বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শাসসুল হকের (১৯৩৫-২০১৬) উপন্যাসসমূহে এসেছে বিষয় ও ভাবনায় নতুনত্ব। তিনি ইউরোপীয় ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন তত্ত্বের আবিষ্টতায় কখনো সমাজের পিচ্ছিল-ক্লেদাক্ত জীবনস্রোত ফুটিয়ে তুলেছেন, আবার কখনো স্বাধীনতা সংগ্রাম তথা মহান মুক্তিযুদ্ধের আবহকে বিষয়বস্তু হিসেবে তার উপন্যাসের কাহিনীতে চিত্রিত করেছেন একান্ত নিজস্বতায়। তার উপন্যাসে সমকালীন আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক পটভূমির পাশাপাশি ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ উপজীব্য বিষয় হয়ে উঠেছে বরাবরই। সমাজ বিবর্তনের ইতিবৃত্ত বিধৃত হয়েছে উপন্যাসের পরতে পরতে। নতুন জীবন ভাষ্য ও দর্শন ঔপন্যাসিকের চিন্তনকে করে তুলেছে বৈচিত্র্যময়।
সৈয়দ শামসুল হক বাংলা কবিতায় যেমন একটি স্বতন্ত্র স্থান করে নিতে সক্ষম হয়েছেন, তেমনি উপন্যাস ও ছোটগল্প সাহিত্যেও তার অবদান অশেষ। পাঁচ দশকেরও বেশি সময় ধরে তার সাহিত্যে জীবনের নানা জটিলতা, অনুসঙ্গ ও বৈচিত্র্য অনুসন্ধান করেছেন। সাহিত্য সাধনা করেছেন নিরলসভাবে। তার 'এক মহিলার ছবি' (১৯৫৯), 'দেয়ালের দেশ' (১৯৫৯), 'অনুপম দিন' (১৯৬২) 'খেলারাম খেলে যা' (১৯৭৩) পাশ্চাত্য উপন্যাসের বিষয় ও শিল্প ভাবনার গভীর অঙ্গীকারের পরিচয়বাহী। তার এ সব উপন্যাস আত্মমগ্ন চেতনা এবং সমাজ বিচ্ছিন্ন নৈঃসঙ্গ্যবোধের অস্বাভাবিক মানসিক জটিলতার অভিজ্ঞতালব্ধ শিল্পরূপ।
'এক মহিলার ছবি' (১৯৫৯) উপন্যাসের নায়িকা আত্মমগ্ন নাসিমা সমাজের অন্ত-অসঙ্গতির পেষণে আর্তনাদ করেছে। ভগ্ন স্মৃতিচারণায় তার ভারসাম্যহীন জীবন, নিঃসঙ্গতা, অবিশ্বাস আর মনস্তাত্ত্বিক জটিল জীবন ধরা পড়েছে। এ উপন্যাসে মূল্যবোধের আত্মসমীক্ষায় সতীত্ব সম্ভ্রমের প্রতি বিশ্বস্ততায় ক্রমরূপান্তরে নারীর জীবন জটিলতার সাম্প্রতিক ছবি ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
নাসিমা বিয়ের পর স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ততায় তার পূর্ব প্রেমের কথা প্রকাশ করে, কিন্তু তার স্বামী তাকে স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে না। গর্ভবতী অবস্থায় তার স্বামী তাকে সিঁড়ি থেকে একদিন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়। এ কারণে তাদের সম্পর্কচ্ছেদ ঘটে। বিপর্যয়ের এই গস্নানি, ব্যর্থতা ও হাহাকারের চিত্রই লেখক উপন্যাসের পরতে পরতে চিত্রিত করেছেন। নাসিমা চরিত্রের মানসিক প্রতিক্রিয়া এবং সামগ্রিক পরিবেশের চিত্র লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন। আত্মিক শূন্যতার পীড়ন, বিশ্বাস হারানোর দগ্ধ যন্ত্রণা নায়িকা নাসিমার মধ্যে ত্রিশোত্তর কালের 'প্রবল বিরুদ্ধবাদ আর বিহ্বল ভাব বিলাসে'র আধুনিক মনোভঙ্গি প্রকাশের ইঙ্গিতবাহী।
উপন্যাসের নায়িকা নাসিমা বিবাহিত তরুণী। স্বামীর নিষ্ঠুরতায় আত্মসচেতন হয়ে মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষায় সে নিয়োজিত হয়েছে অসামাজিক সম্পর্ক স্থাপনে। মন আর শরীর তার কাছে এক বস্তু নয়। স্বামীর নিষ্ঠুর আচরণে তার অবদমিত পূর্বপ্রেমের সম্পর্ক নিজের অস্তিত্বে জাগ্রত করেছে। সে পথ খুঁজেছে তার সান্নিধ্য লাভের। কলকাতার অসুস্থ ভাইয়ের সংসারে ফিরে যাওয়ার পর সে তার বান্ধবী বিনতা এবং দেবর প্রবীরের আনন্দ উলস্নাসে শান্তির পথ খোঁজার চেষ্টা করেছে। মাতৃত্বের আকাঙ্ক্ষা আশ্রয় করে কখনো জওয়াদকে, কখনো বরকে আবার কখনো আরজুর স্বামীর ছাত্র বেবির সঙ্গ লাভ করেছে। এ উপন্যাসে ফ্রয়েডীয় মনোবিকলন গভীরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
'দেয়ালের দেশ' (১৯৫৯) স্বতন্ত্র মহিমায় সমুজ্জ্ব্বল। ফ্রয়েডীয় মনঃসমীক্ষণ এ উপন্যাসের মূল উপজীব্য বিষয়। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় চরিত্র তাহমিনার সন্তানাঙ্খার মধ্য দিয়ে সমগ্র নারী হৃদয়ের সহজাত প্রবণতারই প্রতিফলন ধ্বনিত হয়েছে। উপন্যাসে তাহমিনা ও ফারুক একজন আর একজনকে ভালোবাসে। কিন্তু তাহমিনার বিয়ে হয় আবিদের সঙ্গে। কিন্তু তিন বছরের মাথায় তাদের কোনো সন্তান না হওয়ায় আবিদের সন্তান উৎপাদনের ক্ষমতা নেই বলে তাহমিনা জানতে পারে। বিষয়টি ফারুকের নজরে এলে ফারুক তাহমিনার সন্তানের পিতা হওয়ার দায়িত্ব নেয়। জীবনদৃষ্টির এ পরিবর্তন অগ্রহণীয় হলেও সৈয়দ শামসুল হকের এ উপন্যাসের কাহিনীতে স্থান পেয়েছে। প্রেমের এ জটিল রূপ তাহমিনাকে বিব্রত করেছে। স্বামীত্বের দাবি নিয়ে এবং তার অবৈধ সন্তানকে স্বীকার করে আবিদ পুনরায় তাহমিনার ওপর দাবি প্রতিষ্ঠা করলে তাহমিনা ফারুক বা আবিদ দু'জনের কাউকেই সমানভাবে গ্রহণ করতে পারেনি, বরং এই না পারার অক্ষমতার জন্য কষ্ট পেয়েছে। এখানে ফারুক হয়েছে সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র এবং আবিদ হয়েছে তার সম্ভোগের সঙ্গী। জৈব চেতনার প্রত্যক্ষ প্রভাব এ উপন্যাসে সুস্পষ্ট।
'অনুপম দিন' (১৯৬২) উপন্যাসে ষাটের দশকের মধ্যবিত্ত ও নগর জীবনের প্রেক্ষাপটে প্রেম ও যৌন-চেতনার মনস্তাত্তিক জটিলতা প্রাধান্য পেয়েছে। তবে এ উপন্যাসে জীবনবোধের অনুপস্থিতির কথাও কোনো কোনো সমালোচক উত্থাপন করেছেন। তবে, উপন্যাসে প্রতিফলিত মধ্যবিত্ত তরুণ সমাজ কীভাবে প্রেম বিষয়ক জটিলতায় অস্তিত্ব সংকটে পতিত হয়েছে এবং সে সংকট থেকে উত্তরণের প্রাণান্তকর চেষ্টাও তারা চালিয়েছে। যা ষাটের দশকের গোড়ার দিকে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত তরুণদের মধ্যে বিস্তৃতি লাভ করেছিল।
এ উপন্যাসে বীথি তার বড় চাচা মুরশেদ চৌধুরীর ঢাকার বাসায় থেকে ঢাকা কলেজে লেখাপড়া করে। চাচি মরিয়ম তাকে ভীষণ আদর করে। বীথির চাচাতো তিন ভাইয়ের মধ্যে বড় ভাই হাশেম এমএ পরীক্ষা না দিয়ে পাঁচ বছর আগে নিরুদ্দেশ থাকার পর একদিন হঠাৎ বাসায় উপস্থিত হয়। কিন্তু বাসায় নতুন আগন্তক বীথিকে দেখে সে চিনতে পারে না। মেঝ ভাই চাকরিজীবী মাহবুব স্ত্রীকে নিয়ে গেন্ডারিয়া থাকে। আর ছোট ভাই আবু বিশ্ববিদ্যালয়ের এমএ ক্লাশের ছাত্র। বীথি মনে মনে তাকে নিয়ে প্রেমিক পুরুষ হিসেবে কল্পনা করে। কিন্তু মুখ ফুটে বলতে পারে না। আর আবু বীথির স্বপ্ন বুঝতে পেরেও তাকে সে ভাবে চিন্তা করতে পারে না। এর কারণ আবু তারই বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী বিলকিসকে ভালোবাসে। কিন্তু বিলকিস ফ্লুয়েন্সে বসবাসকারী চিত্রকর মন্টির প্রেমে নিমগ্ন হয়ে আছে। মধ্যবিত্ত হাশেম-আবুর প্রেম উচ্চ শ্রেণির বকুল-বিলকিসের কাছে কাঁচা আবেগ বলেই প্রতিভাত হয়েছে। ফলে এ শ্রেণিদ্বন্দ্ব এই উপন্যাসের প্রেমকে জটিল স্তরে উন্নীত করেছে।
সৈয়দ শামসুল হকের ' খেলারাম খেলে যা' (১৯৭৩) উপন্যাসে সমাজ বিচ্ছিন্ন ব্যক্তির আত্ম-সুখসন্ধানী ও ভোগবাদী চেতনার মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। এ উপন্যাসে বাবর আলীর ক্লেদাক্ত, পিচ্ছিল জীবন স্রোতের মূলে রয়েছে তার মস্তিষ্ককোষে ক্রিয়াশীল লিবিডোর একাধিপত্য। অসংখ্য নারীর মধ্যে তৃপ্তি সন্ধানী বাবর আলীর জৈবিক আকাঙ্ক্ষা অনুসন্ধানই এ উপন্যাসে মুখ্য হয়ে উঠেছে।
'খেলারাম খেলে যা' উপন্যাসের নায়ক বাবর চলিস্নশ বছর বয়সি অবিবাহিত একজন যৌন পিপাসু মানুষ। সে দাম্পত্য জীবনের প্রথাসিদ্ধ নিয়ম রীতিতে বিশ্বাসী নয়। তবে নারীদের প্রতি রয়েছে তার বিশেষ আসক্তি। সে একে একে জাহেদা, বাবলি, লতিফা, শরীফা, মিসেস নফীসা-সবাইকে আকৃষ্ট করেছে। হোস্টেল ছাত্রী জাহেদাকে মিথ্যে টেলিফোন করে নিয়ে পাড়ি জমিেিয়ছে দূর শহরে। জাদুকরী বক্তব্যে অবসায়িত করেছে জায়েদাকে। সে জাহেদার কানের লতির কাছে ঠোঁট রেখে বলেছে- 'আমি তোমাকে ভালোবাসি'।
এ উপন্যাসের কাহিনীতে 'যৌন কল্পনার অবাধ বিচরণ' হলেও লেখক সমসাময়িক সমাজ বাস্তবতার বিচিত্র রূপকেই চিত্রিত করেছেন। মূলত, বাবর কৈশোরে বোনকে রেখে পালিয়ে আসার ফলে তার মধ্যে সীমাহীন গস্নানি, অপরাধবোধ, যন্ত্রণা ও অনুতাপের জন্ম নেয়। এসব ভুলে থাকার জন্য সে বেছে নেয় প্রতারণা ও লাম্পট্যের পথ। সে আসলে নিজের প্রতিই প্রতিশোধ নিয়েছে একের পর এক। কৈশোর থেকে যে আত্মদহন তার হৃদয়কে বারবার মানসিক বিপর্যস্ত করেছে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তার চরিত্রে। এতে এককভাবে বাবরকে একটি কামুক চরিত্র হিসেবে বিচার করা কঠিন।
বস্তুত, 'খেলারাম খেলে যা' উপন্যাসে প্রতীকী ব্যঞ্জনায় মহৎ একটি জীবন লক্ষণ বিদু্যতের মতো চমক দিয়েই মিলিয়ে গেছে সত্য। তবে পাঠকের চিন্তায় তার স্থায়িত্ব নেই। মুক্তিযুদ্ধে সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে ফেলে আসা বোন হাসুকে মনে করে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করেছে সে। গুন্ডাদের দ্বারা লাঞ্ছিতা জাহেদাকে বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ দিয়েছে বাবর। যৌনাচারের গস্নানিময় জীবন পরিণামে মানবতার শিকার হাসুকে নিয়ে। উপন্যাসের কেন্দ্রীয় শক্তি এটা হলেও সম্পূর্ণ উপন্যাসে এর স্থান নগণ্য। বাবর চরিত্রের নানা অসঙ্গতি যদি অন্তর্বাস্তবতা দিয়ে বিবেচনা করা যায়, তাহলে বাবরকে বাংলা সাহিত্যের এক আশ্চর্য বাস্তব, প্রগতিশীল ও দ্বন্দ্ব-বিক্ষুব্ধ ট্যাজিক চরিত্র হিসেবে বিচার করা একেবারে অযৌক্তিক নয়। আর 'খেলারাম খেলে যা'ও হয়ে ওঠে এক অসাধারণ উপন্যাস।