বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নারী তার মুক্তির পথ খুঁজে নিচ্ছে

সাবিরা ইসলাম
  ০৮ আগস্ট ২০২২, ০০:০০

আমাদের দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকের বেশি নারী। বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এবং বিশ্বব্যাপী নারীর সর্বাত্মক অংশগ্রহণ ও অবদান অনস্বীকার্য। অথচ এমন একটা সময় ছিল যখন পরিবারে কন্যাসন্তানের আগমনকে ভালো চোখে দেখা হতো না। 'আইয়ামে জাহেলিয়াত' এর যুগ অনেক আগে পেরিয়ে এলেও পরবর্তী দীর্ঘ সময় কন্যাসন্তানকে সংসার ও সমাজ জীবনের জন্য বোঝা মনে করা হতো। অবহেলা ও অবজ্ঞার দৃষ্টিতে বিচার করা হতো। বিংশ শতাব্দীতে এসেও যে এটা পুরোপুরি লোপ পেয়েছে তা বলা যাবে না। তবে, এসবের মধ্যেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের প্রতি পরিবার ও সমাজের নেতিবাচক ধারণা একটু একটু করে পাল্টাচ্ছে। নারীরাই তাদের ধ্যান, জ্ঞান ও কর্মপ্রতিভা দিয়ে ধারণা পাল্টাতে বাধ্য করছে। নদীতে বহু জল গড়িয়ে যাওয়ার পর আজ সংসারে, সমাজে, রাষ্ট্রে নারী তার যোগ্যতা ও দক্ষতা প্রমাণ করে নিজের গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে পারছে। এটি যে খুব সহজেই অর্জন করা সম্ভব হয়েছে তা নয়। নারীকে নিরন্তর পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের বহুমুখী বাধা অতিক্রম করে আজকের এই পর্যায়ে আসতে হয়েছে। লড়তে হয়েছে নিজের সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে, বিরূপ পরিবেশ ও প্রতিক্রিয়ার সঙ্গে। লড়তে হয়েছে বহু শাসন, বারণ আর নিয়ম শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে। রক্তচক্ষুর তীব্র চাহনির বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সাহস অর্জন করতে হয়েছে। বারবার তার স্বাধীন, সুন্দর, সুস্থ ও যৌক্তিক চিন্তার পথে কাঁটা বিছিয়ে গতিকে আটকে দেয়া হয়েছে। তবু নানা বাধা বিপত্তি অতিক্রম করে নারীরা এগিয়ে যাচ্ছেন। ঘর-গৃহস্থালি থেকে শুরু করে কৃষি, ইটভাটা, অফিস, আদালত, ব্যবসা- এমন কী রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে আজ নারী তার নিজ মহিমায় আসীন।

আমাদের প্রিয় এই দেশটি স্বাধীন হয়েছে আজ থেকে ৫০ বছর আগে। স্বাধীনতা সংগ্রামে এদেশের নারীর আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের ইতিহাস কারও অজানা নয়। একদিকে পাকিস্তানি বর্বরদের হিংস্র থাবায় নারীর সম্মান যেমন ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে তেমনি অন্যদিকে পুরুষ সহযোদ্ধাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রণাঙ্গনে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে লড়েছে তারামন বিবির মতো অগণিত নারী। ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণি নির্বিশেষে সবার সমান অংশগ্রহণ ও আত্মত্যাগেই একটি স্বাধীন দেশে বাস করার সুযোগ হয়েছে। অথচ, অনেক ক্ষেত্রেই নারীর যোগ্যতাকে যথাযথ স্বীকৃতি দেয়া হয় না।

নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের প্রশ্ন এলেই এক শ্রেণির জ্ঞানপাপীরা বলার চেষ্টা করেন যে, নারী-পুরুষের সমান অধিকার কী করে সম্ভব হবে? যে গুরুভার পুরুষ নিতে পারে, তা কি নারীর পক্ষে নেয়া সম্ভব? তারা বোঝানোর চেষ্টা করে প্রকৃতিগতভাবেই নারী পুরুষের চেয়ে শারীরিকভাবে দুর্বল। তাছাড়া পুরুষ ও নারীর শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণে পুরুষ যা পারে তার সবকিছুই নারীর পক্ষে পেরে ওঠা সম্ভব নয়। তারা কিছুতেই বোঝার চেষ্টা করে না যে, সমান অধিকার মানেই নারীকে পুরুষের সমান ওজনের বোঝা মাথায় নিয়ে পুরুষের সমান যোগ্য প্রমাণ করার ব্যাপার নয়। সমান অধিকার মানে পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে পুরুষ যেসব সুযোগ ও সুবিধাগুলো সহজেই ভোগ করতে পারে, সেইগুলো নারীর ক্ষেত্রেও যেন বাধাহীন না হয়। কোনো বাধা বিপত্তি এসে নারীর ন্যায্য অধিকার ভোগে যেন কোনো অরাজকতা সৃষ্টি না করে। নারীকে যেন মানুষ হিসেবে গণ্য করা হয়। তা ভিন্ন শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণে নারী যেন অবজ্ঞা, অবহেলার শিকার না হয়। নারীকে পণ্য হিসেবে গণ্য করে তার স্বাভাবিক জীবনযাপনকে যেন ব্যাহত করা না হয়। পরিবারে ও সমাজে পুরুষের মতো নারীও যেন একজন মানুষের মর্যাদা পায়।

কিন্তু কিছু নিচু মানসিকতার পুরুষ ও ধর্মান্ধ ব্যক্তি ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে নারীর ন্যায্য প্রাপ্তি এবং সার্বিক উন্নয়নের পথে যুগে যুগে বাধা সৃষ্টির পাঁয়তারায় লিপ্ত থেকেছে, এখনো তারা লিপ্ত রয়েছে। নারীকে ক্রমাগত আর্থিক, মানসিক ও শারীরিকভাবে ঠকিয়েই তাদের যত আত্মতৃপ্তি। এর ব্যত্যয় ঘটলেই নারী তাদের দৃষ্টিতে অগ্রহণযোগ্য কোনো কীট হয়ে দেখা দেয়। নারী কলঙ্কিত হয়ে পড়ে।

স্বাধীনতার আগে কিংবা পরে নারীকে তার চলার পথের কাঁটা একটু একটু করে সরিয়েই গন্তব্যের দিকে এগিয়ে যেতে হয়েছে। কেউ তাদের চলার পথকে কণ্টকমুক্ত করে দেয়নি। নারীর অগ্রযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে বেগম রোকেয়ার পর বেগম সুফিয়া কামাল ও বেগম পত্রিকার সম্পাদক নুরজাহান বেগমের ভূমিকা অপরিসীম। তাদের অদম্য কর্মস্পৃহা ও সত্য ন্যায়ের পথে সব বাধা বিপত্তিকে অগ্রাহ্য করে সামনে এগিয়ে চলার মানসিক দৃঢ়তা আমাদের দেশের নারী সমাজকে সাহস জুগিয়েছে, অনুপ্রাণিত করেছে। নারীর নিজ অধিকার সম্বন্ধে সচেতন করেছে। স্বাধীনতা-উত্তর নারী জাগরণে এই দুই মহীয়সী নারীর অবদান অপরিসীম।

তবে, স্বাধীনতার ৫০ বছর পর নারীর সার্বিক উন্নয়নে উলেস্নখযোগ্য সাফল্য লক্ষ করা যায়। পদে পদে বাধাগ্রস্ত হয়েও পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রের সর্বত্র নারীর সমান অংশগ্রহণ ও পদচারণা। এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে নারী তার মেধা ও যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখেনি। শিক্ষিত, অশিক্ষিত কিংবা স্বল্প শিক্ষিত প্রতিটি নারী নিজ নিজ যোগ্যতানুসারে দেশের অগ্রগতিতে তার অসামান্য অবদান রেখে যাচ্ছে। ইটভাটা কিংবা কৃষি মাঠে নারী যেমন তার শ্রম দিতে পিছিয়ে নেই, তেমনি পিছিয়ে নেই আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর কর্মক্ষেত্রেও। বর্তমানে ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় নারীর ব্যাপক অংশগ্রহণ প্রমাণ করে যে, পুরুষের চেয়ে নারী কোনো ক্ষেত্রেই এতটুকু পিছিয়ে নেই। নারীকে অবহেলা, অবজ্ঞা করার আর কোনো সুযোগ নেই।

বর্তমানে বহির্বিশ্বে আমাদের দেশের পোশাকের বিশাল বাজার তৈরি হয়েছে এবং এই শিল্পের মাধ্যমে সরকার বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারছে। এ অর্জনের পেছনে এদেশের অসংখ্য দরিদ্র, অবহেলিত ও বঞ্চিত নারীর অক্লান্ত পরিশ্রম ও একাগ্রতার অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করা যাবে না।

মেধা বিচারেও পুরুষের চেয়ে নারী অনেক এগিয়ে আছে। গত কয়েক বছরের এসএসসি ও এইচএসসির ফলাফলগুলোর দিকে লক্ষ করলেই সহজে এর প্রমাণ পাওয়া যায়। এই অগ্রগতি শুধু শহরকেন্দ্রিক নয়। মফস্বল ও প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলের দারিদ্র্যপীড়িত ও নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত নারী তার অসীম ধৈর্য ও সহনশীলতা দিয়ে শিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের যোগ্যতার পরিচয় দিচ্ছে। এ জন্য তারা প্রশংসিতও হচ্ছে। নারীর এই স্বীকৃতি নারীকে তার অগ্রগতির পথে একটু একটু করে এগিয়ে দিচ্ছে। তিন দশক ধরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষে রয়েছে নারী। রাষ্ট্র পরিচালনার মতো কঠিন দায়িত্ব পালনেও নারী কোনোভাবেই পিছিয়ে নেই। বর্তমানে আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, স্পিকার নারী।

মন্ত্রী-সচিবসহ সরকারের আরও গুরুত্বপূর্ণ পদে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছে নারী। রাজনীতির মাঠে যে কোনো দাবি আদায় ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নারীর উলেস্নখযোগ্য অংশগ্রহণ এখন আর নতুন কিছু নয়। জেল, জুলুম, নিপীড়ন, অত্যাচারের ভয়ভীতিকে উপেক্ষা করে বিভিন্ন মিটিং মিছিলের অগ্রভাগে থেকে রাজপথ উত্তাল করে তুলতে নারী এখন পুরুষের চেয়ে কম পারদর্শী নয়। বরং কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়েও সাহসী ভূমিকা নিতে দেখা যায়।

বর্তমানে চরম প্রতিযোগিতার যুগে ব্যাংক, বীমা, সরকারি, বেসরকারি অফিসে পুরুষের সঙ্গে সমান পালস্না দিয়ে জায়গা করে নিচ্ছে নারী আর অত্যন্ত আন্তরিকতা, সততা ও বিশ্বস্ততার প্রতীক হয়ে উঠছে। কর্মক্ষেত্রে কাজের প্রতি নারীর আগ্রহ, সততা ও দায়িত্বশীলতা তাদের আরও বেশি গ্রহণযোগ্য করে তুলছে। বর্তমান সময়ে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্টিং মিডিয়ার দিকে তাকালেও একই চিত্র দেখা যায়। ক্যামেরার সামনে ও পেছনে নারী তার মেধার সর্বোচ্চ ঢেলে দিচ্ছে। খবরের খোঁজে কিংবা জনগণকে বিভিন্ন বিষয়ে জরুরি তথ্য উপাত্ত ও বিনোদন দিতে দেশ-বিদেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত ছুটে উপকরণ সংগ্রহ করে আনতে পিছিয়ে নেই তারা। তাদের এই স্বতঃস্ফূর্ত ও জড়তাহীন অংশগ্রহণ মিডিয়া জগৎ দিন দিন সমৃদ্ধ হচ্ছে।

দেশে এখন প্রতিদিন শতাধিক দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক ও মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। এসব পত্রিকায় রিপোর্টিংসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিভাগে কাজ করছে অসংখ্য নারী। এমন কি দেশের প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্বেও রয়েছেন নারী। সাহিত্য সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও নারী যোগ্যতার সঙ্গে তাদের বিচরণের জায়গা করে নিয়েছে। বর্তমান আধুনিক সময়ের বিশাল সুযোগ ও সম্ভাবনার কোনো ক্ষেত্রেই নারী পিছিয়ে নেই। স্বাধীনতার ৫০ বছরে সমাজে, সংসারে নিরন্তর দারুণ অবজ্ঞা, অবহেলা সয়েও এমনি করে প্রতিটি ক্ষেত্রে নারী নিজ মেধা ও যোগ্যতায় নিজের জন্য শক্ত অবস্থান তৈরি করে নিয়েছে।

পরিশেষে বলা যায়, নারীর অগ্রযাত্রাকে বাধাগ্রস্ত করতে অতীতে কম চেষ্টা হয়নি, এখনো যে, কম হচ্ছে তেমনটিও নয়। আবার আগামীতেও তা একেবারে লোপ পাবে এমনটি ভাবা যায় না। তবে, এসব বাধা বিপত্তির পাহাড় ভেদ করে নারী তার মুক্তির পথ খুঁজে নিচ্ছে এটাই আশাব্যঞ্জক। নারী যত নিজের সম্মান ও পরিবারে, সমাজে তার প্রয়োজনীয়তা প্রমাণ করতে পারবে, তাদের অগ্রযাত্রা ও সার্বিক উন্নয়ন তত বেশি বেগবান হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে