শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১
বই আলোচনা

'অ-জনগণকরণের' রাজনৈতিক অর্থনীতি

নতুনধারা
  ০২ জুন ২০২৩, ০০:০০

সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে গণমানুষের অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত রচিত গবেষণাগ্রন্থ 'অ-জনগণকরণের' রাজনৈতিক অর্থনীতি : বাংলাদেশে ৫০ বছরের রাষ্ট্রীয় বাজেটে পারিবারিক কৃষি, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ ও ভূমি সংস্কার'। দেশ ও দেশের বাইরে বরেণ্য এই অর্থনীতিবিদ ও গবেষক তাঁর গ্রন্থে উলেস্নখ করেছেন, 'ধারণা হিসেবে 'অ-জনগণ' এখনো পর্যন্ত কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় স্পষ্ট ধারণা নয়। সমাজ বিশ্লেষণে 'অ-জনগণ' ধারণাটি এখনো পর্যন্ত খুব একটা স্বীকৃত নয়। অথবা বলা চলে ব্যাখ্যায়িত নয়। এসবের বিপরীতে আমাদের ধারণা হলো সমাজ-অর্থনীতি-রাষ্ট্র-এর বিবর্তন ও বিকাশ বিশ্লেষণে সমাজবদ্ধ মানুষের বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা-বিচ্ছিন্নতার বহুমুখী রূপ ও মাত্রা অনুসন্ধান বেশ কার্যকর ফল দিতে পারে। এসব বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা-বিচ্ছিন্নতা যে সমাজে বিধিবদ্ধ রূপ পরিগ্রহ করে সে সমাজে সংশ্লিষ্ট মানুষ?ব্যক্তি হিসেবে এবং সমাজবদ্ধ গোষ্ঠী হিসেবে?জনগণ নন। তারা অ-জনগণ। আর 'অ-জনগণকরণ' অথবা একই কথা 'অ-জনগণীকরণ' হলো সে প্রক্রিয়া, যে প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট মানুষের বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতা-বিচ্ছিন্নতা বিধিবদ্ধ রূপ পরিগ্রহ করে এবং এসবের গতি হয় ঊর্ধ্বমুখী (সরকারি আনুষ্ঠানিক পরিসংখ্যান যাই-ই বলুক না কেন)।'

গ্রন্থের প্রথম অংশে 'অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি' নিয়ে যা বলতে চেষ্টা করা হয়েছে, তাই-ই গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশের পদ্ধতিতত্ত্বীয় ভিত্তি বা কাঠামো। বাস্তবজীবনে 'অ-জনগণকরণের রাজনৈতিক অর্থনীতি' কোথায়, কতটুকু, কীভাবে বিদ্যমান ও দৃশ্যমান সেসবই গ্রন্থের দ্বিতীয় অংশে অনুসন্ধান করা হয়েছে। এবং সেটা করা হয়েছে বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। আর তা করা হয়েছে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় (জাতীয়) বাজেটে কয়েকটি বড় বর্গের অ-জনগণকে মাথায় রেখে। এসব বড় বর্গের মধ্যে আছেন পারিবারিক কৃষির সঙ্গে সম্পর্কিত মানুষ, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ এবং কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার-উদ্দিষ্ট মানুষ। চার বর্গের এসব মানুষ-ই সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশের মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ।

অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত তার গ্রন্থে উলেস্নখ করেছেন, সেইসব মানুষ এবং গোষ্ঠী অ-জনগণ, যারা রাষ্ট্রে রেডারের বাইরে 'বহিস্থ', 'অন্যজন', যারা হিসাবের খাতায় অন্তর্ভুক্ত নন, যারা গণনার বাইরে, যারা নাড়ি থেকে বিচ্ছিন্ন-উচ্ছেদিত, সমূলে উৎপাটিত, নির্বংশ। ঐতিহাসিকভাবে এহেন অ-জনগণ-এর 'বিশুদ্ধতম রূপ' হলো দাসব্যবস্থার 'দাস'; পরবর্তীকালে অ-জনগণ হলো সামন্তবাদী ব্যবস্থায় 'প্রজা কৃষক', আর পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় 'মজুরি শ্রমিক'। দাসব্যবস্থার 'দাস' হলেন 'বিশুদ্ধতম অ-জনগণ' আর আধুনিক যুগের এখনকার 'অ-জনগণ' হলেন 'মুক্তির প্রলেপযুক্ত দাস'।

তিনি আরও উলেস্নখ করেছেন, দেশের মানুষের মধ্যে যেসব ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিরন্তর বঞ্চনা-বৈষম্য-অসমতার শিকার একই সঙ্গে যা দেশের আর্থসামাজিক কাঠামো সৃষ্ট তারাই অ-জনগণ প্রক্রিয়াভুক্ত। এ দৃষ্টিতে গুটিকয়েক লুটেরা-পরজীবী- রেন্টসিকার ও তাদের সহযোগীরা ছাড়া সবাই সম্ভাব্য অ-জনগণ। আর সম্ভাব্য অ-জনগণদের মধ্যে সম্ভবত সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ও গোষ্ঠীই হবেন নিরঙ্কুশ অ-জনগণ। নিরঙ্কুশ অ-জনগণকৃত এসব মানুষের কোনো তালিকা নেই, তবে তা হবে অনেক দীর্ঘ বিস্তৃত।

গবেষণা কাজের সুবিধার জন্য নিরঙ্কুশ অ-জনগণকৃত এত ব্যাপক, বিস্তৃত ও বহুমুখী অ-জনগণকৃত মানুষের গবেষক চারটি বৃহৎ বর্গে শ্রেণিবদ্ধ করেছেন; (১) পারিবারিক কৃষি-সংশ্লিষ্ট মানুষ, (২) গ্রামীণ নারী, (৩) আদিবাসী, ও (৪) কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার উদ্দিষ্ট মানুষ। গবেষক বারকাত উলেস্নখ করেছেন সুনির্দিষ্ট ধরনের নিরঙ্কুশ অ-জনগণ মানুষ প্রস্তাবিত চার বৃহৎ বর্গের এক বা একাধিক-এর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং সম্পর্ক জালটি জটিল।

অনুসন্ধিৎসু গবেষক ড. বারকাত তাঁর গ্রন্থে গবেষণার মাধ্যমে দেখিয়েছেন যে, পারিবারিক কৃষি ও সংশ্লিষ্ট মানুষ (ভূমিহীন-প্রান্তিক মানুষ, দরিদ্র-বিত্তহীন-নিম্নবিত্ত, খুদে খামারি), গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ এবং কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারউদ্দিষ্ট মানুষ?এসব বর্গের প্রতিটির ক্ষেত্রে বিগত ৫০ বছরে জাতীয় বাজেট বরাদ্দ জনসংখ্যানুপাতে নগণ্য; প্রকৃত বরাদ্দ 'স্বল্প বরাদ্দ ফাঁদ'-এ পড়ে আছে; বরাদ্দ বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। এই চারটি বর্গের মানুষই হলেন অ-জনগণ। এদের সম্মিলিতভাবে দেখলে এরা হবেন দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, মোট জনসংখ্যার ৯০%। অথচ বিগত ৫০ বছরের বাজেটে এদের সম্মিলিত বরাদ্দ হবে জনসংখ্যানুপাতে ন্যায্য হিস্যার বড়জোর ১৩%, আর বাদবাকি ৮৭% তাদের বরাদ্দ দেওয়া হয়নি, তা আত্মসাৎ করা হয়েছে। বিগত ৫০ বছরে সম্মিলিতভাবে এসব মানুষের জন্য বাজেট 'অন্যায্যতার মাত্রা' অথবা 'বৈষম্য মাত্রা' হবে ৬৬৯%। সুতরাং জাতীয় বাজেট বরাদ্দের নিরিখে এসব মানুষ একক বর্গের মানুষ হিসেবে এবং সম্মিলিতভাবে অ-জনগণ। তাহলে প্রশ্ন?'জনগণই যদি প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক' হন, সেক্ষেত্রে এই চারবর্গের মানুষ কী জনগণ?

বিগণ ৫০ বছরের জাতীয় বাজেটে পারিবারিক কৃষি, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ এবং কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারউদ্দিষ্ট মানুষের হিস্যার হিসাবপত্র ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণসহ যেসব প্রবণতা তিনি দেখিয়েছেন এক কথায় তা হতাশাজনক। এসব থেকে উলিস্নখিত চার বর্গের মানুষ (যারা দেশের ৯০% মানুষ)-এর নিরন্তর অ-জনগণকরণের-এর এক 'হতাশ চিত্র' বা 'ক্ষোভ-বিক্ষোভ চিত্র' বা 'আক্ষেপ চিত্র' বিনির্মাণ সম্ভব। গবেষক ড. বারকাত উলেস্নখ করেছেন, 'আমরা প্রশ্ন করেছি অ-জনগণকৃত এসব মানুষের জনগণে উত্তরণ-রূপান্তর সম্ভব কিনা? রাষ্ট্রীয় বাজেটের নিরিখে তা সম্ভব কিনা? আমাদের উত্তর?সম্ভব। কীভাবে?'

মানবদরদি গবেষক অধ্যাপক আবুল বারকাত তার গ্রন্থে উলেস্নখ করেছেন, চারবর্গের মানুষের অ-জনগণকৃত রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে জনগণকৃত অবস্থানে রূপান্তরে অন্যান্য অনেক কিছুর মধ্যে রাষ্ট্রীয় বাজেট হতে পারে অন্যতম মাধ্যম। সে ক্ষেত্রে প্রতিটি বর্গের মানুষের জন্য বাজেটে মাথাপিছু বরাদ্দ হতে হবে জাতীয়ভাবে মাথাপিছু বরাদ্দের তুলনায় বেশি। বিষয়টি শুধু জাতীয় বাজেটে বরাদ্দ সংশ্লিষ্ট পরিবর্তনই নয় তা বাজেটের আয় উৎসে পরিবর্তন সংশ্লিষ্টও (যেমন বর্ধিতহারে সম্পদ করারোপ, বর্ধিত আয় কর, কালো টাকা উদ্ধার, অর্থপাচার রোধ ইত্যাদি)। মূল কথা হলো রাষ্ট্রীয় বাজেটের ব্যয়-বরাদ্দ ও আয়?উভয় কাঠামোকেই বৈষম্য নিরসন উদ্দিষ্ট হতে হবে। এর অন্যথা মানুষের অ-জনগণকরণের গভীরতা ও তীব্রতা বাড়াবে। ফলে অনিবার্য হবে সামাজিক সংঘাত-সংঘর্ষ। সমাধান উদ্দিষ্ট পুরো বিষয়টি রাজনৈতিক।

ড. বারকাত আরও উলেস্নখ করেছেন, 'রাষ্ট্রীয় বাজেটে পারিবারিক কৃষি, গ্রামীণ নারী, আদিবাসী মানুষ এবং কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারউদ্দিষ্ট মানুষের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করার বিষয়টি শেষ বিচারে বৈষম্য নিরসন উদ্দিষ্ট বাজেট বিনির্মাণ ও তা বাস্তবায়ন সংশ্লিষ্ট। আর এটাই সে প্রক্রিয়া, যার মাধ্যমে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের অ-জনগণ থেকে জনগণে রূপান্তর সম্ভব, যে জনগণই হলেন 'প্রজাতন্ত্রের সব ক্ষমতার মালিক'।

তবে, এ কথা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কার করলেই মানুষের অ-জনগণকরণ নিমিত্ত সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। আসলে এ সংস্কার হলো ব্যাপক জনগোষ্ঠীর অ-জনগণ থেকে জনগণে রূপান্তরের প্রয়োজনীয় শর্ত, পর্যাপ্ত শর্ত নয়। পর্যাপ্ত শর্ত পূরণে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের পাশাপাশি আরও যেসব সংস্কার করতে হবে তার মধ্যে অন্যতম হলো?বস্তুগত উৎপাদন খাত (অর্থনীতির শিল্প ও সেবা খাত) এবং নৈতিক দ্রব্য উৎপাদন খাতে (সামাজিক?স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি খাত) জনকল্যাণমুখী সংস্কার। অর্থাৎ সংস্কারকাজটি হতে হবে আংশিক নয়?পূর্ণাঙ্গ-সামূহিক-সামষ্টিক। আর এ সংস্কারে রাষ্ট্রের বাজেট হবে অন্যতম ফলপ্রদ রাজনৈতিক-অর্থনীতিক নীতিকৌশলিক হাতিয়ার।' অধ্যাপক ড. আবুল বারকাতের এই গবেষণা গ্রন্থটি জ্ঞানপিপাসু পাঠকদের জন্য নতুন জ্ঞান ও ধারণার দ্বার উন্মোচনকারী হিসেবে ইতোমধ্যে পাঠক মহলে সমাদৃত হয়েছে। সেই সঙ্গে উন্নয়ন নীতিনির্ধারক ও শাসনব্যবস্থা পরিচালনাকারী মহলের জন্যও গ্রন্থটি দিকনির্দেশক হিসেবে কাজ করবে বলে দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। এ ছাড়া দেশি-বিদেশি বেসরকারি সংস্থা যারা এ নিয়ে কাজ করছেন, গবেষক, শিক্ষক-শিক্ষার্থী সবার জন্য গবেষণা গ্রন্থটি সহায়ক হবে বলে মনে করি। সম্পূর্ণ ভিন্ন আঙ্গিকে ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে তিনি এমন একটি বিষয় নিয়ে গবেষণা করেছেন যা ইতিপূর্বে আর কেউ করেছেন বলে জানা নেই।

সব্যসাচী হাজরার প্রচ্ছদ পরিকল্পনা ও অলঙ্করণে দুই অংশে বিভক্ত ও পনেরোটি অধ্যায়ে সুবিন্যস্ত এই গবেষণা গ্রন্থটির পৃষ্টা সংখ্যা ২৬৫। এ ছাড়াও ৩০টি সারণি, ১৫টি লেখচিত্র, ৭টি চিত্র, ১টি ম্যাপ, ১০টি ছকসহ এই গ্রন্থে রয়েছে একটি তথ্যপঞ্জি ও নির্ঘণ্ট। ঢাকাস্থ মুক্তবুদ্ধি প্রকাশনার পক্ষে এই গবেষণা গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন অরনি বারকাত এবং এর মূল্য রাখা হয়েছে ১০০০ টাকা।

- ড. মতিউর রহমান

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে