শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

কিস্‌সা :বাংলা লোকসাহিত্যের অনির্বচনীয় সাহিত্য ধারা

অমল বড়ুয়া
  ১৬ জুন ২০২৩, ০০:০০

বাংলা লোকসাহিত্যের এক অনিন্দ্য লোককথা 'কিস্‌সা'। গ্রামবাংলায় যত ধরনের লোককথা রয়েছে তার মধ্যে কিস্‌সার সর্বজনীন জনপ্রিয়তা অবিসংবাদিত। আবাহমান বাংলার লোকসাহিত্যের উর্বর ধারা এই কিস্‌সা কেবল বাংলা লোকসংস্কৃতিকে ঋদ্ধ করেনি বাংলা সাহিত্যকেও করেছে পরিপুষ্ট ও সমৃদ্ধ। এর মাধ্যমে সৃজিত হয়েছে বাংলা সাহিত্যের নবধারা। কিস্‌সা বাংলা কবিতা এবং গদ্যের একটি ধারার পাশাপাশি মৌখিক গল্প-বর্ণনার বাংলা ভাষার একটি ঐতিহ্য। কিস্‌সার মাধ্যমে মুসলমানদের মধ্যে প্রেম, বীরত্ব, সম্মান এবং নৈতিক অখন্ডতার জনপ্রিয় কাহিনীর মাধ্যমে ইসলামী এবং তার সঙ্গে পারসি ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটেছিল। এটি বাংলায় পৌঁছে ধর্মের গন্ডিকে অতিক্রম করে আরও ধর্মনিরপেক্ষ রূপে পরিণত হয়েছিল এবং বিদ্যমান প্রাক-ইসলামী সংস্কৃতির সঙ্গে বাংলার সংস্কৃতি এবং এর সত্তার লোককাহিনী যুক্ত করেছিল। স্থানীয় বাঙালি লোককাহিনী এবং আরব ও পারস্য-তুর্কি অভিবাসীদের গল্পের সংমিশ্রণে এটি বাংলায় সমৃদ্ধি লাভ করে। এই জনপ্রিয় শিল্পটি গ্রামীণ বাংলাদেশের মুসলিম সম্প্রদায়ের মাঝে এখনো অবশিষ্ট রয়েছে।

কিস্‌সা শব্দের উৎপত্তি আরবি শব্দ ক্বিস্‌সা থেকে, যার অর্থ মহাকাব্য কিংবদন্তি বা লোককাহিনী। কিস্‌সা'র বাংলা অর্থ কেচ্ছা, কিচ্ছা, কিস্‌?সা; শব্দটি বিশেষ্য, যার অর্থ দাঁড়ায়- কাহিনী; গল্প; উপ্যাখ্যান; নেতিবাচক শব্দ কুৎসা; কলঙ্ক কথা অর্থেও ব্যবহৃত হয়। কিস্‌সা হচ্ছে বর্ণনাত্মক লোককথা। ইংরেজি ঋড়ষশ-ঃধষশ শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে 'লোককথা' শব্দটি ব্যবহার করেন আশুতোষ ভট্টচার্য। পরবর্তী সময়ে এই ঋড়ষশ-ঃধষশ শব্দটির অন্যান্য অর্থে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়- যার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো লোককাহিনী, লোকগল্প ও কিস্‌সা। আর এই লোককথার স্বতন্ত্র একটি ধরন হচ্ছে প্রজন্ম পরম্পরায় জনশ্রম্নতিমূলক বা মৌখিক কথা, গল্প, কিস্‌সা ও লোককাহিনী। এই লোককাহিনী বা কিস্‌সা মৌখিক অথবা লিখিত গদ্যের ভাষায় পাওয়া যায়। আবাহমান বাংলার লোককথা কিস্‌সার রয়েছে নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, ও ভাবধারা। রয়েছে নিজস্ব সৌষ্ঠব, কাঠামো, শিল্প ও সাহিত্য রস। কিস্‌সা নিজগুণে বাংলা সাহিত্যে করে নিয়েছে এক অনিন্দ্য অবস্থান। কিস্‌সার অনির্বচনীয় ঢং, সৃষ্টিশীলতার অদ্ভুদ অবয়ব ও মৌলিক পরিশীলিত মননের অনন্য ছাঁচ থেকে গোড়াপত্তন ঘটেছে অনবদ্য সাহিত্যকর্মের। ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য, প্রেম-ভালোবাসা, যুদ্ধ-বিগ্রহ, রূপকথা, শিক্ষামূলক লোককাহিনীর ঘটনাধারা অবলম্বনে কিস্‌সার উন্মেষ। কিস্‌সার এই ধারাটি প্রাচীন যুগ থেকে প্রচলিত হয়ে আসছে। অর্থাৎ কিস্‌সা সৃষ্টির ইতিহাস মানবজাতির সৃষ্টির ইতিহাসের মতোই পুরনো ও প্রাচীন।

গ্রামীণ নিরক্ষর জনগোষ্ঠীর অসাধারণ বিস্ময়কর সৃষ্টি হচ্ছে কিস্‌সা। যা সাহিত্যের একটি উৎকৃষ্ট ধারা এবং যা বাংলা লোকসাহিত্য ও সংস্কৃতিকে করেছে ঐশ্বর্যশালী ও সুষমামন্ডিত। গ্রামাঞ্চলে সাধারণ মানুষ ও বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ বংশানুক্রমিকভাবে চলে আসা বা শুনে আসা কাহিনীকে 'কিস্‌সা কাহিনী' বলে থাকে। কিস্‌সা বর্ণিত কাহিনীতে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অসম্ভবের মাত্রাকে স্পর্শ করে। এই সব কাহিনীর নায়ক ও নায়িকা অতিপ্রাকৃত বিভিন্ন অবিশ্বাসী শক্তিকে পরাজিত করতে পারে। গ্রামেগঞ্জে বসতো কিস্‌সার আসর। সেই কিস্‌সার ফাঁকে ফাঁকে চলত গান। নানারকম পিঠা-পুলির সঙ্গে চলত গল্প, ছুটতো কিস্‌সার ফুলঝুরি। রাজা-বাদশাহর কিস্‌সা, রাজপুত্র আর রাজকন্যার কিস্‌সা, যুদ্ধ জয়ের কিস্‌সা, দৈত্য-দানব আর ভূতপ্রেত জিন-পরির কিস্‌সা, দরবেশের কিস্‌সা, পশুপাখির কিস্‌সা, ঝড়তুফান-জ্বলোচ্ছ্বাস আর পস্নাবনের কিস্‌সা, আধ্যাত্মবাদ আর অতিপ্রাকৃত শক্তির কিস্‌সা, ধর্মের মহত্ত্ব প্রকাশক কিস্‌সা, স্বর্গ-নরক ও আগুনের কিস্‌সা, শিকার ও শিকারীর কিস্‌সা, প্রেম-ভালোবাসার কিস্‌সা, শোক-দুঃখ-দৌর্মন্যসের কিস্‌সা, বিজয়-আনন্দ ও গৌরবের কিস্‌সা তন্ময় করে রাখতো মুগ্ধ শ্রেতাদের। দাদা-দাদি, নানা-নানির মায়া জড়ানো সরল বয়ানে কিস্‌সা মনের ভেতর কেবল ঘুরপাক খেতে খেতে একটি মন্ত্রমুগ্ধ প্রচ্ছন্ন জগতে নিয়ে যেত। শহুরের ব্যস্ততা ও তথ্যপ্রযুক্তির ঘনঘটায় কিস্‌সার আসরে ভাটা পড়লেও এখনো নির্মল প্রেমে ঋদ্ধ গ্রামীণ জনপদে বেঁচে আছে কিস্‌সারা। এখনো কিস্‌সা নিয়ে মাতামাতি হয়, আয়োজন হয় আর অনুসন্ধিৎসু মানুষ মনখোলে কিস্‌সার রস আস্বাদন করেন।

কিস্‌সার মতো জনপ্রিয় লোককাহিনীর উদ্ভবের সময়কাল ভারত উপমহাদেশে খুবই প্রাচীন। তৎকালীন সময়ে কিস্‌সার প্রধান অনুষঙ্গ ও উপকরণ ছিল ধর্ম। ধর্মের লোককথাই কিস্‌সা রূপে প্রত্যন্ত জনপদে চাউর হয়েছিল। কিস্‌সার উৎস সন্ধানে আমরা প্রাচীন লোকসাহিত্যের প্রসঙ্গকে উপেক্ষা করতে পারি না। বিশেষ করে ভারতবর্ষের লোককথার ইতিহাসের ক্ষেত্রে অতি অবশ্যই ভারতের প্রাচীন সাহিত্যকে সংযুক্ত করতেই হবে। পন্ডিতদের অনেকের মতে, বৈদিকযুগে সংস্কৃত ভাষার রামায়ণ নামক মহাকাব্যটি আনুমানিক পাঁচশ-খ্রিষ্টপূর্বাব্দে রচিত হয়। এই মহাকাব্যে যে লোককাহিনীর উপস্থাপন করা হয়েছে তা হলো রামচন্দ্রের জীবনকাহিনী। মহর্ষি বাল্মীকির কৌতূহল নিরসনের জন্য চারণকবি ত্রিকালদর্শী নারদ রামচন্দ্রের কথা শুনিয়েছেন। চারণকবি নারদ আদিকবি বাল্মীকিকে যে কাহিনী শুনিয়েছেন, রামায়ণ রচিত হওয়ার অনেক আগেই তা লোকসমাজে প্রচলিত ছিল। রামায়ণের কাহিনী ও উপাদান মৌলিক নয়। রামায়ণের মূলভিত্তি লৌকিক কাহিনী। রামায়ণের সমস্ত অবয়ব জুড়ে রয়েছে লোক-উপাখ্যান। রামায়ণে ফুটে উঠেছে প্রাচীন ভারতের লোকবিশ্বাস, লোকসংস্কার, সামাজিক প্রথার বর্ণনা। লোকসমাজের এসব লোকগাথা নারদমুনির কাছে শুনে অনন্য কাব্যরূপ দিয়েছেন আদিকবি বাল্মীকি তার রচিত রামায়ণ মহাকাব্যে। নানা ধরনের গল্প, উপকথা, পুরাণকাহিনী, দার্শনিক তত্ত্বের বিশালায়তনের সাহিত্যকর্ম মহাভারত। আনুমানিক খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০০ অব্দ মতান্তরে খ্রিষ্টপূর্ব ৫০০-৫০ অব্দে মহাভারতের রচনাকাল। তৎকালীন সমাজে যে সব খন্ড খন্ড আখ্যান ও ঐতিহ্য প্রচলিত ছিল সেইগুলো মহাভারতে সংকলিত হয়েছে। অর্থাৎ লৌকিক উপাদানই মহাকাব্য মহাভারতের আদি উৎস। মহাভারতের মূল কাহিনী কুরু-পান্ডবদের যুদ্ধ, পুণ্যের জয় এবং পাপের পরাজয়- এক মহান গাথার মধ্যে কাহিনীর সমাপ্তি হলেও প্রবহমান অনেক উপকাহিনী এবং লোককথা এর মধ্যে আশ্রয় পেয়েছে। আঠারোটি পর্বে বিভক্ত প্রায় লক্ষাধিক শ্লোকে বর্ণিত এই গ্রন্থটি সমাজের লোককথা ভান্ডার। এই গ্রন্থে আছে সমাকালীন সমাজের রীতিনীতি, সংস্কৃতির শত শত উপকাহিনী, যেগুলো লোককথার চরিত্র বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে। অলৌকিক জন্ম, অযোনিসম্ভব নরনারী, মন্ত্রপুত জলপানে পুরুষের গর্ভ সঞ্চার, জাদুবিদ্যার প্রভাব, অসম্ভব ক্ষমতাসম্পন্ন মনুষ্যেতর জীব, সমুদ্রপান, সমুদ্রমন্ত্রন- ইত্যাদি আধিভৌতিক বিষয়গুলো লোককথার বৈশিষ্ট্যকে স্মরণ করায়।

বিশ্বের লোককথা সংগ্রহের ইতিহাস এক পরম বিস্ময় বিষ্ণুশর্মার 'পঞ্চতন্ত্র'। অন্যতম লোককথা সংগ্রাহক পন্ডিত বিষ্ণুশর্মা লোকসমাজ থেকে সংগ্রহ করে অসীম পরিশ্রমে সম্পাদনা লোককথাগুলোকে লিখিত রূপ দিয়েছে পঞ্চতন্ত্রে। পন্ডিতদের মধ্যে হারটেলের মতে প্রথম কাশ্মিরে ২০০ খ্রিষ্টপূর্বাব্দে, রেমন্ড ডেলয় জেসনে মতে খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতাব্দীতে আবার লিলিয়ান হারল্যান্ডস হরনস্টেইনের মতে, পঞ্চতন্ত্র ২০০ থেকে ৫০০ খ্রিষ্টাব্দে সংকলিত হয়েছে। দু'শ' খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে পঞ্চম শতাব্দীর মধ্যে 'পঞ্চতন্ত্র' সংকলিত হয়েছে। পঞ্চতন্ত্র পাঁচটি তন্ত্রের সমাহার। ৮৪টি লোককথাকে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে- মিত্রভেদম, মিত্রপ্রাপ্তিকম, কাকোলূকীয়ম, লব্ধপ্রণাশম্‌ এবং অপরীক্ষিত কারকং। পঞ্চতন্ত্রের লোককথার অর্ধেক (৪২টি) পাত্রপাত্রীতে নানা ধরনের পশুপাখি। পঞ্চতন্ত্রের অধিকাংশ কাহিনীতে ফুটে উঠেছে সাধারণ গ্রামীণ মানুষের হাহাকার, বেদনা, তিক্ততা, ব্যর্থতা- জীবন সংগ্রাম ও অসহায়ত্ব। তাছাড়া পশুপাখি কেন্দ্রিক কাহিনীগুলি নীতিশিক্ষামূলক লোককথা। লোককথার যে আশ্চর্য সঞ্জীবনী ও সম্মোহনী শক্তি রয়েছে তা পঞ্চতন্ত্রের কাহিনীতে স্পষ্টভাবে অনুভব করা যায়। একটি কাহিনী শুরু হলো, মাঝে একাধিক কাহিনীমালার মতো গাঁথা রইল, একেবারে শেষে মূলকাহিনীর সমাধান। একটি পূর্ণাঙ্গ কাঠামোর মধ্যে বহু বিচিত্র কাহিনীর সমাহার। সত্যবাদী যুধিষ্ঠীর, সহস্রবুদ্ধির বিপদ, নীলবর্ণ শৃগাল, বোকা হাতি, সিংহ, উট ও কাক, বিশ্বস্ত বেজি- ইত্যাদি কাহিনীগুলোর অর্ন্তনিহিত ভাব লোকসমাজকেই মনে করিয়ে দেয়। তাই লোককথা একটি অনন্য সংকলন রূপে তৎকালীন সমাজব্যবস্থার দলিল।

সমগ্র বিশ্বের প্রাচীনতম লোককথার সংকলনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সংকলন গ্রন্থ হিসেবে 'জাতক' পরিচিত। অপার বিভূতি সম্পন্ন সম্যকসম্বুদ্ধ- গৌতম বুদ্ধের অতীত জন্মের বৃত্তান্ত হিসেবে জাতকের গল্প বিশ্বাস অর্জন করেছে। গৌতম বুদ্ধের জীবনকাল ৫৬৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৮৩ খ্রিষ্টপূর্বাব্দ। সুতরাং জাতকের মূল কাঠামো এ সময় সীমায় সংকলিত। লৌকিক ঐতিহ্য, লোকসমাজ থেকে কালে কালে জাতকের কাহিনীগুলো সংকলিত হয়েছে। জাতকের অন্যতম উদ্দেশ্য ধর্মীয়, তাই লৌকিক কাহিনী ব্যবহারের পাশাপাশি ধর্মীয় দর্শনকেও প্রতিষ্ঠিত করতে হয়েছে। জাতকের লৌকিক উৎসজাত এই সমস্ত কাহিনী, গল্পকথা নিজ নিজ সংকলনের প্রয়োজনেই সংকলকরা সংগ্রহ ও সংকলন করেছিলেন। লৌকিক লোককথার আশ্রয়ে সহজ-সরলভাবে ধর্মীয় উপদেশ ও নীতিশিক্ষা দান। (লোককথার ইতিবৃত্ত, পৃ:১-৫)।

জাতক প্রায় আড়াই হাজার বছর পুরনো। 'জাতক' বৌদ্ধ ধর্মাদর্শ শিক্ষার জন্য সংকলিত- যা কালের বিচারে 'পঞ্চতন্ত্র' হতেও সুপ্রাচীন। প্রাচীন ভারতে রূপকথা সংকলিত হয়েছে সোমদেবের 'কথা সরিৎ-সাগরে'। মুসলিম শাসনামলে আরব্য ও পারস্য সাহিত্যের সঙ্গে ভারতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ফার্সি 'গুলে-বকাওলী'র অনবদ্য রোমান্স 'হাতেম তাই'র অদ্ভুত অ্যাডভেঞ্চার 'বাহার দানেশ' সিন্ধাবাদের সমুদ্র যাত্রার বিবরণ ও আলীবাবার গল্পের লোককথা কিস্‌সা হিসেবে বাংলার আনাচে-কানাচে দারুণ সাড়া ফেলে। ভারতবর্ষে মুসলমানদের আগমণের সঙ্গে সঙ্গে কিস্‌সার সর্বজনীন জনপ্রিয়তা অবিসংবাদিত হয়ে উঠে। বাঙালি মুসলমান পরিবারে লিখিত বাঙালি কিচ্ছা গৃহস্থালি সরঞ্জাম হয়ে ওঠেছিল। কিস্‌সার সাহিত্যিক ধারার গল্প-কথা-কাহিনী মৌখিকভাবে বংশপরম্পরায় প্রচারিত হয়ে ধারাবাহিকতা লাভ করে সৃজিত হয়েছে সাহিত্যের এক সমুজ্জ্বল অবয়ব।

কথিত আছে যে ১৫শ' শতাব্দী থেকে কিচ্ছা বাংলায় প্রচুর জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। বাঙালি মোসলমান লেখকরা তাদের কিচ্ছায় প্রেম, যুদ্ধ, ধর্ম এবং বীরত্বের আরবি-পারসি বিষয়গুলো মিশ্রিত করতেন। কিচ্ছা লেখার জন্য দোভাষী নামে বাংলার একটি লিখিত রূপ একটি জনপ্রিয় মাধ্যম ছিল। এটি সুবাহ বাংলা এবং শাহী বাংলার সরকারি ফার্সি ভাষার শব্দভান্ডার দ্বারা ব্যাপক প্রভাবিত হয়েছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে নিখিল বাংলাজুড়ে প্রচুর কিচ্ছা প্রকাশনা সংস্থা, বিশেষত বটতলায় ছাপাখানা প্রতিষ্ঠার আয়োজন করা হয়েছিল। হাওড়ায় মুসলমানি কিচ্ছা সাহিত্যের মতো সাহিত্য সমাজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। বিংশ শতাব্দীর শুরুতে অবশ্য কিচ্ছার জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে মূলত যখন বিশুদ্ধ বাংলার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ শুরু হয়, তখন দোভাষীর পাশাপাশি কিচ্ছাও জনপ্রিয়তা হারিয়ে ফেলে। কিচ্ছা সাহিত্যের মধ্যে পঞ্চদশ শতাব্দীতে শাহ মুহম্মদ সগীরের রচিত ইউসুফ-জুলেখা মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের সর্বশ্রেষ্ঠ রচনা হিসেবে বিবেচিত হতো। চট্টগ্রামের বাহরাম খান 'লায়লা ও মজনুর'র নিজস্ব সংস্করণ তৈরি করেছিলেন যাকে তিনি 'লাইলী-মজনু' নামে অভিহিত করেন। কবি নওয়াজীশ খান গুলী বাকাওয়ালি লিখেছিলেন, যা ছিল প্রেম সম্পর্কে এবং এতে তিনি পরীদের কথা অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। অন্যান্য বিখ্যাত কিচ্ছার মধ্যে রয়েছে আমীর হামজা, মধুমালতী, শীরীন-ফরহাদ, তুতিনামা, হাতিম-তায়ি, সখী সোনা, জঙ্গনামা, আলিফ-লায়লা ওয়া লায়লা এবং গুলে তরমুজ। কিস্‌সা সাহিত্যের প্রধান লেখক ছিলেন দৌলত কাজী, সৈয়দ হামজা, নাসের আলী, রওশন আলী এবং ফকির গরীবুলস্নাহ প্রমুখ।

আধুনিক বাংলা কিস্‌সা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক হলেন মীর মশাররফ হোসেন। তার কারবালার যুদ্ধ সম্পর্কে ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতিতে লেখা কিচ্ছা 'বিষাদ-সিন্ধ'ু, যা তিনি ঊনিশ শতকের শেষভাগে দোভাষীর পরিবর্তে শুধুমাত্র সংস্কৃত সাধু ভাষায় লিখেছিলেন। বাংলাদেশে প্রচলিত কিস্‌সার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হলো কালু গাজীর কিস্‌সা, গুনাইবিবির কিস্‌সা ইত্যাদি। কিস্‌সা উপদেশমূলকও হতে পারে যাতে জীবজন্তুর গল্পের মাধ্যমে নীতিকথা সংযোজিত থাকে- জাতক, ঈশপের গল্প, পঞ্চতন্ত্র ও হিতোপদেশ উলেস্নখযোগ্য। কিস্‌সায় থাকে পুরাণ কাহিনী- ধর্মবিশ্বাস ও ধর্মাচারের সঙ্গে সৃষ্টির লীলারহস্য যেমন লুকায়িত থাকে তেমনি থাকে অতিপ্রাকৃত রহস্যের কথাও। রূপকথাও কিস্‌সার মহিমাকে বাড়িয়ে তুলে- রাজা, রানী, রাক্ষস-ক্ষোকস, রাজপুত্র, রাজ্যজয় প্রভৃতির কাহিনীর মাদকতায়। কিস্‌সাকে আকর্ষণীয় করণে কিংবদন্তির ভূমিকা অপরিসীম- মানুষের দৈবশক্তি কিংবা অলৌকিকত্ব বিজ্ঞানমনস্কতার এই যুগেও শ্রোতাকে তন্ময়াবিষ্ট করে রাখে। আর কিস্‌সার রোমাঞ্চ- আলিফ-লায়লার কাহিনী, লাইলী-মজনুর কাহিনী, বোক্কাচিওর গল্প মোহমুগ্ধ করে রাখে সবাইকে। প্রযুক্তিযন্ত্রের ক্রমবর্ধমান উত্থান ও অবারিত ব্যবহারের দৌরাত্ম্যে আপন কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যবিমুখ এই প্রজন্মের কাছে আবাহমান বাংলার লোককাহিনীকে তুলে ধরতে হবে। গড়ে তুলতে হবে সাংস্কৃতিক আন্দোলন আর বাংলার লোকজ সংস্কৃতিকে শিশু-কিশোর, তরুণ-যুবা সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে হবে। এর জন্য বাংলার লোককাহিনী কিস্‌সার প্রচার প্রসার ও সংরক্ষণে জাতীয় পর্যায়ে উদ্যোগ গ্রহণ খুবই জরুরি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে