শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

আধুনিক কবিতার ভাষা এবং নির্মাণ কৌশল

জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
  ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

কবিতার কোনো প্রসঙ্গ অথবা অনুষঙ্গ এলেই আমি তেঁতে উঠি। যদিও এমনিতে আমি নেহায়েত একজন সাদাসিধে নির্জীব টাইপের মানুষ। নিজেকে জড়বস্তুরসঙ্গে তুলনা করতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। কিন্তু আমার সেই জড় সত্তাটা কবিতার কথা শুনলেই জেঠে। কোথা থেকে জানি হঠাৎ ভাষা পায়। তরতর করে আকাশ দিয়ে হাঁটতে থাকে। ভালোবাসায় একাগ্রতায়।

সেই আমি আজ ময়মনসিংহ বিভাগীয় সাহিত্য পরিষদ আয়োজিত নিয়মিত সাপ্তাহিক আয়োজন চতুরঙ- ৩৯০ এ প্রধান আলোচক হিসেবে ছিলাম। আলোচ্য বিষয় ছিল আধুনিক কবিতার ভাষা এবং নির্মাণ কৌশল। একজন কবিতার পাঠক হিসেবে আমার কাছে বেশ লোভনীয় বিষয়। তাই আয়োজক কর্তৃপক্ষের অনুরোধ উপেক্ষা করার সাধ্য আমার ছিল না। কারণ কবিতা হলো বহতা নদীর ঢেউয়ের মতো। ঢেউ যেমন বাতাস দ্বারা তাড়িত আপনমনে চলতে থাকে; কবিতাও তেমনি কবির আবেগ দ্বারা তাড়িত হয়ে ইচ্ছেমতো ভাষায় লাবণ্য লাভ করতে থাকে। আর কবিতার সেই লাবণ্যে নিজেকে রঙিন করতে, ডুবসাঁতার কাটতে, রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ আস্বাদন করতে কবিতাপ্রেমী পাঠকরা ব্রতী হবেন।

আলোচনার শুরুতেই বেশ কয়েকজন বক্তার বক্তব্য শুনে আমার পিলে চমকে যাওয়ার মতো অবস্থা। তাদের প্রত্যেকের বক্তব্য মোটামুটি একই ঘরানার। কবিতা কোনো ভাষা নেই, কবিতার কোনো নির্মাণ কৌশল নেই। যারা বলেন কবিতার ভাষা আছে, নির্মাণ কৌশল আছে তাদের জ্ঞানের ঘাটতি আছে...ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ আয়োজকরা এটাকে আলোচনার শিরোনাম করেছেন! তাই বিষয়টি আমাকে যথেষ্ট ভাবিত করেছে এবং এ বিষয়ে কিছু লেখার জন্য উদ্ধুব্ধ করেছে। যদিও এই বিষয়ে আমার যথেষ্ট জ্ঞান আছে বলে আমি দাবি করিনি। তবুও প্রিয় পাঠক, আসুন এ বিষয়ে আমার জ্ঞানসীমার মধ্যেই কিছুটা আলোকপাত করা যাক।

আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, আধুনিক কবিতার ভাষা এবং নির্মাণ কৌশল দুটোই আছে। এক্ষেত্রে মিলিয়ন ডলার প্রশ্নটি হলো, কবিতার ভাষা বলতে আপনি কী বোঝেন? কেউ যদি কবিতার ভাষা বলতে, সাধারণ ভাষা যেমন: বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি, ফার্সি বুঝে থাকেন; তাহলে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া সুদূর পরাহত। কেননা আমি মনে করি, পৃথিবীর সব ভাষা-ই কবিতার ভাষা। কবিতার ভাষা মানে কবির ভাষা। মূলত আমাদের বুঝতে হবে যে, কবিতার ভাষা বলতে বুঝতে হবে- কবির মন, মানস, চিন্তন, চেতনা এবং সর্বোপরি কবি কবিতায় কী মেসেজ দিতে চান, কবিতাটি কিভাবে একজন পাঠকের অন্তরে নাড়া দেবে কিংবা পাঠক কিভাবে কবিতাটির সারবস্তু সম্পর্কে সাড়া দেবেন সেটাই একটি কবিতার ভাষা। এখানে সাধু ভাষা, চলিত ভাষা কিংবা মিশ্রভাষার কথা বোঝানো হয়নি। মূলত কবির ভাব, শব্দ চয়ন, বাক্য গঠন এবং ইত্যাদির মাধ্যমে যে অলংকরণ করা হয়; তাই কবিতার ভাষা।

আধুনিক কবিতার নির্মাণ কৌশল প্রসঙ্গে আলোচনার পূর্বে আরও কিছু কথা বলে নেওয়া সমীচীন মনে করছি। আমার পরিচিত কয়েকজন কবি এমন আছেন যে, যাদের নিজেদের মৌলিকত্ব বলতে তেমন কিছুই নেই। ওনারা বাংলা অভিধান এবং কয়েকজন বড় কবির কবিতা টেবিলে পরপর সাজিয়ে রাখেন। অতঃপর এসবের কোনো একটি কবিতাটিকে টার্গেট করে ক্লোন করা শুরু করেন। অর্থাৎ টার্গেট করা কবিতাটিতে বাংলা অভিধান কিংবা অভিজাত কবিদের কবিতা থেকে শব্দ এবং বাক্য ধার করে এনে সেই কবিতাটিকে একটি নতুন রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেন। তারপর ইহাকে নিজের নামে চালিয়ে দেন। ফেসবুকে পোস্ট করেন। এমনকি জাতীয় পত্রপত্রিকায় এসব কবিতা প্রকাশিত হতেও দেখা যায়। ভাবা যায় -কী সাংঘাতিক! তবুও এটাই নির্মম এবং অপ্রিয় সত্য! এই প্রক্রিয়ায় যারা কবিতা লিখছেন; তাদের জন্য আমার আজকের লেখা নয়। আমার লেখাটি তাদের জন্য যারা কিছু হোক কিংবা না হোক, অন্যের কবিতা ক্লোন করেন না; নিজ থেকে লেখেন। কবিতাকে মনে-প্রাণে ভালোবাসেন। কবিতা লেখা শিখতে চান -তাদের জন্য।

আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, কবিতায় একটি মেসেজ থাকা অতীব জরুরি। দুর্বোধ্য শব্দের ভারে আক্রান্ত মেসেজহীন কবিতা কোনো কবিতা নয়। কেননা এসব কবিতার মর্মার্থ পাঠক তো দূরের কথা অনেক ক্ষেত্রে কবি নিজেই জানেন কিনা আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। অথচ কিছু কিছু কবি বিমূর্ত ফরম্যাটের কবিতার নামে এসব লিখে যাচ্ছেন। ফলে এসব কবিতা পাঠকের অন্তরে কোনো জায়গা করে নিতে পারছে না। আঁস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। তবুও সেসব কবিদের আত্মম্ভরিতার সামনে প্রকৃত কবিরা টিকতে পারেন না। গলদ্ঘর্ম হন। অপ্রিয় হলেও ধ্রম্নব সত্য যে, আজকাল পাঠক কবিতাবিমুখ। এর প্রধান কারণ আধুনিক কবিতার দুর্বোধ্যতা। ভালো মানের কবিতার অভাব। সার্থক কবিতার অভাব। পাঠক হৃদয়ে নাড়া দিতে পারে এমন কবিতার অপ্রতুলতা।

সম্মানিত পাঠক, এবার আসুন আধুনিক কবিতার কৌশল সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত করা যাক। প্রথমত কবিতায় একটা সুনির্দিষ্ট মেসেজ থাকা চাই। কবিতার শব্দ চয়ন হতে হবে অবশ্যই যথাযথ। কবিতায় প্রকাশিত ভাবেরসঙ্গে সুসামঞ্জস্যপূর্ণ। অযথা ঘাড়ধরা শব্দের ব্যবহার সযত্নে পরিহার করতে হবে। অর্থাৎ কবিতার ভাবেরসঙ্গে মানানসই শব্দ চয়ন করতে হবে। লক্ষ রাখতে হবে শব্দের ভারে যেন কবিতা নুইয়ে না পড়ে। শব্দের ভারে যেন কবিতা পাঠকের বোধগম্যতার বাইরে চলে না যায়।

আধুনিক কবিতার বাক্য বিন্যাসও অত্যন্ত জরুরি। আমরা সবাই জানি, একটি সার্থক বাক্যের তিনটি অত্যাবশকীয় গুণ রয়েছে। যথা- আকাঙ্ক্ষা, আসক্তি এবং যোগ্যতা। এসব গুণের যে কোনোটির অভাবে বাক্যটি তার সৌকর্য হারাবে। বাক্যের গুণগতমান ক্ষুণ্ন হবে। ফলে একটি মানহীন বাক্য কবিতার ভাব ও ভাষায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে অনেক কবি-ই মনে করেন আধুনিক গদ্য কবিতায় সরলবাক্য ব্যবহার করা যাবে না। তাহলে তা কবিতা হবে না, গদ্য হয়ে যাবে। তাদের মতে, আধুনিক কবিতায় যৌগিক অথবা জটিল বাক্য ব্যবহার করতে হবে। আমি তাদেরসঙ্গে সম্পূর্ণরূপে ভিন্নমত পোষণ করি। অবশ্যই আধুনিক কবিতায় সরলবাক্য ব্যবহার করবেন। তবে তার উপস্থাপন কৌশল হবে শৈল্পিক। অর্থাৎ শব্দ এবং বাক্যের মায়াজাল সৃষ্টি করতে হবে। যেই মায়াজালে পাঠক মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় বাধা পড়বে।

আধুনিক কবিতার একটি বড় অনুষঙ্গ হল উপমা। কিন্তু এই উপমার ব্যবহার সম্পর্কে আমরা অনেকেই উদাসীন এবং দায়সারা। মনে হয় যে, উপমা যুৎসই হোক বা না হোক কোনোরকম একটা হলেই হলো। এ সম্পর্কে বাংলা ব্যকরণের সমাস অধ্যায়ের কিছুটা জ্ঞান থাকলে মন্দ হয় না। তাহলে উপমান এবং উপমেয় সম্পর্কে যখন সম্যক ধারণা চলে আসবে; তখনই কবিতায় উপমার ব্যবহার যথার্থ হবে। মনে রাখতে হবে, অপ্রাসঙ্গিক এবং সাযুজ্যহীন উপমার ব্যবহার কোনো মতেই কবিতার মান বৃদ্ধি করে না; বরং বহুলাংশে ক্ষুণ্ন করে। তাই উপমার ব্যবহারে আমাদের আরও সচেতন থাকা উচিত।

আধুনিক কবিতার আরও একটি বড় অনুষঙ্গ হলো, দৃশ্য কল্প বা চিত্রকল্প। আপনার কবিতাটি যখন একজন সম্মানিত পাঠক পাঠ করবেন, তখন প্রতিটি লাইন পাঠের সঙ্গে সঙ্গে তার চোখে একটি চিত্রকল্প ভেসে ওঠা চাই। আর এই চিত্রকল্প তখন সার্থক হবে, যখন তা পাঠকের জীবনের কোনো না কোনো অংশের সঙ্গে মিলে যাবে, মিশে যাবে। চিত্রকল্পহীন কবিতা মানেই দুর্বোধ্যতা দোষে দুষ্ট। এমন কবিতা নিঃসন্দেহে শব্দভূক পদ্য ব্যবসায়ীর মতো। যা কারও কারও সাময়িক বাহ্বা পেলেও ইতিহাস তা আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করবে। বাংলা সাহিত্যে আজ পর্যন্ত যত কালজয়ী কবিতা আছে, তাদের প্রতিটি কবিতা পাঠ করে দেখুন কত শক্তিশালী চিত্রকল্প বিদ্যমান। এই যেমন : রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ, কাজী নজরুল ইসলামের বিদ্রোহী, জসীম উদ্‌দীনের নিমন্ত্রণ, জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন, আল মাহমুদের নোলক, শামসুর রাহমানের স্বাধীনতা তুমি, তোমাকে পাওয়ার জন্য, হে স্বাধীনতা এবং সুনীলের কেউ কথা রাখেনি ইত্যাদি।

কবিতার বিষয়বস্তু সমসাময়িক, শ্বাশত, চিরন্তন কিংবা অনাগত ভবিষ্যতের ধারক-বাহক হওয়া বাঞ্ছনীয়। যে কবি সময়কে তার লেখনীতে যত বেশি মাত্রায় ধারণ করতে পারেন, হতাশার বেড়াজাল থেকে মুক্ত হয়ে পাঠককে আশা, আকাঙ্ক্ষা এবং স্বপ্নের চূড়ায় নিয়ে যেতে পারেন, ভবিষ্যতের যথার্থ দিকনির্দেশনা দিতে পারেন; সেই কবি ততো বেশি সফল। কেননা এসব কবিতা পাঠকের হৃদয়ে নাড়া দেয়, উদ্দীপনা সৃষ্টি করে, স্বপ্নের তরী বাইতে সাহায্য করে। অনেকে মনে করে থাকেন, কবিতার ভাব-ভাবনা সবসময় গুরুগম্ভীর হবে। অন্যথায় গদ্য এবং পদ্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকবে না? কবিতা গদ্য হয়ে যাবে। আমি এমনটি মনে করি না। আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, কবিতার ভাব সব সময়ই গম্ভীর হবে.. ব্যাপারটা এমন নয়। কবিতায় রস আস্বাদনেরও সুযোগ থাকা উচিত। এই যেমন শব্দরস, বাক্যরস এবং ভাবরস ইত্যাদি।

কবিতা লেখার উপরোক্ত কৌশলগুলো ছাড়া আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হলো, কবিতাকে মেদহীন হতে হবে। কবিতায় মেদ বলতে বোঝায়, বাহুল্য শব্দ, গুরুচন্ডালী এবং অপ্রয়োজনীয় উপমা, অলংকার এবং অনুপ্রাসের ব্যবহার। মনে রাখতে হবে, আপনার একটি কবিতা থেকে ভাব ঠিক রেখে যদি পাঁচ-দশটি শব্দও কেটে বাদ দেওয়া যায়; তাহলে ওই শব্দগুলোই আপনার কবিতার মেদ বা চর্বি। কবিতায় মেদ যত কম থাকবে; আপনার কবিতাও তত বেশি সার্থক হবে।

আমরা আলোচনার প্রায় শেষ পর্যায়ে চলে এসছি। কবিতার কৌশল হিসেবে আরও অনেক কিছু বলার ছিল। কিন্তু মাত্রাজ্ঞানের জন্য এখানেই থামতে হচ্ছে। প্রিয় পাঠক, সর্বোপরি জীবন ঘনিষ্ঠ কবিতা লিখুন। কবিতায় মানুষের সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, স্বপ্ন-সাধ চিত্রিত করুন। মনে রাখবেন, আপনার কবিতা আপনার অস্তিত্বের স্মারক। আপনার ব্যক্তিসত্তার নিয়ামক। সেই একটি সুষ্ঠু এবং শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গঠনের হাতিয়ার।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে