শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

শচীন দেব বর্মন সঙ্গীত জগতের ধ্রম্নব তারা

এস ডি সুব্রত
  ০৩ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

শচীন দেব বর্মন। সংক্ষিপ্ত করে বললে এসডি বর্মন। অনেকই হয়ত জানে না, এসডি বর্মন এই বাংলাদেশেরই সন্তান। ত্রিপুরার বিখ্যাত চন্দ্রবংশীয় মানিক্য রাজবংশে তার জন্ম। পিতার নাম নবদ্বীপচন্দ্র দেববাহাদুর। সঙ্গীত জগতে তিনি শচীন কর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। হওয়ার কথা ছিল ত্রিপুরার রাজা। হয়ে গেলেন বাংলা গানের মুকুটহীন সম্রাট। করেছেন অসংখ্য কালজয়ী সব গান- যার আবেদন কমেনি আজও। নতুন প্রজন্মের কাছে তিনি আজও আইকন। ১৯৩২ সালে কলকাতা রেডিও দিয়ে যাত্রা শুরু। একই সঙ্গে করেন মঞ্চ নাটকেও সঙ্গীত পরিচালনা। ১৯৩৪ সালে নিখিল ভারত সঙ্গীত সম্মেলনে গান গেয়ে স্বর্ণপদক লাভ করেন।

'তুমি এসেছিলে পরশু, কাল কেন আসোনি?' কিংবা 'আমি তাকদুম তাকদুম বাজাই বাংলাদেশের ঢোল' অথবা 'বাঁশি শুনে আর কাজ নাই' আরও আছে 'শোনো গো দখিন হাওয়া', 'নিশিতে যাইও ফুল বনে', 'কে যাস রে ভাটির গাঙ বাইয়া'! এখানেই শেষ নয়! 'তুমি যে গিয়াছ বকুল-বিছানো পথে', 'ঝিলমিল ঝিলমিল ঝিলের জলে', 'ঘাটে লাগাইয়া ডিঙা'।

এমন অসংখ্য কালজয়ী গান যেমন তার হাত ধরে এসেছে তেমনি তিনি গড়ে তুলেছেন এই উপমহাদেশের অনেক বিখ্যাত গায়ক, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালককেও। ভারতীয় সঙ্গীতে তিনি স্রষ্টার মতো। গানের আঙিনায় তাকে সম্মান করে ডাকা হয় 'কর্তা' বলে। লোকজ ও রাগ সঙ্গীতের সংমিশ্রণে সঙ্গীত ভুবনে এক নতুন ধারা সৃষ্টি করতে পেরেছিলেন তিনি।

ত্রিপুরার রাজবংশ নিয়ে অনেক গল্প-কাহিনী প্রচলিত আছে। এসব কাহিনী নিয়ে মানে রাজবংশের ইতিহাসকে আশ্রয় করে পঞ্চদশ শতাব্দীতে রাজা ধর্মমাণিক্যের আদেশে একটি গ্রন্থ প্রণীত হয়। পদ্যে রচিত গ্রন্থটির নাম দেওয়া হয় 'রাজমালা'। পরবর্তী সময়ে গ্রন্থটির তথ্য হালনাগাদ করা হতে থাকে। সেই সময় ত্রিপুরা সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, শ্রীহট্ট এবং কুমিলস্না। তাই এই বইতে এসব অঞ্চলের ইতিহাসও উঠে এসেছে।

'রাজমালা' ছয়টি লহর বা খন্ডে বিভক্ত। এই খন্ডগুলোর যুগে যুগে আধুনিকীকরণ হয়েছে। রাজবংশেরই একজন কর্মচারী ১৮৯৬ সালে ত্রিপুরার ইতিহাস নিয়ে আরেকটি গ্রন্থ রচনা করেন। এটির নামও দেওয়া হয় 'রাজমালা'। গ্রন্থটির রচয়িতা ছিলেন শ্রী কৈলাসচন্দ্র সিংহ। বইটি রচনা করা হয় মহারাজ বীরচন্দ্র মানিক্য বাহাদুরের আমলে।

বীরচন্দ্র মানিক্য রাজা হওয়ার আগে সিংহাসনের আরেকজন শক্ত উত্তরাধিকারী ছিলেন। তিনি শচীন দেব বর্মনের বাবা নবদ্বীপচন্দ্র দেববাহাদুর, বীরচন্দ্রের সৎভাই। সিংহাসনের অধিকার পাওয়ার লোভ বীরচন্দ্রকে হিংস্র ও নির্দয় করে তোলে। তিনি কয়েকবার নবদ্বীপচন্দ্রকে হত্যার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে নবদ্বীপচন্দ্র রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ কর্মচারী কৈলাসচন্দ্র সিংহের পরামর্শে কুমিলস্নায় চলে আসেন এবং স্থায়ীভাবে বসবাস করা শুরু করেন। রাজসিংহাসনের দাবি ত্যাগ করার পর কুমিলস্না শহরের দক্ষিণে চর্থা এলাকায় নবদ্বীপচন্দ্রকে বীরচন্দ্র ৬০ একর জমি দান করেন। এখানে নবদ্বীপচন্দ্র একটি দালান নির্মাণ করেন। এই দালানেই শচীন দেব বর্মনের জন্ম হয়।

ছোটবেলা থেকেই একটি সঙ্গীতের আবহে বেড়ে ওঠেন শচীন দেব বর্মন। বাবা ছিলেন একজন সেতারবাদক ও ধ্রম্নপদী সঙ্গীত শিল্পী। বাবার কাছেই গ্রহণ করেন সঙ্গীতের তালিম। এরপর ওস্তাদ বাদল খান এবং বিশ্বদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে।

শচীন দেব বর্মনের সঙ্গীত শিক্ষার জন্য অনেকের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন। এদের মধ্যে আছে কানাকেষ্ট, ওস্তাদ আফতাবউদ্দিন খাঁ, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, ফৈয়াজ খাঁ, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়, আব্দুল করিম খাঁ প্রমুখ। নবদ্বীপচন্দ্রের কুমিলস্নার বসতভিটার বিপরীত দিকে ছিল আরেক জমিদারবাড়ী। সবাই ডাকত মুনশিবাড়ী। সেই বাড়ির ইতিহাস থেকে জানা যায়, মুনশিবাড়ির ছেলে মর্তুজ মিয়া আর শচীন দেব ছিলেন বাল্যবন্ধু। কৈশোরে একদিন রাতের বেলা শচীন দেব আর মর্তুজ মিয়া মুনশিবাড়ির সামনের রাস্তায় পায়চারি করছিলেন। শচীন দেব এর মধ্যে গুনগুনিয়ে গান গাওয়া শুরু করে দেন। শচীন দেবের গান অন্দরের ভেতর থেকে মুগ্ধ হয়ে শুনছিলেন জমিদার নাবালক মিয়া। তিনি চাকর সফর আলীকে সঙ্গে সঙ্গে পাঠিয়ে দেন রাস্তায় কে গান গাইছে তাকে নিয়ে আসার জন্য। সফর আলী শচীন দেবের কাছে এসে বলেন, 'শচীনকর্তা, হুজুর আপনাকে ডাকছে।' শচীন দেব এতে খুব ভয় পেয়ে যান। কাঁপতে কাঁপতে হাজির হন নাবালক মিয়ার সামনে। জমিদার তাকে বলেন, 'কিরে, তোর তো গানের গলা খুব ভালো। কোনো বাদ্যযন্ত্র আছে কি তোর?' শচীন দেব না-বোধক উত্তর দিলে নাবালক মিয়া তাকে হারমোনিয়াম, তবলা, পিয়ানোসহ কয়েক প্রকার বাদ্যযন্ত্র কিনে দেন।

এভাবে সুখেই কাটছিল তার বাল্যকাল। ম্যাট্রিক, আইএ ও বিএ কুমিলস্না থেকে পাস করে ১৯২৪ এ মাত্র ১৮ বছর বয়সে শচীন দেব কলকাতায় যান এম এ পড়ার জন্য। সেখানে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে এম এ ক্লাসে ভর্তি হন। কুমিলস্নাতে পড়ে থাকে তার স্মৃতি আর পরিবারের সহযোগিতায় গড়া সংগঠনগুলো। ত্রিপুরার মহারাজাগণের অনুগ্রহে সেকালেই কুমিলস্নাতে গড়ে উঠেছিল নাট্যশালা, লাইব্রেরি, টাউন হল, সাংস্কৃতিক সংঘ ইত্যাদি। ১৯১০ থেকে ১৯২০ মাত্র ১০ বছরের মধ্যেই কুমিলস্নাতে গড়ে ওঠে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। দ্য গ্রেট জার্নাল থিয়েটার পার্টি ও ইয়ংমেন্স ক্লাব ইংরেজ সাহেবগণের দ্বারাও প্রশংসিত হয়েছিল। এর ফলে এখানে কবি-সাহিত্যিক-সুধীজনদের আনাগোনা বাড়তে থাকে। কাজী নজরুল ইসলামও এখানকার প্রেমে পড়ে যান। কবি এখানে এলে থাকতেন তালপুকুরের পশ্চিম পাড়ের একটি ঘরে। এখান থেকেই কবি লিখেছিলেন তার বিখ্যাত ছড়া বাবুদের তালপুকুরে হাবুদের ডাল-কুকুরে। শচীন দেব আর নজরুল ইসলাম ছিলেন ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

শচীন দেব বর্মন 'সরগমের নিখাদ' নামে আত্মজীবনী রচনা করেন। সেখানে তিনি তার জীবনের উত্থান ও ব্যর্থতার কথা লিখেছেন। শচীন দেবের বয়স যখন পঁচিশ তখন তার বাবা কলকাতায় মৃতু্যবরণ করেন। পিতার মৃতু্যর পরে শচীন দেবের জীবনে নেমে আসে অনিশ্চয়তার ছায়া। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, 'পিতার মৃতু্যর পর আমি যেন অগাধ জলে পড়ে গেলাম। এই অবস্থায় আমি আগরতলা বা কুমিলস্না গিয়ে থাকলে রাজকীয় আরামে ও নিশ্চিন্তে নিজেদের বাড়িতে বাস করতে পারতাম এবং রাজ্য সরকারের কোনো উচ্চপদে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারতাম। আমার বড় ভাইরা আমাকে তা-ই করতে বললেন। আমার কিন্তু এ ব্যবস্থা মনঃপূত হলো না। নিজে একলা সংগ্রাম করে, নিজে উপার্জন করে সঙ্গীত সাধনায় জীবন কাটিয়ে দেব। মনের মধ্যে একমাত্র এই আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কলকাতার ত্রিপুরা প্রাসাদ ছেড়ে ভাড়া করা সামান্য একখানা ঘরে আমি আস্তানা বাঁধলাম।'

১৯৩৪-এ সর্বভারতীয় সঙ্গীত সম্মেলনে গান গেয়ে শচীন দেব স্বর্ণপদক জয় করেন। পরের বছর বেঙ্গল সঙ্গীত সম্মেলনে ঠুমরি পেশ করে ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁকে মুগ্ধ করেন। ১৯৩৭ শচীন দেবের জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর। এ বছর তিনি তার পরবর্তী সঙ্গীত জীবনের প্রেরণা শ্রীমতি মীরা দাশগুপ্তাকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর তার নাম পাল্টে রাখা হয় মীরা দেব বর্মন। মীরা দেব বর্মন ছিলেন তৎকালীন ঢাকা হাইকোর্টের চিফ জাস্টিস রায় বাহাদুর কমলনাথ দাশগুপ্তের নাতনি। ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শচীন দেব ও মীরা দেব বর্মন দুজনেই তালিম নিতেন। একসঙ্গে সঙ্গীতের পাঠ নিতে নিতে এক সময় তারা প্রণয়সূত্রে আবদ্ধ হন- যা গুরু ভীষ্মদেব ভালো চোখে দেখেননি। এরপর ভীষ্মদেবের সঙ্গে শচীন দেবের সম্পর্ক শিথিল হওয়া শুরু করে এবং শেষে ভীষ্মদেব সব ছেড়েছুড়ে পন্ডিচেরির দিকে রওনা হন। তারপর মীরা দেব বর্মন শচীন কর্তার কাছে সঙ্গীতের দীক্ষা নেওয়া শুরু করেন। একই বছর তাদের বিয়েও হয়। স্বামীর মতো তিনিও ছিলেন সঙ্গীতের জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র এবং সফল ব্যক্তিত্ব। বিয়ের দু'বছর বাদে তাদের একটি সন্তান হয়। সে-ও পরবর্তী সময়ে বাবার মতো সুরজগতের প্রবাদপুরুষ হয়ে উঠেছিল। নাম রাহুল দেব বর্মন। তার প্রাপ্তি '৩৪-এ গোল্ড মেডেল দিয়ে শুরু। এরপর পেলেন ফিল্মফেয়ার, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, সঙ্গীত ও নাটক একাডেমি অ্যাওয়ার্ড, বিএফজেএ অ্যাওয়ার্ডসহ বেশ কিছু পুরস্কার। ১৯৬৯-এ তাকে দেওয়া হয় ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতার পদ্মশ্রী। পরের বছর শক্তি সামন্তের আরাধনা ছবির সফল হোগি তেরি আরাধনা গানটির জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র শ্রেষ্ঠ পুরুষ পেস্নব্যাক গায়ক পুরস্কার পান শচীন দেব। চার বছর পর জিন্দেগি জিন্দেগি ছবির সঙ্গীত পরিচালনার জন্য জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক। ১৯৭৫ সালে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃতু্যবরণ করেন। সারা জীবন সঙ্গীতের সাধনায় রত থেকেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাভ করেছেন সীমাহীন সম্মান ও ভালোবাসা। তবুও একটি বারের জন্য ভোলেননি বাংলা মায়ের কোল। তাইতো নিঃসঙ্কোচে গেয়েছেন-

'কই সে হাসি, কই সে খেলা, কই সে বুনোরোল আমি সব ভুলে যাই, তাও ভুলি না বাংলা মায়ের কোল'।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে