শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

অজান্তে মেয়ে শিশুটির ক্ষতি করছেন না তো!

মাহমুদা আকতার
  ২৯ নভেম্বর ২০২১, ০০:০০

সন্তানের প্রশংসায় সব মা-ই খুশি হন, আনন্দ পান। ফুটফুটে সন্তানের মা হওয়ার গর্বে অনেকের বুক ফুলে যায়। কিন্তু এসব প্রশংসা করার সময় আমাদের আরও সাবধান হতে হবে। সন্তানের সামনে তাকে এমন কিছু বলবেন না- যা আপনার সন্তানটির ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। বিশেষ করে শিশুটি যদি হয় মেয়ে।

হরহামেশা অনেক মাকেই দেখি গদগদ হয়ে মেয়ের শারীরিক সৌন্দর্যের প্রশংসা করছেন। আর মেয়েটি যদি দেখতে মিষ্টি হয়- তাহলে তো আর কথাই নেই, আত্মীয়-পরিজনরাও শিশুটিকে প্রশংসার বন্যায় একেবারে ভাসিয়ে দেন। এটা তো আমাদের সমাজে প্রায়ই দেখা যায়, বাড়িতে কোনো বন্ধু বা আত্মীয় বেড়াতে এলে তারা ওই পরিবারের কিশোরী মেয়েটির সৌন্দর্য নিয়েই কথা বলবেন। কেউ বলবেন, ইস, আপনার মেয়েটা কী দারুণ দেখতে! কেউ বা বলবেন, আপনার মেয়ের চুলগুলো কী সিল্কি। কিংবা আপনার মেয়ের হাসিটা তো খুব মিষ্টি।

আপনি বা আপনার স্বজনরা এসব প্রশংসা অনেক সময় মেয়েটির সামনেই করে থাকেন। এমনকি এ নিয়ে সমবয়সি অন্যদের সঙ্গে তুলনা করতেও দ্বিধা করেন না তারা। কখনো কখনো এমনও হয়, ওই মেয়েটির বোন তার মতো দেখতে অতটা সুশ্রী না হলে, এ নিয়েও কথা বলেন ওই সব বেকুব লোকজন। হয়তো দুই বোনের সামনেই বলে বসবে- 'আপনার ছোট মেয়েটা তো আপনার মতোই সুন্দরী হয়েছে। কিন্তু বড় মেয়েটা তো দেখতে অত ভালো হয়নি। সে কি তবে আপনার স্বামীর মতো হয়েছে?'

কখনো কখনো ঠোঁটকাটা আত্মীয়কে এমনটাও বলতে শুনেছি- 'বিয়ে দেওয়ার সময় বড় মেয়েকে দেখতে এলে ছোট মেয়েকে কিন্তু পাত্র পক্ষের কাছে যেতে দেবেন না। তাহলে কিন্তু পাত্রপক্ষ বড়টাকে রেখে ছোট মেয়েকেই পছন্দ করে ফেলবে।' ভালো করে ভেবে দেখুন, এগুলো কিন্তু প্রশংসা নয়- এক ধরনের বিষাক্ত বাক্য। যা আপনার মেয়ে দু'টিকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তুলছে, গোটা সংসারে ছড়াচ্ছে বিষবাষ্প। আরও তলিয়ে দেখতে গেলে এগুলো হচ্ছে অতি সম্ভাবনাময় একটি জীবনকে অঙ্কুরে বিনষ্ট করার পাঁয়তারা।

অন্যদিকে এসব প্রশংসাবাণী মেয়ে শিশুদের করে তুলছে আরও নাজুক ও ভঙুর। কেননা, মেধা চর্চার বদলে অপেক্ষাকৃত দেখতে ভালো মেয়েটি রূপচর্চায় বেশি আগ্রহী হয়ে উঠে এবং দিনের সিংহভাগ সময় এ কাজেই ব্যয় করতে দেখা যায় তাকে। আর এর মাধ্যমে আরও বেশি করে অন্যের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা চালিয়ে যায় সে। এমনকি তার মধ্যে এক ধরনের মিথ্যা অহমিকা তৈরি হওয়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এসব বিষয়ে মনোযোগী হওয়ার কারণে তাদের মধ্যে কেউ কেউ পড়াশোনায় সাফল্যের ছাপ রাখতে ব্যর্থ হয়। অনেকে আবার সময়ের আগেই বিয়ের মতো পবিত্র কর্মটি (!) সম্পন্ন করে পরিবার গোছানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন তার পক্ষে আর নিজের ব্যক্তিগত সাফল্য অর্জনের বিষয়ে মনোযোগী হওয়ার আর সময় কোথায়? একটি পরিবারের কোনো মেয়ে এমনটি করলে শুধু সে-ই ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন নয়, ফলশ্রম্নতিতে পরিবারের অন্যকেও এর জের টানতে হয়।

এগুলো কেবল আমার কথা নয়, গবেষকরাও এমনটাই মনে করেন।

গবেষকরা বলছেন, ছোটো ছোটো মেয়েদের সৌন্দর্য নিয়ে আলোচনার ফলে নিজেদের শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে এক ধরনের সচেতনতা গড়ে ওঠে তাদের মধ্যে এবং সবকিছুর ঊর্ধ্বে তারা এ বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিতে শুরু করে। অথচ মেয়েটির মধ্যে আরো অনেক গুণাবলি (যেমন মেধা, বুদ্ধিমত্তা, উদারতা ইত্যাদি) ছিল- যা আস্তে আস্তে চাপা পড়ে যেতে থাকে। অথচ এসব গুণাবলির চর্চার মাধ্যমে লেখাপড়ায় ভালো ফলাফল, সমাজে নেতৃত্বদান, ভালো বক্তা; মোদ্দা কথা সুন্দর একটা ক্যারিয়ার গড়ার জন্য চেষ্টা করতে পারত সে। কিন্তু আপনার ভুল প্রশংসার কারণে সে রূপচর্চা বা পোশাক আশাকের মতো বিষয়গুলো নিয়ে বেশি ব্যস্ত হয়ে ওঠার কারণে ভেস্তে গেছে সেই সম্ভাবনা।

তাই প্রশংসা যদি করতে হয়, তবে আপনার মেয়ের মেধা বা বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করুন, শারীরিক সৌন্দর্য নয়। এতে আপনার মেয়ে তার মেধাসহ অন্যান্য গুণাবলির বিকাশ চর্চায় উৎসাহী হয়ে ওঠবে। যার ফলে এই বৈরী সমাজে নিজের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে আরো ভালোভাবে তৈরি হওয়ার সুযোগ পাবে মেয়েটি।

তাই নিজের অল্পবয়সি মেয়েটির সামনে তার অন্তর্গত সৌন্দর্যের প্রশংসা করুন। তাকে বলুন, 'আরে আমার মেয়ের তো অনেক গুণ। মা, তুমি এত সুন্দর ছবি আঁকতে পারো !' অন্যদের কাছেও মেয়ের এসব গুণাবলি তুলে ধরুন। হয়তো কেউ আপনাকে বললো, 'ভাবি, আপনার মেয়েটা তো দেখতে খুব সুন্দর।'

উত্তরে তাকে বলুন, 'আমার মেয়ের আরো অনেক গুণ। সে পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়। সুন্দর ছবি আঁকে। বই পড়তে ভালোবাসে।' এর ফলে আপনার মেয়ে তার ভেতরের গুণগুলো আরো চর্চার মাধ্যমে শানিত করে তুলবে- যা তাকে আত্মনির্ভর হতে সাহায্য করবে। পরবর্তী সময়ে নিজের জীবনের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের মতো যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে সে। মেয়েটি হয়ে ওঠবে আরো দায়িত্বশীল আরো নির্ভার।

আচ্ছা, আপনারা কি একটা বিষয় খেয়াল করেছেন, আমরা কিন্তু একটা ছেলে বাচ্চাকে বলি না, 'আমার ছেলেটা তো দেখতে দারুণ হ্যান্ডসাম!' তার বদলে আমরা ছেলেটার ভেতরের গুণাবলির প্রশংসা করি। বলি, আমার ছেলেটার হাতের লেখা সুন্দর। কিংবা আমার ছেলে তো ভালো ক্রিকেট খেলে, সে বড় হয়ে ক্রিকেটার হবে।

আপনার পরিচিতরাও কিন্তু একই কাজ করে। আপনার ছেলের প্রসঙ্গ উঠলে তারা কিন্তু তার লেখাপড়া বা অন্যান্য বিষয় নিয়েই কথা বলে। তাদের মধ্যে তার শারীরিক সৌন্দর্য নিয়ে তেমন আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় না। তাহলে মেয়েদের বেলায় এই পার্থক্য কেন হবে? কেন তার শারীরিক সৌন্দর্যের কথাই ফলাও করে বলবে সবাই।

আগেই বলেছি, এসব ঠুনকো প্রশংসা কেবল মেয়েদের সামাজিকভাবে আরো দুর্বল করে দেয়। ভেতরে ভেতরে ছোট্ট মেয়েটাকে আমরা কিন্তু আরো বেশি করে গুটিয়ে যেতে বা পরনির্ভরশীল হতেই উৎসাহ দেই। অথচ আমি, আপনি বা আমরা আমাদের মুখের ভাষার খানিকটা পরিবর্তন করলেই কিন্তু আগাগোড়া আত্মনির্ভরশীল হওয়ার উৎসাহ পাবে আমাদের মেয়েটি। পরিবারই পারে একটি মেয়েকে একজন আত্মনির্ভশীল ও দায়িত্ববান মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে। এ নিয়ে শৈশব থেকেই সচেতন হতে হবে মেয়ে শিশুটির বাবা-মাকে।

মাহমুদা আকতার: লেখক ও সাংবাদিক।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে