শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহর চাঁদের অমাবস্যা

ড. শাফায়েত আলী
  ১০ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০

'চাঁদের অমাবস্যা' (১৯৬৪) সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহর (১৯২২-১৯৭১) দ্বিতীয় উপন্যাস। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৬৪ সালে। অর্থাৎ 'লালসালু' উপন্যাস প্রকাশের চৌদ্দ বছর পর। এই উপন্যাসটির ভূমিকায় জানা যায়, 'এই উপন্যাসটির বেশিরভাগ ফ্রান্সের আল্পস পর্বত অঞ্চলের পাইন-ফার এলম গাছ পরিবেষ্টিত ইউরিয়াজ নামক ক্ষুদ্র একটি গ্রামে লেখা'। এ সময়ে তিনি যে শুধু বিদেশ অবস্থান করেছিলেন তা-ই নয়, ইউরোপীয় পরিবেশ অভিজ্ঞতা, রুচি, দৃষ্টিভক্তি ও শিল্পচিন্তা ইত্যাদির ক্ষেত্রে তার মানস পরিবর্তন ঘটেছিল এবং দেশ-বিদেশের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি, দার্শনিক ও পন্ডিতের সঙ্গে তার বন্ধুত্ব হয়েছিল। তার এই বিশ্বগ্রাহী চেতনা ও আধুনিক মননের ফসল- চাঁদের অমাবস্যা। 'লালসালু'র পাশে 'চাঁদের অমাবস্যা' উপন্যাস হিসেবে পুরোপুরি নিরীক্ষাধর্মী। 'লালসালু' সমাজমনস্ক উপন্যাস। এতে ব্যক্তি ও জনজীবনের চিত্র প্রচুর ও বিপুলভাবে আকীর্ণ। কিন্তু চাঁদের অমাবস্যা ভিন্নধর্মী উপাদানে সমৃদ্ধ। এ উপন্যাসের যে কাহিনি তা জীবনের একটি সাধারণ বৃত্তান্ত বা চিত্র মাত্র নয় এবং পরিস্থিতির অভিনবত্ব ব্যক্তিমানুষের চিত্তে মনোজাগতিক যে সংকট ও আলোড়ন সৃষ্টি করে তার জটিল বুননিকে ফুুটিয়ে তোলাই এ উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহর লক্ষ্য। 'চাঁদের অমাবস্যা' উপন্যাসের কাহিনির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে একটি যুবতী নারীর মৃতু্য এবং জ্যোৎস্না-পস্নাবিত রাতে, বাঁশঝাড়ের ভেতরে তার মৃতদেহ আবিষ্কার। সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ সফল ঔপন্যাসিকের শক্তিশালী লেখনি দিয়ে এই ঘটনাকে উপস্থাপিত করেছেন, আরেফ আলীর জীবন-ভাষ্য রচনায়। তার চরিত্রের মানস পরিক্রমা ও বিশ্লেষণের ধারাতেই অগ্রসর হয়েছে উপন্যাসের কাহিনি। তার সূত্রপাত হয়েছে তখনই যখন সে আকস্মিকভাবে একটি অভাবিত পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। জ্যোৎস্না-পস্নাবিত রাত্রে বাঁশঝাড়ের মধ্যে যুবতী নারীর মৃতদেহ দর্শন তার নিরাবেগ জীবনপ্রবাহের আকস্মিক ছন্দপতন ঘটায়। আরফ আলী ঘটনাকেন্দ্রিক জটিলতায় আক্রান্ত হয় এবং তাকে অতিক্রম করতে গিয়ে তার অন্তরে দ্বন্দ্বময় আবেগের সূচনা হয়। শুরু হয় তার আত্ম-দ্বন্দ্ব ও আত্ম জিজ্ঞাসা। মূল ঘটনাকেন্দ্রিক সেই আত্মসমীক্ষাকেই সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ আধুনিক কথাশিল্পীর দক্ষতা সহকারে ফুটিয়ে তুলেছেন। উপন্যাসটি বস্তুত কেন্দ্রীয় চরিত্র আরেফের সদ্য জাগ্রত বিবেকের উজ্জীবিত চেতনার স্বাক্ষর। এই জীবনচেতনার রূপায়ণে ওয়ালীউলস্নাহ আমাদের উপন্যাসের, ঐতিহ্যগত কাঠামোতে ঘা দিয়েছেন এবং সাহসী শিল্পীর সৃজনশীলতা নিয়ে এ উপন্যাসে ঐতিহ্য এবং উদ্ভাবনকে সমন্ব্বিত করেছেন।

উপন্যাসটির শুরুতেই কেন্দ্রীয় চরিত্র আরেফের জীবনের মহা ঘটনাটি ঘটে গেছে। এক চন্দ্রলোকিত রজনীতে আরেফ আলী বেরিয়েছিল ঘর ছেড়ে। প্রকৃতির অপার সৌন্দর্যে অভিভূত ও কৌতূহলী আরেফ আলী জীবনে প্রথমবারের মতো এক আশ্চর্য বিস্ময়ের সম্মুখীন হয়। বাঁশঝাড়ে নির্জন রাতে নিঃসঙ্গ নির্মম হত্যাকান্ড আর প্রবঞ্চক হত্যাকারীকে দেখে সে। আপাত শান্ত জীবন চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। এ থেকে শুরু হয় তার মানস পরিব্রাজুনা। বহু দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও তরঙ্গ সংক্ষুব্ধ মানস পরিক্রমাকে সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ প্রচলিত ছক বাঁধা কাহিনিতে ফুটিয়ে তোলেননি। বরং পাশ্চাত্য দর্শন ও সাহিত্যরীতিকে তিনি এ ক্ষেত্রে কাজে লাগিয়েছেন।

'চাঁদের অমাবস্যা' উপন্যাসে কোপন নদীর ধারের ক্ষুদ্র চাঁদপরা গ্রামের জনৈক অর্ধশিক্ষিত যুবক শিক্ষক আরেফের। বিবেক চেতনার কাহিনি লিপিবদ্ধ করতে গিয়ে সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ বক্তব্য ও প্রকরণের দিক থেকে সর্বজনীন বিশ্ব প্রসারিত ও নিরীক্ষাশীল। তবু বিষয় আবহ নির্মাণে তিনি একান্তভাবে বাংলাদেশের জনজীবন মূল সম্পৃক্ত। তাই এ উপন্যাসটি বাংলদেশের সমাজ পটভূমিতে ব্যক্তির সংকট, সংশয়, আত্মবিশ্লেষণ ও আত্মজাগরণের আধুনিক জীবনভাষ্য।

অতি সংক্ষিপ্ত কাহিনিসূত্র এ উপন্যাসের কোপন নদীর তীরবর্তী চাঁদপাড়া গ্রামের জনৈক যুবক শিক্ষিত আরেফ আলী শীতের এক উজ্জ্বল জ্যোৎস্না রাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়েছিল প্রকৃতির প্রয়োজনে। প্রয়োজন মিটিয়ে ঘরে ফিরে না গিয়ে সে। চন্দ্রালোকিত রজনীর রূপরাশিতে মোহাবিষ্ট হয়। হঠাৎ ছায়া শরীরের আকর্ষণে সে গ্রামের পথে বেরিয়ে পড়ে। বাঁশঝাড়ে নিহত এক রমণীর লাশ দেখে সে ঘটনাটি আরেফ আলীর মনোলোকে আলোড়ন তোলে। প্রকৃত ব্যাপারটি ছিল আরেফ আলী গ্রামের যে বড়বাড়িতে আশ্রিত গৃহশিক্ষক সেই বড়বাড়িরই অন্যতম কর্তাপুরুষ কাদের আলী নিম্ন শ্রেণির এক রমণীকে সম্ভোগের উদ্দেশ্যে বাঁশঝাড়ে যায়; আরেফ সেই কাদেরকেই অনুসরণ করেছিল। আরফের পদশব্দে ভয় পেয়ে কাদের রমণীটিকে গলাটিপে হত্যা করে। উপন্যাসের সিংহভাগ ব্যয়িত হয়েছে আরেফ আলীর মনে উক্ত ঘটনার প্রতিক্রিয়া বর্ণনায়। শেষ পর্যন্তই ঘটনাটি সে প্রথমে দাদাসাহেবকে এবং পরে পুলিশকে জানায়। পুলিশ জেনে-শুনেই কাদেরের বদলে তাকে খুনী সাব্যস্ত করে।

'চাঁদের অমাবস্যা' উপন্যাসের ঘটনার মূল কেন্দ্রে রয়েছে মাত্র তিনটি চরিত্র। আরেফ আলী, কাদের ও দাদাসাহেব। দাদাসাহেব ও তথাকথিত দরবেশ কাদেরদের বড়বাড়ির ধর্মীয় পরিবেশের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে যুক্তিবাদী যুবক শিক্ষক আরেফ আলীকে। নিজের মনোলোকে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ও কাটা ছেঁড়া করে সে ধর্ম ও বিত্তবানের। স্বরূপ উদঘাটনে এক দৃঢ় ভূমিকা নেয়। তিনটি মূখ্য চরিত্রের মধ্যে আরেফ আলী ও কাদের উপন্যাসের সমস্ত ঘটনার নিয়ন্ত্রক। দাদাসাহেব চরিত্রটি সে তুলনায় কিছুটা গুরুত্বহীন।

'চাঁদের অমাবস্যা' উপন্যাসটি আগাগোড়াই আরেফের জাগ্রত বিবেকের রক্তাক্ত পথ অতিক্রমণের নিপুণ অন্তর্বিশ্লেষণ। ওয়ালীউলস্নাহ উপন্যাসের এয়ী নায়ক মজিদ, মুহাম্মদ মুস্তফা ও আরেফ আলীর মধ্যে নিঃসন্দেহে এই সংবেদনশীল, স্বাপ্নিক ও মুখচোরা যুবক শিক্ষকই সবচেয়ে গভীর মানবদরদী। আত্মকেন্দ্রিকতার ঊর্ধ্বে ওঠা এই চরিত্রটি সবচেয়ে বেশি সামাজিক অঙ্গীকারবদ্ধ ও দায়িত্ববোধসম্পন্ন হয়ে ওঠেছে। 'চাঁদের অমাবস্যা' উপন্যাসে দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রটি হচ্ছে কাদের। অলস নিষ্কর্মা ও লম্পট কাদের বড়বাড়ির সদস্য হওয়ার সুযোগ নিয়ে নিজের চারপাশে আভিজাত্যময় ও অলৌকিক একটি দুর্গ তৈরি করেছে। এই দুর্গের আড়ালে তার প্রকৃত স্বরূপকে সে লুকিয়ে রাখতে পেরেছে। তার সন্দেহযুক্ত ও উদ্দেশ্যহীন চাল-চালনের কোনো সদুত্তর না পেয়ে তার বড় ভাই দাদাসাহেব আলফাজউদ্দীন তাকে দরবেশ আখ্যা দিয়েছে। গ্রন্থের প্রথম দিকে কাদেরের চরিত্র অস্পষ্ট ও রহস্যময় বলে মনে হলেও সে যে তথাকথিত দরবেশী, লেবাসের আড়ালে একজন নরপশু সেটি ক্রমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সাধারণ চোখে তাকে জাগতিক ব্যাপারে নির্লিপ্ত বলে মনে হলেও শেষে তার চরিত্রের প্রকৃত স্বরূপ উদঘাটিত হয়। 'চাঁদের অমাবস্যা' উপন্যাসে তৃতীয় যে চরিত্রটির কথা উলেস্নখ করতে হয় তা দাদাসাহেবের। বড়বাড়ির অভিভাবক আরেফের আশ্রয়দাতা, দাদাসাহেব আলফাজউদ্দীন বাঙালি মুসলমান সমাজের উদ্ভট ঐতিহ্যবোধ ও আভিজাত্য মনোভাবের প্রতিনিধি- অতীতের স্মৃতিচারণের মধ্যেই তার অপরিসীম আনন্দ। ঔপন্যাসিক জানাচ্ছেন- 'তাদের ঘোড়াশালে তখন ঘোড়া ছিল, হাতিশালে হাতি। খিলস্নাত পরিধান করে রেশমের খরিতায় পত্রাদি বাঁধতেন, খাসমহল, আতর-বাইদমস্কের সুগন্ধিতে ভরপুর করত এবং উৎসবের দিনে বাদশাহী কায়দায় পথে-ঘাটে মোহদ ছড়াতেন। তখন আবার চোবদার রাখতেন গন্ডায় গন্ডায়, সবর-সেবন্দিও পুষতেন। আজ সেদিন আর নাই।' দৃষ্টিকোণের ব্যবহার : দৃষ্টিকোণ, পরিচর্যা, চরিত্রায়ণ, সময়ের বিন্যাস, ভাষারীতি প্রতিটি ক্ষেত্রেই 'চাঁদের অমাবস্যা' প্রথাগত উপন্যাস থেকে স্বতন্ত্র। আপাতভাবে লেখকের সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণ ব্যবহৃত হয়েও, এ উপন্যাসে মূলত শিল্প প্রক্রিয়ায় কার্যকর থেকেছে ভীতসন্ত্রস্ত, আতঙ্কশিহরিত আরফ আলীর অতিসংবেদনশীল প্রেক্ষণবিন্দু। অস্তিত্বগত প্রান্তিক পরিস্থিতির তীক্ষ্নমুখ আঘাতে আরেফ আলী আত্ম-যন্ত্রণাকাতর, চেতনা-অবচেতনায় রক্তাক্ত, সত্যানুসন্ধানে আত্ম খননকারী, জটিল ও স্তরবহুল, অভিজ্ঞতায় ক্রমসংকুচিত। ব্যক্তি অস্তিত্ববলয় ও চেতনালোকে সর্বজ্ঞ দৃষ্টিকোণের সঞ্চরণশীলতা একরৈখিকভাবে উপস্থাপিত হয়নি। চরিত্র ও চেতনার দৃষ্টিকোণও পরিবর্তিত হয়েছে। সর্বজ্ঞ ঔপন্যাসিক পটভূমির যে চিত্ররূপ উপস্থাপন করেছেন, প্রথাগত, এমন কি, সমকালীন বাংলা উপন্যাসের পরিপ্রেক্ষিতেও তা ব্যতিক্রমী। যেমন- 'শীতের উজ্জ্বল জ্যোৎস্না রাত, তখনো কুয়াশা নাবে নাই। বাঁশঝাড়ে তাই অন্ধকারটা তেমন জমজমাট নয়। সেখানে আলো-অন্ধকারের মধ্যে যুবক শিক্ষক একটি যুবতী নারীর অর্ধ-উলঙ্গ মৃতদেহ দেখতে পায়। অবশ্য কথাটা বুঝতে তার একটু দেরি লেগেছে, কারণ তা ঝট করে বোঝা সহজ নয়। পায়ের ওপর এক ঝলক চাঁদের আলো। শুয়ে শুয়ে নাই।'

'চাঁদের অমাবস্যা' উপন্যাসের কাহিনি বর্ণনায় লেখক সর্বদর্শী দৃষ্টিকোণ অবলম্বন করেছেন। তবে সংবেদনশীল যুবক শিক্ষক আরেফ আলীর সত্য অন্বেষার ক্ষেত্রে তার মনোজগতে আলোড়ন বিলোড়নের ফলে যে গভীর যে ক্ষত সৃষ্টি হয় তা ফুটিয়ে তুলতে আরেফ আলীর দৃষ্টিকোণ ব্যবহৃত হওয়ায় উপন্যাসে সেটি প্রাধান্য পেয়েছে। উপন্যাসের প্রায় পুরো অংশটা জুড়ে জগৎ, জীবন, ঘটনা, মানুষ ও প্রকৃতিকে ওয়ালীউলস্নাহ দেখেছেন আরেফ আলীর চোখে দেখা বাস্তবতার জগৎ। 'চাঁদের অমাবস্যা' উপন্যাসের ভাষা চৈতন্য প্রবাহ ধারায় উৎসারিত হয়েছে। অভিযোগ করা হয়ে থাকে, 'চাঁদের অমাবস্যা' উপন্যাসে চৈতনা প্রবাহ রীতি ব্যবহারের ফলে এ উপন্যাসের ভাষা পাঠকের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম হারিয়ে ফেলেছে। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, এ উপন্যাসে যে ভাষার ব্যবহার লেখক করেছেন তাতে ফরাসি আঙ্গিকে বাংলা লেখা বা তার একটি নিজস্ব লেখ্যভঙ্গি তৈরি হয়েছে। কিন্তু এ দু'টি মতের কোনোটিই গ্রহণযোগ্য নয়। বস্তুত, তিনি উপন্যাসের বিষয়বস্তুর সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই ভাষা ব্যবহার করেছেন এবং ফরাসি আঙ্গিকে বাংলা লেখা বা নিজস্ব একটি লেখ্যভঙ্গি সৃষ্টির কোনো ঘোষিত লক্ষ্য ওয়ালীউলস্নাহর কখনোই ছিল না। বরং বলা চলে, ভাষার প্রশ্নে তিনি দেশজ আবহটি সযত্নে রক্ষা করেছেন। এ ছাড়াও বিষয় ও চরিত্র অনুসারে উপন্যাসের ভাষার বর্ণনাভঙ্গিতে যে শৈলী ফুটে ওঠেছে তাও তাঁর সচেতন প্রয়াস। এ সম্পর্কে তিনি নিজেই বলেছেন, 'এই বইয়ের ভাষা আমি ইচ্ছাকৃতভাবেই 'ফলটারিং' করেছি। দ্বিধাগ্রস্ত যুবক শিক্ষকের বিলম্বিত চৈতন্যকে ফুটিয়ে ভোলার জন্য কিছুটা হোঁচট খাওয়ার ভঙ্গি তৈরি করতে হয়েছে। ...একবার ভেবেছিলাম, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের গদ্যভঙ্গির সঙ্গে আধুনিক গদ্যভঙ্গির মিশ্রণ ঘটিয়ে চরিত্রের দ্বিধা-দ্বন্দ্বকে স্পষ্ট করব, কিন্তু গল্পের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট হবার ভয়ে সে দিকে অগ্রসর হইনি।' সুতরাং এ উপন্যাসের ভাষায় যে বিশিষ্ট শৈলী গড়ে ওঠেছে তা এই বিশ্বগ্রাহী ঔপন্যাসিকের নিজস্ব সচেতন শিল্প প্রয়াসেরই স্বাক্ষরবাহী। ঔপন্যাসিক নিজস্ব ভাষাভঙ্গি উপন্যাসের পরিস্থিতিগত উদ্ভট এবং আরেফ আলীর মনের চেতন-অচেতনা লোকের ভাবনা ধারা প্রকাশের ক্ষেত্রে অত্যন্ত উপযোগী হয়েছে। এই ভাষায় তেমন তিনি তার উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের আবেগ-অনুভূতি মানসক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার পুঙ্খানপুঙ্খ বিবৃতি দান করেছেন। তেমনি তার মনোভাবনা বিশ্লেষণের মধ্য দিয়ে উপন্যাসের উপজীব্য বিষয় বা নেপথ্য উদ্দেশ্যকেও সিদ্ধ করেছেন। 'চাঁদের অমাবস্যা'র ভাষা বহুমাত্রিক। লেখক যখন আরেফ আলীর প্রসঙ্গ ও তার মানস-ভাবনাকে বর্ণনা করেন তখন। সে ভাষা হয়ে ওঠে তার মানস-দ্বন্দ্বের প্রকাশক ও আবেগধর্মী। যেমন- 'বালক বয়সের পরপর তিন বছর লায়লাতুল কদরের রাতে যুবক শিক্ষক সমস্ত রাত জেগে ছিল এই আশায় যে, গাছপালাকে ছেজদা দিতে দেখবে। গাছপালা এমন ভক্তিমূলক আচরণে আজ আর তার বিশ্বাস নেই। কিন্তু রাত্রি জাগরণের। ফলে তার মনে যে নতুন ধারণার সৃষ্টি হয় সে ধারণা এখনো সে যেন কাটিয়ে উঠতে পারে নাই।' পক্ষান্তরে, ইসলাম ধর্মপ্রাণ দাদাসাহেবের কথা বর্ণনা করতে গিয়ে ভাষা ইসলাম ধর্মের আবহমন্ডিত হয়ে পড়ে- 'বংশের আসল দাম ধন-দৌলতের ওপর নির্ভর করে না। গরিব হলেও আসল খানদানী বংশের দাম পড়ে না। শুধু সোনারূপা, হাতি, ঘোড়া, পাইক বরকন্দাজের শানশওকাত থাকলেই একটি বংশ খানদান হয় না। খানদানীর মূলভিত্তি হলো নেক চরিত্র, ধর্মের প্রতি ভক্তি-নিষ্ঠা সাধুতা দয়াশীলতা বিনয় নিরাভিমান ব্যবহার ইত্যাদি।' আবার পরাবাস্তবতার পরিবেশ নির্মাণ করতে ভাষা ধোয়াটে ও অস্পষ্ট আবহ তৈরির অনুষঙ্গী। প্রথম পরিচ্ছেদ জ্যোৎস্নাপস্নুত রাতে আলো-আঁধারের মধ্যে যুবতী নারীর মৃতদেহ দেখার পর যে মানসিক ধাক্কা খায় তাতে আরেফ আলী প্রহেলিকা ও কুয়াশার এক অদৃশ্য আস্তরণের মধ্যে বাস্তব-অবাস্তবের মাঝখানে বিচরণ করে। এই কুজ্ঝটিকাময় পরাবাস্তবতার জগৎ তৈরি হয়েছে ক্রমাগত প্রতীপাভাস ব্যবহারের ফলে- ১. তারপর বাঁশির আওয়াজ সুতীব্র হয়ে ওঠে। অবশ্য বাঁশির আওয়াজ সে শোনেনি। ২. ঝলমলে জ্যোৎস্না, কিন্তু সামনে নদী থেকে কুয়াশা ওঠে আসছে। কুয়াশা না আর কিছু তা ঠিক বোঝা যায় না। হয়তো একদল সাদা বকরি দেখে- যার শিং, দাঁত চোখ কিছুই নাই। আরেফ আলীর মনোৎসারিত উপলব্ধির এরকম বহু বর্ণনার উদ্ধৃতি দেওয়া সম্ভব। চৈতন্য প্রবাহরীতিতে অগ্রসর হয়ে এ উপন্যাসের ভাষা কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাব্যধর্মী হয়ে পড়েছে- ১. যুবতী নারী আর তাকায় না কেন? মাছরাঙ্গাও নিশ্চুপ হয়ে অপেক্ষা করে। ২. মনের অতল গহ্বর থেকে হঠাৎ একটি চেহারা ভেসে ওঠে। তেমনি চুল, তেমনি বাষ্পাকৃত মুখ, চোখে একটা অস্পষ্ট আকাঙ্ক্ষা। তেমনি নীরব। পরনে তেমনি লালপেড়ে শাড়ি। 'চাঁদের অমাবস্যা' উপন্যাসে সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ শক্তিশালী শিল্পীর দক্ষতা নিয়ে বাস্তব-অবাস্তব, স্বপ্ন-দুঃস্বপ্ন, সুপ্তি-জাগরণ, চেতনা-অবচেতনাকে একটি সামান্য সুতোর এপারে-ওপারে রেখে পারাপার করতে চেয়েছেন। অত্যাধুনিক সাহিত্য-তরঙ্গের ধারণামতো মানব-মন ও জীবনকে পূর্ণতর করে জানার এইটেই শ্রেয়তর ও নতুনতর আঙ্গিক-বিক্ষণ বলে তার ধারণা অন্তত এ গ্রন্থ এ কথাই বলে। এই নিরীক্ষাধর্মী উপন্যাসে অচিরাচরিত আঙ্গিক-বীক্ষণের মাধ্যমে সৈয়দ ওয়ালীউলস্নাহ যে আধুনিক পাশ্চাত্যরীতি ও কৌশল অবলম্বন করে এখানে প্রচলিত উপন্যাসের পরিধিকে অতিক্রম করে গেছেন তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে