রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

নারীকে কেন দায়ী করা হয়?

আমার কাছে অ্যাডজাস্টম্যান্ট মানে হেরে যাওয়া নয়, আমার কাছে অ্যাডজাস্টম্যাট মানে হলো সুন্দর করে বাঁচা। এই এডজাস্টম্যান্ট, কম্প্রোমাইজ শব্দগুলো কেন নারী শব্দের সমার্থক হয়ে উঠছে? নারীকেই কেন অ্যাডজাস্ট করে চলতে হবে? যুগের পর যুগ ধরে নারীকেই কেন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে নামতে হয়, সেই যুদ্ধে হেরে গেলে সারা জীবন ডিভোর্সি ট্যাগ নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়?
নতুনধারা
  ২২ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

আফসানা সাথী

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ট্রেন্ডিং বা আলোচিত একটি বিষয় হলো, নারী কীসে আটকায়। হঠাৎ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কেন ঘুরে বেড়াচ্ছে এমন অদ্ভুত বাক্য? এ কথার মধ্য দিয়ে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজ কী প্রকাশ করতে চাইছে? ঘটনার সূত্রপাত হয় কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রম্নডো ও তার স্ত্রী সোভি গ্রেগয়ের ট্রম্নডোর আলাদা থাকার ঘোষণার পর।

দীর্ঘ ১৮ বছরের দাম্পত্যের পর তিন সন্তানের এই পিতামাতা বৈবাহিক সম্পর্ক ছিন্ন না করে আলাদা থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। এর জের হিসেবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বইতে শুরু করে মিম, ট্রল আর পোস্ট-পাল্টা পোস্টের ঝড়। এর মধ্যে একটি পোস্ট সবচেয়ে বেশি আলোচনায় এসেছে সেটি ছিল এমন- 'জাস্টিন ট্রম্নডোর ক্ষমতা, বিল গেটসের টাকা, হাকিমির জনপ্রিয়তা, হুমায়ুন ফরিদীর ভালোবাসা, তাহসানের কণ্ঠ কিংবা হৃত্বিক রোশানের স্মার্টনেস। কোনো কিছুই নারীকে আটকাতে পারেনি, বলতে পারবেন নারী কীসে আটকায়?' এই ফেসবুক পোস্টে যেসব পুরুষের নাম নেওয়া হয়েছে তারা সবাই-ই স্বনামধন্য এবং আলোচিত। পারস্পরিক বোঝাপড়ার ভিত্তিতেই তারা সঙ্গীর থেকে আলাদা হয়েছেন বা বিচ্ছেদের পথ বেছে নিয়েছেন। কোনো সম্পর্কের বিচ্ছেদের পেছনে হয়তো নারী সঙ্গীর ভূমিকা একটু বেশি অথবা কোনটিতে হয়তো পুরুষের ভূমিকা বেশি। তবে কেন কেবল নারীর প্রতি উঠল 'আটকে না থাকা' বা হাল ছেড়ে দেওয়ার অভিযোগ! আর এ অভিযোগের মাধ্যমেই দেওয়া হলো এমন পরোক্ষ ইঙ্গিত, যে কোনো একটা কিছুর বিনিময়েই নারী সব সময় সম্পর্কে থাকেন এবং সংসার টিকিয়ে রাখতে নারীকে কিছু একটা দিয়েই আটকে রাখতে হয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সব সময় টাকা পয়সা, অর্থ বিত্ত বা সুনাম দিয়েই নারীকে আটকে রাখতে চেয়েছেন অথচ নারীর রক্ত মাংসের শরীরের ভেতরে যে একটা মন আছে এটা তারা কখনোই অনুভব করেননি।

বিল গেটসের অর্থ আছে তাই সে অন্য নারীর প্রতি আসক্ত জেনেও তার স্ত্রী তার সঙ্গে থেকে গেলে সে হতো পুরুষের দৃষ্টিতে পৃথিবীর সেরা স্ত্রী এবং তখন কিছু লোক এটা বলতেও ছাড়তো না যে স্বামীর বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের কথা জেনেও শুধু টাকার জন্য বিচ্ছেদের পথে হাঁটছেন না বিল গেটস পত্নী।

কই কখনো তো আমরা এই ট্রেন্ডে গা ভাসাই না পুরুষ কীসে আটকায়?

ওপার বাংলার প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় ও ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের অভিনীত সাবেক মুভিটি দেখলে বিষয়টি আরো সহজভাবে বোঝা যায়, যে বিচ্ছেদের পেছনে কীভাবে শুধু নারীকেই দোষারোপ করা হয়। এই ছায়াছবিতে প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায় একটি সল্প আয়ের টুরিস্ট গাইডের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, অপর দিকে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত ছিলেন একজন সফল ইঞ্জিনিয়ার, তারা ভালোবেসে বিয়ে করেন, বিয়ের পর প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের মেল ইগো তাকে এতটাই ট্রিগার করেছে যে, ভালো চাকরি করা বউয়ের থেকে দামি গিফট পর্যন্ত নিতে তার আত্মসম্মানে আঘাত লাগে, দিনের পর দিন অবহেলায়, অযত্নে, সামান্য পরিমাণ সম্মানটুকু না পেয়ে একটা পর্যায়ে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত বিচ্ছেদের পথ বেছে নিলেন।

তার অনেক বছর পর ট্রেন ভ্রমণে তাদের আবার দেখা হলে প্রসেনজিতের দ্বিতীয় স্ত্রীর কাছে ঋতুপর্ণাকে শুনতে হলো সংসার টিকিয়ে রাখতে তার আরো কম্প্রোমাইজের প্রয়োজন ছিল। এই মুভির বিখ্যাত একটি ডায়লগ হলো- আমার কাছে অ্যাডজাস্টম্যান্ট মানে হেরে যাওয়া নয়, আমার কাছে অ্যাডজাস্টম্যাট মানে হলো সুন্দর করে বাঁচা। এই অ্যাডজাস্টম্যান্ট, কম্প্রোমাইজ শব্দগুলো কেন নারী শব্দের সমার্থক হয়ে উঠছে? নারীকেই কেন অ্যাডজাস্ট করে চলতে হবে? প্রসেনজিৎ নিজে থেকে কী একটু চেষ্টা করেছে সংসারটি টিকিয়ে রাখতে? যুগের পর যুগ ধরে নারীকেই কেন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখার যুদ্ধে নামতে হয়, সেই যুদ্ধে হেরে গেলে সারা জীবন ডিভোর্সি ট্যাগ নিয়ে বেঁচে থাকতে হয়? ডিভোর্সি শব্দটিও কেমন স্ত্রীবাচক শব্দ হিসেবে ব্যবহার হয়ে আসছে, পুরুষের বেলায় বলা হয় ওর বউ চলে গেছে; কেন এটা বলা হয় না যে, সে বউকে আগলে রাখতে পারেনি? যেমনি নারীকে বলা হয় সে সংসার টিকিয়ে রাখতে পারেনি। নারীকে তার প্রাপ্য সম্মান টুকু দিন, তাহলে তাকে আটকে রাখতে আপনাকে কষ্ট করতে হবে না, বৃত্তের পরিধির মতো আপনার চারপাশে থেকেই সে তার সারাটি জীবন ব্যয় করে দেবে। আমরা এত আধুনিক হয়েছি অথচ আমাদের এই একটা জায়গায় কেন মানসিকতার উন্নতি হচ্ছে না!

নারী কীসে আটকায়- এই ট্রেন্ডে গা না ভাসিয়ে আপনারা নারীর

যত্ন নিন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে