শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১

জীবনবাদী কথাসাহিত্যিক এলিস মুনরো

নোবেল পুরস্কারের ঘোষণায় মুনরোকে 'সমকালীন ছোটগল্পের মাস্টার' অভিহিত করে নোবেল কমিটি বলেছিল, 'তিনি খুব সুন্দর করে গুছিয়ে গল্প বলতে পারেন। তার গল্পের বিষয়বস্তু সুস্পষ্ট ও বাস্তববাদী। ছোটগল্পের স্থাপত্যে ও শিল্পে বৈপস্নবিক পরিবর্তন এনেছেন তিনি
সালাম সালেহ উদদীন
  ১৭ মে ২০২৪, ০০:০০
জীবনবাদী কথাসাহিত্যিক এলিস মুনরো

পরপারে চলে গেলেন সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী কানাডার লেখক এলিস মুনরো। ১৩ মে সোমবার কানাডার অন্টারিওর পোর্ট হোপে একটি সেবাকেন্দ্রে তার মৃতু্য হয়। এই লেখকের বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। ৬০ বছরের বেশি সময় ধরে ছোটগল্প লিখেছেন মুনরো। কানাডার গ্রামীণ জীবন ছিল তার বেশির ভাগ লেখার উপজীব্য। এলিস মুনরোর গল্পে যে অন্তর্দৃষ্টি ও সমবেদনা ফুটে উঠেছে, সেজন্য তাকে প্রায়ই রাশিয়ার লেখক আন্তন চেখভের সঙ্গে তুলনা করা হতো।

২০১৩ সালে এলিস মুনরো সাহিত্যে নোবেল পান। তিনি গভর্নর জেনালের অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন তিনবার। ম্যান বুকার পুরস্কারও জিতেছেন তিনি। ১৯৯৬ সালের কানাডার রাইটারস ট্রাস্ট অফ কানাডার মেরিয়ান এঙ্গেল পুরস্কার এবং ২০০৪ সালের রজার্স রাইটার্স ট্রাস্ট ফিকশন পুরস্কার ফর রানওয়ের জন্য পেয়েছেন পুরস্কার। নোবেল পুরস্কারের ঘোষণায় মুনরোকে 'সমকালীন ছোটগল্পের মাস্টার' অভিহিত করে নোবেল কমিটি বলেছিল, 'তিনি খুব সুন্দর করে গুছিয়ে গল্প বলতে পারেন। তার গল্পের বিষয়বস্তু সুস্পষ্ট ও বাস্তববাদী। ছোটগল্পের স্থাপত্যে ও শিল্পে বৈপস্নবিক পরিবর্তন এনেছেন তিনি। বিশেষ করে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে যাওয়ার প্রবণতা তার লেখার মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। মুনরোর কথাসাহিত্য প্রায়শই দক্ষিণ-পশ্চিম অন্টারিওতে তার স্থানীয় হুরন কাউন্টির কথা উঠে এসেছে। তার গল্পগুলো একটি জটিল গদ্যশৈলীতে মানুষের জটিলতাগুলো অন্বেষণ করেছে।

মুনরো অন্টারিওর উইংহামে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা রবার্ট এরিক লেইডলা ছিলেন একজন শিয়াল এবং মিঙ্ক চাষী এবং পরে টার্কি চাষে পরিণত হন। তার মা অ্যান ক্লার্ক লেইডল ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষিকা। তিনি আইরিশ এবং স্কটিশ বংশোদ্ভূত ছিলেন। তার বাবা ছিলেন স্কটিশ কবি জেমস হগ, এট্রিক শেফার্ডের বংশধর। মুনরো কিশোর বয়সে লিখতে শুরু করেন। ১৯৫০ সালে দুই বছরের বৃত্তিতে ওয়েস্টার্ন অন্টারিও বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি এবং সাংবাদিকতা অধ্যয়নের সময় তার প্রথম গল্প 'দ্য ডাইমেনশনস অফ এ শ্যাডো' প্রকাশ করেন। এই সময়ে তিনি একজন পরিচারিকা, একজন তামাক বাছাইকারী এবং একজন গ্রন্থাগারের কেরানি হিসেবে কাজ করেছিলেন।

মুনরোর অত্যন্ত প্রশংসিত গল্পের প্রথম সংকলন, ডান্স অফ দ্য হ্যাপি শেডস (১৯৬৮), গভর্নর জেনারেল পুরস্কার পান, তারপর কানাডার সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার জিতেছিলেন তিনি। সেই সাফল্যের পর লাইভস অফ গার্লস অ্যান্ড উইমেন (১৯৭১) প্রকাশিত হয়। এটা তার আন্তঃসংযুক্ত গল্পের বলিষ্ঠ সংকলন।

১৯৭৯ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া, চীন এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়া সফর করেছিলেন তিনি। ১৯৮০ সালে তিনি ইউনিভার্সিটি অফ ব্রিটিশ কলাম্বিয়া এবং ইউনিভার্সিটি অফ কুইন্সল্যান্ড উভয়েই লেখকের পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৮০ থেকে ২০১২ পর্যন্ত মুনরো প্রতি চার বছরে অন্তত একবার একটি ছোটগল্পের সংগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। দ্য আটলান্টিক মান্থলি, গ্র্যান্ড স্ট্রিট, হার্পারস ম্যাগাজিন, ম্যাডেমোইসেল, দ্য নিউ ইয়র্কার, ন্যারেটিভ ম্যাগাজিন এবং দ্য প্যারিস রিভিউ-এর মতো জার্নালে মুনরোর গল্পের প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছে। তার গল্পগুলো ১৩টি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

মুনরো সম্পাদক এবং প্রকাশক ডগলাস গিবসনের সঙ্গে তার দীর্ঘকালের মেলামেশার জন্য বিখ্যাত। গিবসন ১৯৮৬ সালে ম্যাকক্লেল্যান্ড এবং স্টুয়ার্টে ডগলাস গিবসন বইয়ের ছাপ লঞ্চ করার জন্য কানাডার ম্যাকমিলান ত্যাগ করলে মুনরো অগ্রিম ম্যাকমিলান তাকে দ্য প্রোগ্রেস অফ লাভের জন্য অর্থ প্রদান করেছিলেন, যাতে তিনি নতুন কোম্পানিকে অনুসরণ করতে পারেন। মুনরো এবং গিবসন তাদের পেশাগত সম্পর্ক বজায় রেখেছিলেন। ২০১১ সালে গিবসন যখন তার স্মৃতিকথা প্রকাশ করেন, তখন মুনরো ভূমিকা লিখেছিলেন এবং তার মৃতু্যর আগ পর্যন্ত গিবসন প্রায়শই মুনরোর পক্ষে প্রকাশ্যে উপস্থিত হতেন, যখন তার স্বাস্থ্য তাকে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হতে বাধা দেয়।

মুনরোর অনেক গল্প অন্টারিওর হুরন কাউন্টিতে সেট করা হয়েছে। তার শক্তিশালী আঞ্চলিক উপস্থাপন তার কথাসাহিত্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। নোবেল পুরস্কার জেতার পর তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, 'ছোট শহর কানাডিয়ান জীবনের বর্ণনায় এত আকর্ষণীয় কী হতে পারে?' মুনরো উত্তর দিয়েছিলেন, 'আপনাকে সেখানে থাকতে হবে'। আরেকটি বৈশিষ্ট্য হলো একজন সর্বজ্ঞ কথক যিনি বিশ্বকে বোঝাতে কাজ করেন। অনেকে মুনরোর ছোট-শহরের সেটিংসকে গ্রামীণ আমেরিকান দক্ষিণের লেখকদের সঙ্গে তুলনা করে। উইলিয়াম ফকনার এবং ফ্লানেরি ও'কনরের কাজের মতো মুনরোর চরিত্রগুলো প্রায়শই গভীর-মূল প্রথা এবং ঐতিহ্যের মুখোমুখি হয়। তবে তার চরিত্রগুলোর প্রতিক্রিয়াগুলো সাধারণত তাদের দক্ষিণী প্রতিপক্ষের তুলনায় কম তীব্র হয়। তার পুরুষ চরিত্রগুলো প্রত্যেকের সারমর্মকে করায়ত্ব করে, যখন তার মহিলা চরিত্রগুলো আরও জটিল হয়।

মুনরো তার লেখায় পাঠক, সমালোচকদের মধ্যে একটি সহানুভূতিশীল মিলন তৈরি করেন। আমরা তার লেখার সত্যতা দ্বারা আকৃষ্ট হই, যা অত্যন্ত জীবনঘনিষ্ঠ। অনেক সমালোচক লিখেছেন যে, মুনরোর গল্পগুলোতে প্রায়শই উপন্যাসের আবেগগত গভীরতা থাকে। মুনরো তার গল্পের বিভিন্ন সংস্করণ প্রকাশ করেছেন, কখনো কখনো অল্প সময়ের মধ্যে।

বিশ্বসাহিত্যের একজন অসাধারণ লেখক তিনি। তিনি একজন জীবনবাদী কথাসাহিত্যিক। মানুষের প্রতি তার যে ভালোবাসা, প্রকৃতির প্রতি যে তার গভীর টান, তা তার গল্পের মাধ্যমে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলেছেন। তার বর্ণনা ভঙ্গি অসাধারণ। তার বর্ণনাভঙ্গি ও ভাষাদক্ষতা পাঠককে এক মোহময় জগতে নিয়ে যায়। যিনি নির্জনে নিরন্তর এঁকেছেন সমকাল ও বাস্তবতার চিত্র। তার সাহিত্যে উঠে এসেছে মানুষের ভেতরের মানুষ, বাস্তবতার ভেতরের বাস্তবতা। তিনি তার কাজের মাধ্যমে সৃষ্টিশীলতা দিয়ে নিজেকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি সত্য ও সুন্দরের আরাধনা করেছেন সব সময় এবং তা ছড়িয়ে দিয়েছেন মানুষের মাঝে। তার প্রজ্ঞার দৃষ্টি এমনভাবে ছড়িয়ে দিয়েছেন যে, তা বিশ্বে আলো ফেলেছে। তিনি ছিলেন এক বিরল প্রতিভা।

আমরা যদি বিশ্বসাহিত্যের দিকে তাকাই, বিশেষ করে কথাসাহিত্যে, তা হলে অবাক হই এই ভেবে যে, যারা নোবেল বিজয়ী তাদের সাহিত্যে জীবনদর্শন, ভাষাশৈলী ও চরিত্রসৃজন এক অসামান্য ব্যঞ্জনায় সিক্ত- যা পাঠককে নিয়ে যায় ভিন্ন এক চিন্তার জগতে। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে, টমাস হার্ডির দ্যা মেয়র অব ক্যাস্টারব্রিজ, আই জ্যাক বাসিভিস সিঙ্গারের শোশা, গুস্তাভ ফ্লেয়বারের মাদাম বেভোরি, দস্তয়ভস্কির ক্রাইম অ্যান্ড পানিশম্যান্ট, টলস্টয়ের ওয়ার অ্যান্ড পিস ও আনাকারিনিনা, ম্যাক্সিম গোর্কির মা, গাও ঝিংজিয়াংয়ের সোল মাউন্টেন এবং গার্বিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের হানড্রেড ইয়ার্স অব সলিসু্যাড বা শত বছরের নিঃসঙ্গতা। এসব উপন্যাস পড়ার পর মনে প্রশ্ন জাগে আমরা কী লিখি আর তারা কী লিখেছেন। তাদের জীবনবোধের গভীরতা ও ভাষার গতিশীলতাই অন্যরকম। লেখালেখি যে একটি শ্রমসাধ্য কাজ, সাধনা, বিষয়টি মেধা-মননের তা আমরা বিশ্বখ্যাত এসব লেখকের লেখা পাঠ করলে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারি, এলিস মুনরো তাদের একজন।

তিনি তার জীবন ও কর্মের মধ্য দিয়ে নিজেকে এমন এক উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, যা বিশ্বের সচেতন পাঠক চিরদিন মনে রাখবে। তিনি আজ দূর আকাশে মিলিয়ে গেছেন। রেখে গেছেন তার অনন্য সাহিত্যসৃষ্টি। তার অসামান্য সৃষ্টিকর্ম যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে