শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নারীর গস্নানিময় অধ্যায়

বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার মূলে রয়েছে মনস্তত্ত্ব্ব, পিতৃতন্ত্র ও বৈষম্যমূলক আইন। ইতিহাস, দর্শন, শিক্ষা কারিকুলাম নারীর প্রতিকূলে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নও নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। রাষ্ট্র আপসহীন না হলে এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' নীতি গ্রহণ না করলে সমাজের ভেতরে এই অবক্ষয় রুখে দাঁড়ানো যাবে না। পরিবারের দায়িত্ব নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা
ম তানজিনা হোসেন
  ১২ সেপ্টেম্বর ২০২২, ০০:০০

যৌন নিগ্রহ বা নির্যাতন নারীদের জীবনে প্রাত্যহিক ঘটনা, অহরহ ঘটছে। দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ নারীর প্রতি যৌন নিগ্রহের চরম দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। রামচন্দ্র সীতার জন্য ভয়ানক যুদ্ধ বাধিয়ে দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু যুদ্ধজয়ের পর সীতার চরিত্র হয়ে দাঁড়াল প্রশ্নের সম্মুখীন। পুরো ঘটনার জন্য সীতা যদিও এতটুকুও দায়ী নন, কিন্তু সমাজ, এমনকি রামও গ্রহণ করলেন না তাকে। আঙুল তোলা হলো নারীর দিকেই। এই প্রবৃত্তি সমাজে এখনো সমানভাবে বিরাজমান। এবার আধুনিক বাংলা সাহিত্যের গোড়ার দিকে তাকানো যাক। সুবিশাল রবীন্দ্র-সাহিত্যে নারীর বঞ্চনা, ক্ষোভ, অপমান, বেদনা আর উপেক্ষার কথা এসেছে যথেষ্ট আন্তরিকতার সঙ্গে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আগে নারীর হৃদয়ের এত বিচিত্র অনুভব এবং তার জটিল মনস্তত্ত্ব আর কেউ উপস্থাপন করেননি। শরৎচন্দ্রের নায়িকার কষ্টে পাঠক কেঁদে বুক ভাসালেও তাদের জীবনের গস্নানিময় ক্লেদাক্ত ইতিহাস পাঠকের জানা হয়নি। তবে এ বিষয়টা চোখ এড়ায়নি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। 'সরসী বলিতে পারে না। অনেক চেষ্টায় একটু আভাস দিল। বাকিটুকু মা জেরা করিয়া জানিয়া নিলেন। জানিয়া মাথায় যেন বাজ পড়িল। রাগের মাথায় মেয়ের পিঠে গুম গুম করিয়া কয়েকটা কিল বসাইয়া দিলেন। বলিলেন, সেইকালে বারণ করেছিলাম সারা দুপুর টো টো করে ঘুরে বেড়াসনে সরি, বেড়াসনে। হলো তো এবার? মুখে চুনকালি না দিয়ে ছাড়বি, তুই কি সেই মেয়ে! সরসী খুব কাঁদিল। তার কোনো অপরাধই নেই, সুবলদার মতলব বুঝিতে পারা মাত্র তার হাতে কামড়াইয়া দিয়া পলাইয়া আসিয়াছে সে। তবু তাকেই মার খাইতে হইল।'

এরই মধ্যে শহীদুলস্না কায়সারের সংশপ্তক সৈয়দ শামসুল হকের খেলারাম খেলে যা কিংবা শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন-এর মতো বিখ্যাত ও বহুলপঠিত উপন্যাসে নারীর প্রতি যৌন নির্যাতনের বিষয়টি খোলামেলাভাবেই উঠে এসেছে। এই যৌন নিগ্রহের বিষয় আখতারুজ্জামান ইলিয়াসও ফুটিয়ে তুলেছেন গল্পে।

নারী লেখকদের মধ্যে তসলিমা নাসরিনই প্রথম বেশ সবিস্তারে নিজের শৈশবের অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন: 'মজার জিনিসটা এইবার তরে দেখাই বলে একটানে আমাকে চৌকির ওপর শুইয়ে দেন মামা। আমার পরনে একটি কুচিওলা রঙিন হাফপ্যান্ট শুধু। শরাফ মামা সেটিকে টেনে নিচে নামিয়ে দেন। আমি তাজ্জব। হাফপ্যান্ট দুহাতে ওপরে টেনে বলি, কী মজার জিনিস দেখাইবা, দেখাও। আমারে ল্যাংটা কর ক্যা?' নারীর প্রতি যৌন সহিংসতার বয়ান পেয়েছি রিজিয়া রহমানের উপন্যাসে। তার বিখ্যাত উপন্যাস রক্তের অক্ষর পতিতাদের নিয়ে লেখা। এটি ছাড়া তার আরও বিভিন্ন উপন্যাসে স্থান পেয়েছে। নারীর লেখা উপন্যাসে তুলে ধরা হয়েছে যৌন নিগ্রহ। নারী লেখকরা নানাভাবে ও মাত্রায় নারীর প্রতি যৌন অসদাচরণ ও সহিংসতার বিষয়টি সামনে এনেছেন।

সাহিত্য ছাড়াও বাস্তব জীবনে নারীর গস্নানিময় অধ্যায় এর যেন শেষ নেই। পুরুষ সুযোগ পেলেই নারীকে অবমাননা করে। পান থেকে চুন খসলেই আমরা নারীকে অপবাদ দিই। কথায় কথায় নারীকে কুলটা চরিত্রহীন ও ব্যভিচারী বলে আখ্যা দিই। নারীর দোষের অন্ত নেই। নারীও যে মানুষ এটা তারা মুহূর্তে ভুলে যায়। অন্যদিকে, পুরুষরা শত অপরাধ করলেও তাদের চরিত্রে কোনো ধরনের কালিমা লিপ্ত হয় না। ভাবটা এমন যে পুরুষের 'চরিত্র' বলে কিছু নেই। এটা হচ্ছে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিগত জটিল সমস্যা। এই সমস্যা নারীর নয়, কেবলই পুরুষের। এটা যতদিন থাকবে ততদিন নারীর মুক্তি নেই, নারী স্বাধীনতার কথা বলে আমরা মুখে যতই ফেনা তুলি না কেন।

বাংলাদেশে নারীর প্রতি সহিংসতার মূলে রয়েছে মনস্তত্ত্ব্ব, পিতৃতন্ত্র ও বৈষম্যমূলক আইন। ইতিহাস, দর্শন, শিক্ষা কারিকুলাম নারীর প্রতিকূলে। রাজনীতির দুর্বৃত্তায়নও নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলছে। রাষ্ট্র আপসহীন না হলে এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' নীতি গ্রহণ না করলে সমাজের ভেতরে এই অবক্ষয় রুখে দাঁড়ানো যাবে না। পরিবারের দায়িত্ব নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে