শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

ছোটগল্পের সেকাল ও একাল

জসীম উদ্দীন মুহম্মদ
  ০৩ মে ২০২৪, ০০:০০
ছোটগল্পের সেকাল ও একাল

নিঃসন্দেহাতীতভাবেই বলা যায়, ছোটগল্প বাংলা সাহিত্যের একটি অন্যতম প্রধান জনপ্রিয় শাখা। যদিও এখন ধারণা করা হয়; ছোটগল্পের ধারাবাহিক ঐতিহ্য এবং জৌলুশের দিন আর নেই। আমি মনে করি, এই কথাটি যেমন পুরোপুরি সত্য নয়, তেমনি একেবারে মিথ্যাও নয়। এর মানে দাঁড়ায় আংশিক সত্য। আসলেও তাই। ছোটগল্পের যৌবন এখন অনেকাংশেই ম্রিয়মাণ। আগেকার মতো শক্তিশালী ছোটগল্প লেখক যেমন এখন সংকট; তেমনি সংকট পাঠকের। অবশ্য লেখক এবং পাঠকের যোগসূত্রটি এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কারণ পাঠক না থাকলে যেমন লেখক আগ্রহ হারাবেন; তেমনি ভালো মানের লেখক এবং মানসম্পন্ন লেখা না থাকলেও পাঠক আগ্রহ হারাবেন। তাই বলা যায়, বাংলা সাহিত্যে কবিতার মতো ছোটগল্পও এখন একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। একজন শখের কবি এবং কথাসাহিত্যিক হিসেবে আমি চাই, এই ক্রান্তিকাল আমাদেরই অতিক্রম করতে হবে। এজন্য ভিনগ্রহ থেকে কেউ এসে আমাদের ভাষা ও সাহিত্যের ক্রান্তিলগ্ন কেউ দূর করে দিয়ে যাবে না।

বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে জানা যায় ছোটগল্প নতুন কোনো ধারা নয়। বরং এর রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস এবং ঐতিহ্য? বোকাচ্চিওর ডেকামেরন, চসার এর গল্প, ঈশপের গল্প, সংস্কৃতে বিষ্ণুশর্মার হিতোপদেশ ও পঞ্চতন্ত্র, সোমদেবের কথা সরিৎসাগর, বৌদ্ধ সাহিত্যে জাতকের গল্প ইত্যাদি ছোটগল্পের বুনিয়াদি আবেদনেরই প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। তাদের পরও অনেক কথাসাহিত্যিক ছোটগল্প লিখে সাহিত্যের পাতায় অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। তবে বাংলা সাহিত্যে ছোটগল্পের ইতিহাস খুব বেশি পুরনো নয়। ঊনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়। এখন স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে, তাহলে ছোটগল্প কী? ছোটগল্পের সংজ্ঞাও অনেক ক্ষেত্রেই আপেক্ষিক। ই এ পো এর মতে, 'যে গল্প অর্ধ হতে এক বা দু'ঘণ্টার মধ্যে এক নিশ্বাসে পড়ে শেষ করা যায়, তাকে ছোট গল্প বলে।' এইচ জি ওয়েলস বলেন, 'ছোট গল্প ১০ হতে ৫০ মিনিটের মধ্যে শেষ হওয়া বাঞ্ছনীয়।' আমরা ছোটগল্পের সংজ্ঞা নিয়ে কোনো প্রকার বিতর্কে যেতে চাই না। আমি মনে করি,

ছোটগল্প সাধারণত তাকেই বোঝায়, যা আধঘণ্টা থেকে এক বা দুঘণ্টার মধ্যে এক নাগাড়ে পড়ে শেষ করা যায়। তবে আকারে ছোট হলেই তাকে ছোটগল্প বলা যাবে না। কারণ ছোটগল্পের প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো, এতে বিন্দুতে সিন্ধুর বিশালতা থাকতে হবে, অর্থাৎ অল্প কথায় অধিক ভাব ব্যক্ত করতে হবে। উপন্যাসের সঙ্গে এর মৌলিক পার্থক্য এখানেই। ছোটগল্পে উপন্যাসের বিস্তার থাকে না, থাকে ভাবের ব্যাপকতা। উপন্যাস পড়ে পাঠক পরিতৃপ্তি লাভ করে, কিন্তু ছোটগল্প থেকে পায় কোনো ভাবের ইঙ্গিতমাত্র। ছোটগল্প পাঠ করার পরও পাঠকের মনে অতৃপ্তি অনুভূত হয়। ক্ষুদ্র কলেবরে নিগূঢ় সত্যের ব্যঞ্জনাতেই ছোটগল্পের সার্থকতা। এ বিষয়ে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বর্ষাযাপন কবিতাটি বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি লিখেছেন,

ছোট প্রাণ, ছোট ব্যথা ছোট ছোট

দুঃখকথা/নিতান্তই সহজ সরল,/সহস্র বিস্মৃতিরাশি প্রত্যহ যেতেছে ভাসি/তারি দু-চারিটি অশ্রম্নজল।/ নাহি বর্ণনার ছটা ঘটনার ঘনঘটা,/ নাহি তত্ত্ব নাহি উপদেশ।/অন্তরে অতৃপ্তি রবে সাঙ্গ করি মনে হবে/ শেষ হয়ে হইল না শেষ।

রবিঠাকুরের উপরোক্ত কবিতাটিতে ছোটগল্পের বেশ কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা হয়েছে। এই যেমন: এর ক্ষুদ্রায়তনের মধ্যে বৃহতের ইঙ্গিত থাকবে অর্থাৎ বিন্দুতে সিন্ধুর বিশালতা থাকবে, আরম্ভ ও উপসংহার নাটকীয় হবে, বিষয়বস্তু সাধারণত স্থান, কাল ও ঘটনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে, মানবজীবনের কোনো একটি বিশেষ মুহূর্ত, ভাব বা চরিত্রের একটি বিশেষ দিক উজ্জ্বল হয়ে প্রতিভাত হবে, যে কোনো ধরনের বাহুল্য বর্জনের মাধ্যমে গল্পটি হয়ে উঠবে রসঘন, রূপক বা প্রতীকের মাধ্যমে অব্যক্ত কোনো বিষয়ের ইঙ্গিত থাকবে ইত্যাদি। সর্বোপরি গল্প সমাপ্তির পরও পাঠকের মনের মধ্যে এর ঘটনার ঘনঘটা তথা আবহের গুঞ্জরণ চলতে থাকবে। আশা করা যায়, তাহলেই তা সার্থক ছোটগল্পে পরিণত হবে।

বাংলা সাহিত্যে যিনি প্রথম ছোটগল্প লিখে আলোচনায় আসেন তিনি হলেন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়। তবে বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ছোটগল্প লিখেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার গল্পস্বল্প, গল্পগুচ্ছ, তিনসঙ্গী প্রভৃতি গল্পগ্রন্থ রয়েছে। আরও যারা ছোটগল্প লিখে খ্যাতি কুড়িয়েছেন তারা হলেন, প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, সরোজকুমার, শৈলজানন্দ, বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়, মনীন্দ্রলাল বসু, মনোজ বসু প্রভৃতি লেখকগণ। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামও বেশ কয়েকটি সার্থক গল্প লিখে সুনাম কুড়িয়েছেন ; যা পরে বাংলা নাটকে চিত্রায়িত হয়েছে। পরে যারা জীবনের সমস্যাকে অত্যন্ত সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন, তাদের মধ্যে প্রেমেন্দ্র মিত্র, বুদ্ধদেব বসু, অচিন্ত্য সেন, সুবোধ ঘোষ উলেস্নখযোগ্য। আরও কিছু উলেস্নখযোগ্য নাম স্মরণ না করলে তাদের প্রতি অবিচার করা হবে বলে আমি মনে করি। যেমন: আবুল মনসুর আহমদের আয়না, শওকত ওসমান, আবু রুশদ,আলাউদ্দিন আল আজাদ, আব্দুর গাফফার চৌধুরী,; হাসান আজিজুল হক, খালেদা এদিব চেীধুরী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস আল মাহমুদ, শাহেদ আলী, শওকত আলী, জ্যোতি প্রকাশ দত্ত, শহীদ সাবের, রাহাত খান, হাসনাত আব্দুল হাই, শহীদ আখন্দ, আব্দুস শাকুর, সুব্রত বড়ুয়া, হাসান হাফিজুর রহমান প্রমুখ।

ধারণা করা হয়, স্বাধীনতা উত্তর সময়ে অর্থাৎ ১৯৭১ খ্রি. পরবর্তী বাংলাদেশের ছোটগল্পে নতুন নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়েছে, যোগ হয়েছে নতুন মাত্রা। নানা সুরে বৈচিত্র্যময় হয়ে উঠেছে ছোট গল্পের প্রাঙ্গণ। জীবনের কলগুঞ্জন যেমন প্রতিধ্বনিত হয়েছে সেখানে, তেমনি প্রতিফলিত হয়েছে মানুষের হৃদয়বৃত্তির রূপায়ন। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তি মানুষের নিদারুণ জীবন সংকট ফুটে উঠেছে। তখন ছোটগল্পে পলস্নী জীবন ও নগর জীবনের চিত্র পাশাপাশি চিত্রিত হয়েছে। তবে আশা করা যায়, ভবিষ্যতে জীবনের সূক্ষ্ণাতিসূক্ষ্ণ বিষয়গুলো আরও ব্যাপকভাবে পরে ছোটগল্পে ফুটে উঠবে এবং বাংলা ছোটগল্প একদিন বিশ্বের অন্যতম সেরা ছোটগল্পের পাশে সমানতালে দাঁড়াবে।

এবার আমার শিরোনামের দিকে না তাকালেই নয়। আজকের মূল আলোচ্য বিষয় হলো ছোটগল্পের শরীরতত্ত্ব। প্রসঙ্গত সেকাল-একাল। রবীন্দ্রপূর্ব এবং রবীন্দ্র-উত্তর অধিকাংশ লেখা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তখনকার ছোটগল্প ঘটনা তথা কাহিনীনির্ভর। বিশেষভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, ওই সময়কার লেখা ঘটনা দিয়েই শুরু হতো। তারপর কালানুক্রমিক ও ধারাবাহিকভাবে ঘটনার ঘনঘটা চলতে থাকত। ডায়ালগের আধিক্য থাকত। গল্পের ভাষা এবং ভাব সহজ, সরল, সাবলীল এবং অনাড়ম্বর হতো। ঘটনার বাইরে তেমন একটা অলঙ্কার, রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শ পরিলক্ষিত হতো না। একটা দীর্ঘসময় বাংলা ছোটগল্পের এই ধারা অব্যাহত ছিল। অবশ্য এখনো কারও কারও লেখায় এই ধারাপাত এখনো বিদ্যমান আছে।

কিন্তু আধুনিক ছোটগল্পের শরীর তত্ত্বে এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। তবে এ ক্ষেত্রে আধুনিক শব্দটি ব্যবহার না করে উত্তরাধুনিক ব্যবহার করাই আমার কাছে অধিকতর যুক্তিযুক্ত। অধুনা ছোটগল্প আগের মতো এতোটা ঘটনা বা কাহিনীনির্ভর নয়। এক কথায় বলতে গেলে এখনকার ছোটগল্প ফিলোসোফি বা দর্শননির্ভর।

এখন ছোটগল্পে খুব একটা কাহিনী পাওয়া যায় না। যতটুকু পাওয়া যায় তা নিতান্তই যৎসামান্য। অনেক ক্ষেত্রে ঘটনা বা কাহিনীর ছিটেফোটাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এর পরিবর্তে যা পাওয়া যায় তা হলো, তাত্ত্বিক বক্তব্য, অনেকটা কবিতার মতো কাব্যিক সুষমা এবং ভাষাবিন্যাস। কার লেখা ছোটগল্প নাম প্রকাশ না করেই বলছি, কিছুদিন আগে একটা লেখা দুই-দুইবার পড়লাম, লেখাটা বেশ মোহময় ছিল। শব্দের পর শব্দ, বাক্যের পর বাক্য আমাকে টানছিল। কিন্তু কবিতা পড়ছি নাকি গল্প পড়ছি সেটা বুঝতে পারিনি। কেবল ভাষার চুম্বকীয় ব্যবহার, অলংকার ছাড়া ভেতরে আর তেমন কিছুই নেই। এই হলো উত্তরাধুনিক ছোটগল্পের শরীরতত্ত্ব।

আমার প্রশ্ন হলো, কাব্যিক ভাষা, শব্দ ও বাক্যগঠনের চমতকারিত্বের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা কি ছোটগল্পের মূল ধারা থেকে সরে যাচ্ছি না? আমার তো মনে হয়, আমরা ইতোমধ্যে অনেকটা সরে গেছি। ছোট গল্পে যদি কোনো গল্প বা কাহিনীই না থাকে তবে তা কেমন ছোটগল্প? আরও একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয় যখন কোনো কবি গল্প লেখেন; তখনই তার গল্প কাব্যের ভারে এমনভাবে ভারী হয়ে যায় যে, তা আর গল্প থাকে না। আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, ছোটগল্পের এই ধারা আমাদের জন্য তেমন একটা কল্যাণ বয়ে আনবে না। বরং এতে আমরা ছোটগল্পের মূল ধারা থেকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাব। তাই আমাদের এখনই এ বিষয়ে সচেতন হওয়া জরুরি বলে আমি মনে করি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়
X
Nagad

উপরে