শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মায়ের অবাধ্য যখন সন্তান

ম আফসানা তুলি
  ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

সন্তান অবাধ্য এই অভিযোগ অনেক মা করে থাকেন। অবাধ্য ছেলে বা মেয়ের দৌরাত্ম্য নিয়ে আত্মীয় বা বন্ধু মহলে আলোচনাও কম হয় না। কিন্তু ভেবে দেখেছেন, কেন কথা শোনে না আপনার সন্তান? কথা না শোনার কারণ কি? না কি সেখানে কোনো ফাঁক থেকে যাচ্ছে আপনার তরফ থেকে। আসুন জেনে নেই সন্তান কথা না শুনলে কী করবেন। নির্দেশের ভঙ্গিতে কথা বললে তা শিশুর পক্ষে বোঝা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। বরং তাকে খেলার ছলে নির্দেশ দিন। সংক্ষেপে বলুন আর শিশুর বয়স অনুপাতে শব্দ প্রয়োগ করুন। মনোবিদদের মতে, বেশির ভাগ শিশুই বুঝতে পারে না ঠিক কী করলে সে বকুনি খাবে না, এই টেনশন থেকেই সে কথা শোনার প্রবৃত্তি হারায়।

সন্তান যখন কথা বলে, কিছু বোঝাতে চায়, তখন তার কথার গুরুত্ব দেন কি? না কি সে সব পাত্তা না দিয়ে কেবল নিজের চাহিদা ও তার ভুল-ত্রম্নটি নিয়েই ধমক দিতে থাকেন? তা হলে আজ থেকেই এই অভ্যাস বদলান। সন্তান অন্যায় করলেও তাকে তার স্বপক্ষের যুক্তিগুলো বলতে দিন। তা হলে সন্তানকে ঠিক পথে আনতে পারবেন।

সন্তান যখন তার বন্ধু বা স্কুলের গল্প বলে, বা আপনার সঙ্গে খেলতে চায় তখন তা আমল দেন? অনেক সময়ই দেখা যায়, সন্তান কথা বললে যে সব অভিভাবক পাত্তা দেন না, তাদের সন্তানদের মধ্যে এ নিয়ে চাপা অসন্তোষ তৈরি হয়। অবচেতনে সেই ক্ষোভ বুঝতে পারে না সন্তানও। কিন্তু তার প্রভাব তৈরি হয় আচরণে।

অনেক সন্তান আছে, যারা ইচ্ছাকৃতই মায়ের অবাধ্য হয়। খুব ছোটবেলাতেই এমন স্বভাবের হদিস পেলে তাকে প্রথমেই শাসন করে আরও একগুঁয়ে করে তুলবেন না। তার চেয়ে তার এই অভ্যাস বদলাতে বেড়ে ওঠায় কিছু নিয়মশৃঙ্খলা আনুন। সারাক্ষণ সন্তানের সমালোচনাই করে যান? অন্যের সঙ্গে তুলনা করে তাকে খাটো করেন? এতে সন্তান বাবা-মায়ের প্রতি শ্রদ্ধা হারায়। এমন স্বভাব নিজের থাকলে আগে তা বদলান। সন্তান যেন কখনো আপনার কাছে তার নিজের মূল্য নিয়ে সংশয়ে না থাকে। সামান্য অবাধ্য হলেই কি তাকে কড়া শাসন করে ফেলেন? এমন হলে নিজেকে একটু নিয়ন্ত্রণ করুন। সন্তানের হিতে যে কাজটা করছেন, তা যেন তার মনে উল্টো প্রভাব ফেলে আপনাকেই তার দূরের মানুষ করে না তোলে। তার চেয়ে ছোটখাটো ভুল করলে একটু বন্ধুর মতো বোঝান না, দেখবেন, ফল মিলছে হাতেনাতে।

আমাদের সমাজে মা প্রত্যেক সন্তানের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সন্তানের জন্য মা সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেন। সন্তানের চেহারা দেখা মাত্র উপলব্ধি করতে পারেন তার চাওয়া-পাওয়া, দুঃখ-কষ্টের কথা। সর্বক্ষেত্রে নিজেকে বিপদের মধ্যে রেখেও সন্তানের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করেন। সন্তানের স্বাস্থ্য ও সুস্থতার সার্বিক বিষয়ে নিবেদিত প্রাণ ও যত্নশীল মা-বাবা। সন্তানের সব দুঃখ-কষ্ট দূরকরণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখেন মা-বাবার। আর প্রত্যেক সন্তানের কাছে তার মা-বাবাই হচ্ছে শ্রেষ্ট সম্পদ। মা-বাবার দোয়া ও আশীর্বাদে জীবনে চলার পথে সব সাফলতা পান সন্তান। তারা সন্তানের জন্য এতটাই নিঃস্বার্থ যে সবকিছুর ওপর সন্তানের জন্য ভালো কিছু কামনা করেন। বর্তমান সময়ে খুব ছোট বয়স থেকেই অনেক সন্তান মা-বাবার অবাধ্য হয়ে পড়েন।

মাকে সন্তানকে অবাধ্য থেকে রক্ষা করতে কী করা উচিত। তার মধ্যে হচ্ছে- বাবা যখন সন্তানকে শাসন করবে, মায়েদের সেই সময় নীরব থাকা উচিত। বাবা বকা দেওয়ার সময় মা যদি বলে ওঠে, এতটুকু বাচ্চাকে বকাবকি করছো কেন? কিংবা যথেষ্ট হয়েছে আর না। মনে রাখবেন, বাবার প্রতি সন্তানের ভয় আপনি ভেঙে দিলেন। মায়েরা চুপ থাকলে, সন্তান ভেবে নিতো বাবার বকা খাওয়া যাবে না। কারণ বাবা রেগে গেলে তাকে শাসন করবে। কেউ ঠেকাতে আসবে না। বাবা-মা একসঙ্গে কখনো সন্তানকে শাসন করবেন না। একজন বকাবকি করলে, অন্যজন চুপ থাকবেন। এতে করে সন্তান নিজেকে অসহায় মনে করবে না। আবার প্রশ্রয়ও পাবে না। সন্তানের সামনে বাবা-মা কখনো ঝগড়া করবেন না। এতে করে সন্তান নিজেকে একা মনে করে। নিজের একাকিত্ব দূর করার জন্য সন্তান বিভিন্ন সঙ্গ দোষে জড়িয়ে পড়ে। আর বর্তমান সময়ে সঙ্গ দোষের প্রভাব এতটাই মারাত্মক, এখান থেকে বের হয়ে আসা প্রায় অসম্ভব। কারণ আগে সঙ্গ দোষে কেউ কেউ সিগারেট খেত কিংবা পড়া ফাঁকি দিয়ে জোট বেঁধে সিনেমা হলে যেত। আর এখন সঙ্গ দোষের কারণে সন্তান মাদকসেবী হচ্ছে, বিভিন্ন অনৈতিক কাজ করছে। সন্তানের সামনে মায়েরা বাবাদের সঙ্গে তর্ক করবেন না। এর ফলে সন্তান বাবাকে আর ভয় করে না। আর বাবাকে ভয় না করলে, মা'কেও ভয় করবে না। এই সাধারণ বিষয়টি আমাদের অনেক মায়েরাই বোঝে না।

মায়েরা চাকরি করে। তবে সন্তান যখন কোনো কিছু আবদার করবে, তখন অবশ্যই ভালো খারাপের বিবেচনা করতে হবে। যদি খারাপের আধিক্য থাকে, তাকে বোঝাতে হবে যে বাবার অনুমতি লাগবে। একই সঙ্গে এতে করে সে ছোট বয়সেই পারিবারিক চেইন অব কমান্ডের একটা শিক্ষা পেয়ে যাবে। সন্তানকে লেখাপড়ার গুরুত্ব সম্পর্কে বোঝান। ভালোভাবে লেখাপড়া করলে জীবনে কি কি করা সম্ভব, তার একটা রূপরেখা তার মনের মধ্যে গেঁথে দিন। আপনার সন্তান নিজের মতো করেই নিজের চলার পথ তৈরি করে নেবে। আপনাকে বেশি কিছু বলে দিতে হবে না। আপনার অর্থ-বিত্ত আছে। এর মানে এই নয় যে, সন্তান যা চাইবে, কোনো কিছু বিবেচনা না করেই তাকে কিনে দিতে হবে। প্রতিদিন বাড়িতে আসার সময় বাচ্চার জন্য একই জিনিস কিনে আনছেন। প্রয়োজন নেই, তবু আনছেন। সন্তানেরও নিত্য নতুন বায়না শুরু হচ্ছে। বাবা-মা কিনে দিচ্ছে। মায়েরা চাকরি করলে কোনো কথাই নেই। আর যদি মায়েরা চাকরি না করেন, তবে মায়েরা বাবাদের ফোন করে মনে করিয়ে দিচ্ছেন তাদের সন্তানদের নিত্য নতুন বায়নার কথা। কিন্তু অহেতুক উপহারের মাধ্যমে ভালোবাসা প্রকাশ পায় না। এতে করে আপনি আপনার সন্তানদের লোভী করে তুলছেন। সন্তানের বেডরুম বাবা-মায়ের রুমের পাশেই রাখতে হবে। ব্যতিক্রম কিছু কারণ ছাড়া সন্তান যেন রুমের দরজা না লাগিয়ে রাখে, সেদিকে কড়াকড়িভাবে খেয়াল রাখতে হবে। একবার যদি এই বদঅভ্যাস তৈরি করে ফেলে, তবে পরবর্তী সময়ে মেরে পরিবর্তন করতে পারবেন না। পরিবারে চেইন অব কমান্ড অত্যন্ত জরুরি। যে যার মতো চলবে, সেটা পরিবারের ঐতিহ্য হতে পারে না। পরিবারের বড় সন্তান যদি বাবা-মায়ের কথা না শোনে, তবে তার প্রভাব পরবর্তী সন্তানদের ওপরও পড়ে। পরিবারে অবশ্যই জবাবদিহিতা থাকতে হবে। বাবা-মা তাদের সন্তানদের অবশ্যই স্নেহ করবে। তবে অতিরিক্ত আদর স্নেহ সন্তানকে পরনির্ভরশীল ও আত্মশক্তিহীন করে তোলে, যা মনুষ্যত্ব বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। তাই অতিরিক্ত স্নেহ ভালোবাসা যেন সন্তানের অমঙ্গলের কারণ হয়ে না দাঁড়ায়, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে হবে। সন্তান ছোট থাকতেই খেয়াল রাখুন কার সঙ্গে সে চলাফেরা করে। একবার সঙ্গদোষে জড়িয়ে পড়লে, তাকে ফেরাতে পারবেন না। বাবা-মায়ের উচিত সন্তানদের ভালো খারাপের পার্থক্য বুঝিয়ে দেওয়া। সন্তানকে যথেষ্ট সময় দেওয়া। আমাদের মায়েরা চাকরি করে। হাতে টাকা আছে। সন্তান যদি এক বেলা না খেয়ে আইফোন কিনে দেওয়ার জেদ ধরে, মায়েরা কিনে দিচ্ছে। এতে করে কি সন্তানের মঙ্গল হচ্ছে? আসলে অমঙ্গল ডেকে আনা হচ্ছে। এরপর মোবাইলের মডেল পরিবর্তনের বায়না ধরবে। অনেকেই বাচ্চাকে ঠান্ডা রাখার জন্য টেলিভিশনের সামনে বসিয়ে রাখেন। এত করে আপনার সন্তান সাময়িক সময়ের জন্য ঠান্ডা থাকছে। কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে এর ফল অতিশয় খারাপ। কারণ খুব ছোট বয়সে টেলিভিশনের প্রভাব তার ওপরে পড়ে যায়। আপনার সন্তান মাদকসেবী। আপনার দিন রাতের ঘুম হারাম। অথচ একদিনে আপনার সন্তান এই বিপথে পা বাড়ায়নি। যখন দিনের পর দিন বাইরে থেকেছে, তখন তার কোনো খোঁজ নেননি। যখন আসক্তির শেষ পর্যায়ে, তখন আপনার টনক নড়েছে। আমরা সন্তানদের ছোট থাকতে নৈতিকতার শিক্ষা দেই না। ভালো আর খারাপের পার্থক্য বোঝাই না। বেশি ভালোবাসা দেখাতে যেয়ে সন্তানের সর্বনাশ ডেকে আনছি। সন্তানকে নিজের পায়ে দাঁড়াতে সহায়তা করুন। এখন অনেক ধনী পরিবারের স্কুলের ছেলেরা বিভিন্ন গ্যাং তৈরি করছে। পরিবারের মধ্যে খেয়াল করারও কেউ নেই। ছেলেরা বিভিন্ন আজব স্টাইলে চুল কাটছেন, পরিবারের কেউ কিছু বলছে না। স্কুলের শিক্ষার্থী, রাত ১০টার পরে বাসায় ফিরছে, বলার কেউ নেই। বাবা কিছু বললে, মা রেগে সন্তানের পক্ষ নিচ্ছে কিংবা মা কিছু বললে, বাবা সন্তানের পক্ষে চলে যাচ্ছে। সন্তান প্রশ্রয় পাচ্ছে। বাবা-মা যদি সন্তানকে প্রথম থেকেই বুঝিয়ে দিতেন, এভাবে চুল কাটা যাবে না কিংবা এভাবে রাত করে ঘরে ফেরা যাবে না। তাহলে সন্তান বুঝে যেত, এটা তার ভুল হয়েছে। ছোট ছোট ভুল যদি সংশোধন করে না দেন, তবে পরবর্তী সময়ে বড় ধরনের অন্যায় সংশোধন করার মতো ক্ষমতা আপনার হাতে আর থাকবে না। সন্তান অবাধ্য হবেই। এখন সমাধান আপনার হাতে। কীভাবে সন্তান মানুষ করবেন। তবে পরিবারে আদেশ-নির্দেশ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটি প্রতিটা পরিবারে থাকা উচিত। বাবা-মা দুজনের হাতে টাকা থাকা মানেই যা খুশি তা করা ঠিক নয়। এর ফলাফল আর যাই হোক, ভালো হয় না। সর্বোপরি প্রত্যেক মা-বাবা সন্তানের জন্য যা চিন্তা করেন

ভালো চিন্তা করেন এবং প্রত্যেক সন্তানকে মনে

রাখতে হবে আমিও একদিন মা ও বাবা হবো।

আমাকেও সেই সাধ গ্রহণ করতে হবে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে