ত্রিশ, চলিস্নশ, ষাটের দশক আধুনিক কাব্যকলার নতুনমাত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং পরিবর্তিত বৈচিত্র্যের স্বাদে গন্ধযুক্ত। চলিস্নশের দশক পূর্ব বাংলার কবি ও কবিতার জন্য আশ্বাসনির্ভর কাল। কবি আবুল হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান, আহসান হাবিব ও ফররুখ আহমদ বাংলাদেশের কবিতা পাঠকের মনে আশা ও বরাভয়ের একটি প্রদীপ জ্বেলে দেন। পঞ্চাশের দশকে কবি শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ আরো কেউ কেউ বাংলাদেশের কবিতার মাঠকে ফসলময় করতে শুরু করেন। এদের আবির্ভাব ও প্রয়াসের অব্যাহত সৃজনশীল পরিশ্রমে বাংলাদেশের কবিতা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসের অন্তর্গত হওয়ার সক্ষমতা অর্জন করে।
ষাটের দশক বাংলাদেশের কবিতা তথা শিল্প সাহিত্যের জন্য অধিকতর উজ্জ্বল সময়। আবু হেনা মোস্তফা কামাল এ সময়ের একজন প্রতিশ্রম্নতিশীল শক্তিমান সাহিত্য শিল্পী হিসেবে নিজেকে হাজির করলেন। বাংলাদেশের কবিতা পাঠকরা কবিতা নিয়ে যে উচ্চকিত ব্যাপ্তির স্বপ্ন দেখেছিল তার স্ফূর্তি ঘটেছিল এই ষাটের দশকে। এ সময়ে আবু হেনা শিল্প সাহিত্যের বিচিত্র কর্মপন্থার মধ্য দিয়ে নিজেকে নতুন পরিচয়ে উপস্থিত করলেন এবং একশ্রেণির শিল্পমনস্ক মানুষের মনকে সচকিত করলেন। সবচেয়ে বড় ব্যাপার হলো ষাটের দশকে শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মের বিচিত্র ক্ষেত্রে আবু হেনার মতো দ্বিতীয়জন খুঁজে পাওয়া দুরূহ। অধ্যাপক, পন্ডিত, গবেষক, প্রাবান্ধিক, কবি ও গীতিকার সর্বোপরি তুখোর বক্তা ছাত্র জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক মুনীর চৌধুরীর বিশেষ নজরে পড়েছিলেন। মুনীর চৌধুরীর অকৃত্রিম স্নেহভাজন আবু হেনা পরবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার শিক্ষক মি. চৌধুরীর সহকর্মী হয়েছিলেন।
আবু হেনা মোস্তফা কামালের এক বর্ণাট্য ছাত্রজীবন ছিল। জন্ম গোবিন্দ গ্রাম, পাবনা। ১৯৫২ সালে তিনি পাবনা জেলা স্কুল থেকে প্রবেশিকা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে ত্রয়োদশ স্থান অধিকার করেন, ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে আই.এ পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে সপ্তম স্থান, ১৯৫৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় বিএ অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন। প্রথম শ্রেণিতে ২য় স্থান অধিকার করেন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান (আমারও দেশেরও মাটিরও গন্ধে- এই গানের গীতিকার) ১৯৫৯ সালে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান। প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় হন মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান। ১৯৫৯-১৯৬২ পর্যন্ত পাবনা এডওয়ার্ড কলেজ, রাজশাহী চাঁপাইনবাবগঞ্জ কলেজ ও রাজশাহী সরকারি কলেজে বাংলায় অধ্যাপনা, ১৯৬২-১৯৬৩ পর্যন্ত রাজশাহী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রভাষক, ১৯৬৫-১৯৭০ পর্যন্ত রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক, ১৯৭০-১৯৭৩ পর্যন্ত সহযোগী অধ্যাপক, ১৯৭৬-১৯৭৮ পর্যন্ত প্রফেসার, ১৯৭৮-১৯৮৪ পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগের প্রফেসর, ১৯৮৪-১৯৮৬ পর্যন্ত শিল্পকলা একডেমির মহাপরিচালক ও ১৯৮৬ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক রূপে কর্মরত ছিলেন।
কবি হিসেবে তিনি স্বভাব কবি নন বরং পরিশীলিত কবি। মেধা ও বুদ্ধি তার কবিতার শব্দ নির্বাচনের অবলম্বন। মূলত তিনি রোমান্টিক কবি, তবে তার রোমান্টিক চৈতন্য প্রগাঢ় বাস্তবতায় বিধৌত। তিনি অহেতুক মিথ্যা আশ্বাস থেকে জীবনকে দূরে রাখতে চান। তাই তার শিল্পভাবনা, কবিতাকে সমকালীন সমাজ ও জীবনের অতি কাছে নিয়ে এসেছেন। বুদ্ধিশাসিত আবেগের কারণে এটা সম্ভব হয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক যে প্রতিকূল পটভূমি মানুষের বিশ্বাসকে সন্দিগ্ধ করেছে তার নিষ্ঠুর চিত্র কবিতায় পাওয়া যায়। তিনি আগামী স্বপ্নে বিশ্বাসী নন। বর্তমানেই প্রবল আস্থাশীল। একটি অনির্বাচনীয় নিমর্মতায় এ জীবন নিয়ন্ত্রিত। এই সত্যের কাছে তিনি পরাজিত এবং বন্দি। সঙ্গত কারণে আপাত বর্তমান নিয়ে তিনি ভালো থাকতে চান। যেমন তিনি কবিতায় বলেন-
মধুর রেস্তোরাঁ থেকে বেরিয়ে
আমরা সবাই চলে গেলাম যে যার পথে
কেউ সচিবালয়ে তোপখানায়,
কেউ ইসলামাবাদে
কেউ প্যারিসে রোমে
রোঁয়া- ওঠা ইস্কুলে কলেজে......
দড়ির আগুন থেকে সিগারেট ধরিয়ে
আমরা যারা শীতের রাতে ঘনিষ্ঠ অভিজ্ঞতার গল্প
বিনিময় করেছি
তাদের কারো সঙ্গে কারো আর যোগাযোগ নেই
কেউ গুলশানে বিশাল বাড়ি রেখে
বনানীর সংক্ষিপ্ত আঁধারেই ঘুমিয়ে পড়েছে।
আবার অন্য একটি কবিতায় বলেন
শুনেছি সুখের সন্ধানে গিয়ে একটি রাশভারী কেতাব
আপনি লিখে ফেলেছেন, রাসেল।
অথচ তার কোনো দরকার ছিল না।
ত্রিশের দশকের পরবর্তী কবিদের কবিতা বুঝতে হলে পাঠককে ষাটের দশকের কবিতার কাছে ফিরে যেতে হবে। আর এই দশকের প্রধান কবি আবু হেনা মোস্তফা কামাল, এ কথা বললে হয়তো অমূলক হয় না।