রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

লিও তলস্তয়ের জীবন দর্শন

নাজমুল ইসলাম
  ১৬ জুন ২০২৩, ০০:০০

১৮ শতকের শেষের দিকে রাশিয়ার রাজনৈতিক অবস্থা ছিল বৈচিত্র্য ও ধোঁয়াশায় ভরপুর। জারদের অত্যাচারে সবাই অতিষ্ঠ। কিন্তু রাশিয়ার ভবিষ্যৎ কোন মতবাদের ওপর ভিত্তি করে পরিচালিত হবে এ নিয়ে সবাই দ্বিধাবিভক্ত। তৎকালীন প্রধান তিনটি মতাবাদ বিরাজ করছিল: ক. পপুলিস্ট, খ. সর্বহারা বিপস্নব গ. স্স্নাভোফিল। এর মধ্যে লিও তলস্তয় ছিলেন তৃতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত।

যে সময়টাতে তলস্তয় (৯ সেপ্টেম্বর, ১৮২৮ -২০ নভেম্বর, ১৯১০) জন্মগ্রহণ করেছেন সেটি ছিল বিপস্নবের যুগ। ফলে সে সময় জন্ম নেওয়া লেখক ও সাহিত্যিকরা বিপস্নবের পক্ষে কথা বলেছেন। এই শ্রেণির লেখকদের মধ্যে আছেন ম্যাক্সিম গোর্কি, মায়াকোভস্কি, রুশো, ভলতেয়ার প্রমুখ। রুশ বিপস্নব ও ফরাসি বিপস্নব প্রসঙ্গে এই নামগুলো অপরিহার্য। তবে লিও তলস্তয় এদের পঙক্তিভুক্ত নন। যদিও তলস্তয় সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে লেনিন তার একটি লেখায় বলেন: খবড় ঞড়ষংঃড়ু ধং :যব সরৎৎড়ৎ ড়ভ :যব জঁংংরধহ জড়াড়ষঁঃরড়হ. ঞড়ষংঃড়ু রং মৎবধঃ ধং :যব ংঢ়ড়শবংসধহ ড়ভ :যব রফবধং ধহফ ংবহঃরসবহঃং ড়ভ জঁংংরধহ ঢ়বধংধহঃং ধঃ :যব :রসব :যব নঁৎমবড়রংব ৎবাড়ষঁঃরড়হ ধিং ধঢ়ঢ়ৎড়ধপযরহম রহ জঁংংরধ. ঞড়ষংঃড়ু, নবপধঁংব ড়ভ :যব ংঁসঃড়ষধষ ড়ভ :যরং ারবংি, :ধশবহ ধং ধ যিড়ষব, যধঢ়ঢ়বহং :ড় বীঢ়ৎবংং :যব ংঢ়বপরভরপ ভবধঃঁৎবং ড়ভ ড়ঁৎ ৎবাড়ষঁঃরড়হ ধং ধ ঢ়বধংধহঃ নঁৎমবড়ংরব ৎবাড়ষঁঃরড়হ.

জমিদার বাড়ির সন্তান হয়েও কৃষকদের অধিকাররের ব্যাপারে তলস্তয় অত্যন্ত সচেতন ছিলেন। তিনি তার সম্পূর্ণ জীবন অতিবাহিত করেছেন অসহায়, নির্যাতিত, ও কৃষক শ্রেণির মানুষের আধিকারের পক্ষে কথা বলে। এ জন্যই বোধহয় লেনিন তাকে কৃষক আন্দোলনের অগ্রদূত বলেছেন। মূলত ইভান তুর্গেনেভ, বাকুনিন, ক্রোপৎফিন এবং প্লেখানভ, এ জাতীয় লেখকদের চিন্তা, আদর্শ এবং তলস্তয়ের মধ্যে ঢের তফাৎ রয়েছে। তারা ছিলেন সহিংস বিপস্নবের পক্ষে আর তলস্তয় ছিলেন বিপক্ষে।

যে কোনো ধরনের যুদ্ধও তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। কারণ যুদ্ধ কখনো শান্তি বয়ে আনে না বরং অশান্তিই বৃিদ্ধ করে। এমনকি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেও তিনি নিষেধ করেন। তার যুক্তি হলো : 'কোনটা যে অশুভ আর কোনটা নয়, মানুষ তা সঠিকভাবে নির্ণয় করতে পারে না; তাই এই ধরনের সিদ্ধান্তের ওপর ভিত্তি করে কাজ করলে আরও বেশি অনিষ্ট হয়। যদি কেউ আদতে অশুভ শক্তির যথাযথ মূল্যায়নই করতে না পরে, তাহলে সে অশুভ শক্তিকে প্রতিরোধ করবে কীভাবে।' প্রতিহিংসা এবং সন্ত্রাসকে ভালোবাসা দিয়ে জয় করতে বলেছেন তিনি।

তার সমগ্র জীবনকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম জীবনে তিনি সাধারণ মানুষ ও কৃষকদের অধিকারের ব্যাপারে সচেতন হলেও নিজের ব্যাপারে ছিলেন উদাসীন। ১৮২৮ সালে ইয়াসনায়া পলিয়ানাতে জন্মগ্রহণ করেন। জন্মের দু'বছর পর মাতা মারিয়া ভলএকান্‌ স্কায়া এবং নয় বছর বয়সে বাবা নিকোলাই ইলচ মৃতু্যবরণ করেন। জীবনের শুরুর দিকে তিনি কিছু বছর নষ্ট করেছিলেন জুয়া খেলে, মদের নেশা করে আর জিপসি রমণীদের জয় করে। জুয়াখেলায় জড়িয়ে ভয়ানকভাবে হেরে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। ঋণ থেকে বাঁচতে ভাইয়ের সঙ্গে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। এখান থেকে মূলত তার জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু হয়।

প্রথম জীবনে তিনি রচনা করেন 'শৈশব', 'কৈশর' ও 'যৌবন' (১৮৫২-১৮৫৯) যা জমিদার তনয়ের আত্মকথায় ভরপুর। অতঃপর ওয়ার অ্যান্ড পিস এবং আন্নাকারিনিনা লিখে বিশ্ব সাহিত্যের মহাপুরুষ হিসেবে নিজের স্থান করে নেন। লেখালেখির পাশাপাশি তিনি উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন, জীবনটা আসলে কী? পরিণত বয়সে পৌঁছে বিশ্বখ্যাত লেখক লিও তলস্তয় নিজেই নিজেকে এমন এক কঠিন প্রশ্নের মুখোমুখি করেছেন। সারাজীবন আঁতিপাঁতি করে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজে ফিরেছেন তলস্তয়। ধ্রম্নপদী দার্শনিক আর কাব্বালাদের লেখাপড়ার জন্য শিখেছেন গ্রিক এবং হিব্রম্ন। জীবনের সংজ্ঞা জেনেছেন কনফুসিয়াস আর লাও জি, ভারতীয় বেদ, বুদ্ধের বাণী, ইহুদি ঋষি এবং যিশু খ্রিষ্টের কাছ থেকে। অবশ্য সবার মাঝে খ্রিষ্টের সংজ্ঞাটাই তার কাছে মনে হয়েছে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য। অন্য সমস্ত সংজ্ঞাই একাকার হয়ে যায় তার এ উপলব্ধির কাছে এসে যে। জীবন হচ্ছে ঈশ্বরপ্রেম এবং তোমার প্রতিবেশীর প্রতি প্রেম। যা কিছু ভালো তা অন্যের মাঝে বিলিয়ে দেওয়ার মধ্যেই নিহিত জীবনের প্রকৃত তাৎপর্য।

রাজনীতি থেকে ধর্মকে আলাদা করার বিরোধী ছিলেন তিনি। তার মতে 'ধর্মকে বাদ দিলে রাজনীতি নেহাতই অযৌক্তিক ও অর্থহীন হয়ে ওঠে। যারা বলেন যে, ধর্ম আর রাজনীতি একে অপরের সঙ্গে খাপ খায়না, তারা ধর্মের প্রকৃত অর্থ কী তা জানেন না।' তাই তলস্তয় পাশ্চত্য সমাজের ওপর আধুনিক বিজ্ঞানের প্রভাবকে অসাধু বিবেচনা করে যথেষ্ট সমালোচনা করেছেন। তিনি বলেন, আধুনিক বিজ্ঞান সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটিরই উত্তর দেয় না: প্রশ্নটি হলো, কীভাবে বাঁচতে হবে।

অৎঃ ভড়ৎ অৎঃং ংধশব এ মতাবাদের কঠোর বিরোধী ছিলেন তিনি। এজন্য সেক্সপিওয়র ও হোমারের ন্যায় লেখকদেরও কঠোর সমালোচনা করেছেন। তার বয়স যখন সত্তর, তলস্তয় লেখক হিসেবে তার সব ভাবনাগুলোকে জড়ো করেছিলেন একটি দীর্ঘ প্রবন্ধে ডযধঃ রং ধৎঃ?, এটি তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বইগুলোর একটি। এখানেই তলস্তয় প্রস্তাব করেছিলেন, শিল্পকলার একটি মহান উদ্দেশ্য আছে। লিও তলস্তয় বিশ্বাস করতেন উপন্যাসের কাজ শুধু আনন্দ দেওয়া নয় বরং এটি মনস্তাত্ত্বিক শিক্ষা আর সংস্কার করারও একটি উপকরণ। তার দৃষ্টিতে এটি ছিল সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম, যার মাধ্যমে আমরা পরস্পরকে চিনতে পারি, বিশেষ করে সেই সব মানুষ, যাদের বাইরে থেকে দেখলে মনে হতে পারে অনাকর্ষণীয়, আর এভাবেই আমরা সম্প্রসারিত করতে পারি আমাদের মানবতা আর সহিষ্ণুতাকে।

নন্দনশিল্প এবং নৈতিকতা বিষয়ক মতাদর্শে তলস্তয় এবং সক্রেটিস এক ও অভিন্ন। তলস্তয় বলেন: যৌনতা এবং সংগীত মানুষকে অবনমনের দিকে ঠেলে দেয় এবং আত্মার পতন ঘটায়। বিশ্লেষকদের ধারণা এটি তাঁর 'রিপাবলিক' পঠনের ফল। তবে পেস্নটোর মতো তলস্তয় নন্দনশিল্প নিষিদ্ধকরণের পক্ষে ছিলেন না। তিনি বিশ্বাস করতেন মানুষের অনুভূতির স্বাভাবিক উন্নয়ন ঘটলে অ-নান্দনিক শিল্পের বিনাশ স্বাভাবিকভাবেই ঘটবে।

তলস্তয়ের সাহিত্যিক হিসেবে সফলতার পেছনে তার স্ত্রীর অবদান কম নয়। ওয়ার এন্ড পিস, আন্নাকারিনিনা, পুনরুত্থান, এর ন্যায় বিখ্যাত বইগুলো প্রস্তুত করতে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তার সহধর্মিণী সফিয়া। কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে লিও ও তার স্ত্রী সোফিয়ার মধ্যে টানাপোড়েনও বাড়তে থাকে, তিনি অভিযোগ করেন যে, বেঁচে থাকার অর্থ সম্বন্ধে তাদের দুজনের ধারণা পুরোপুরি বিপরীত। তখন তার বয়স আশি পেরিয়ে গেছে, তলস্তয় আর সহ্য করতে পারেননি। নভেম্বরে তীব্র শীতের এক রাতে তিনি তার স্ত্রী ও পরিবারকে পরিত্যাগ করেন। কাছাকাছি একটি ট্রেন স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষা করতে গিয়ে একপর্যায়ে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে মৃতু্যবরণ করেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে