬)

৫. প্রকৃতি কি অশ্বডিম্ব নাকি? সব নষ্টের গোড়া তো সেই। যে নির্মাণ করে তারও মৃতু্য হয়। সব চিন্তা ও বস্তুনিষ্ঠতাকে ধ্বংস করাই তার কাজ। আমি এখানে আছি কিন্তু নেই। আমার মাথায় কিলবিল করে কালের অপারগতা। (পৃ: ২৫)

লেখক হাবিবুল হাসান গল্প বলে যাচ্ছেন, চরিত্র নির্মাণ করছেন, নানারকম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছেন। আবার একাধিক জায়গায় হাবিবুল হাসান নিজেই একটা চরিত্র হিসেবে দেখা দিচ্ছেন। কথাসাহিত্যের এও এক কৌশল যা প্রযুক্ত হয়েছে এই গ্রন্থে এবং অন্য বইগুলোতেও। বিশ্বব্যাপী আধুনিক ঔপন্যাসিকদের অনেকেই বর্ণনার ভেতর স্বীকারোক্তির প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। একই জিনিস হাবিবুল হাসানও করেছেন। অনেকগুলো জায়গায় তিনি সোজাসুজি কথা বলেছেন, এমনকি যৌনতা বা নিজের যৌন অভিজ্ঞতার কথাও নিঃশঙ্কোচে বলেছেন। কাঁচা পাঠকরা এটাকে অশ্লীলতা বলবে হয়তো। কিন্তু একটা বই কখনো অশ্লীল হয় না। সেটা হয় সুলিখিত না হয় অপাঠ্য।

আমি জানি না এই চারটি গ্রন্থ বাংলা সাহিত্যের সেরা পুস্তকগুলোর পঙক্তিভুক্ত হতে পারবে কিনা। তবে এটুকু বলতে পারি এরকমভাবে, এই স্টাইলে অন্য কেউ আর লেখেননি। গড়পড়তা বাঙালি গল্প-ঔপন্যাসিকরা সবাই ভারালুতা আক্রান্ত। এদের লেখায় চিন্তার গভরিতা বা দার্শনিক উপলব্ধি মেলে না। এরা কেবল শত শত পৃষ্ঠা ব্যয় করেন একটা নিটোল কাহিনিকে ধরার জন্য। কিন্তু সেই গল্পও শেষ পর্যন্ত আমাদেরকে কোনো কিছুর সামনে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে না। সেদিক থেকে হাবিবুল হাসান স্পষ্ট ব্যতিক্রম। তার সমালোচনা উপন্যাসগুলোর প্রত্যেকটি ৪৮ পৃষ্ঠায় শেষ হয়েছে। তাতে কি? নোবেল প্রাপ্তির আগে কবি ভিশ্লাভা শিমবোরোস্কার অল্প কয়েকটি চটি বই বেরিয়েছিল। কামুর আউটসাইডার; হেমিংওয়ের 'টুউমেন', সমরেশ বসুর 'বিবর', অমিয়ভূষণ মজুমদারের 'মধু সাধু খাঁ'-এসববের কোনটিই স্কুলদেহী উপন্যাস নয়। হেমিংওয়ে, সারামাগো, অরুনূতী রায়ের মতো লেখকদের রচনা হাবিবুলের শিল্পরুচি গড়ে তোলার পেছনে সক্রিয়। পৃথিবীর সেরা গদ্যশিল্পীদের রচনা যে ধরণের স্বাদ দেয় অনুরূপ স্বাদ ও সুরুচির সন্ধান মেলে হাবিবুল হাসানের লেখায়। শিল্পকর্ম কখনোই নিখুঁত নয় এবং অসংলগ্নতা ও ব্যাকরণ বহির্ভূততার মতো বিষয়গুলো জেমস জয়েস, কমলকুমার মজুমদারদের মতো মহান শিল্পীদের বেলায়ও চোখে পড়ে। ছোট খাটো বিচু্যতিকে শিল্পের গভীর অন্তদৃষ্টি দিয়ে পুষিয়ে দিতে পেরেছেন তারা। হাবিবুল হাসানও এর ব্যতিক্রম নন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে