সমাজগঠনের ভিত্তি হলো পরিবার আর পরিবার গঠনের মূল একক নারী-পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্ক। আবহমান কাল ধরেই নারী-পুরুষের বৈবাহিক সম্পর্ক সমাজ, ধর্ম ও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও চলমান। এ ধারা অব্যাহত আছে বলেই সমাজ ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। তাই বিয়ে একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে সবার কাছে সমাদৃত। পরিবার যখন ভেঙে যায় তখন মূলত সমাজটাই ভেঙে যায়।

কালের পরিবর্তনে সমাজব্যবস্থা আজ আগের মতো নেই। পূর্বে বৈবাহিক সম্পর্কগুলো খুবই দৃঢ় অবস্থানে থাকলেও বর্তমানে তা ভঙ্গুর হয়ে যাচ্ছে। দিন দিন বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা আমাদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

'বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস' প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২২ সালের তালাকের স্থূল হার বেড়ে প্রতি হাজারে ১ দশমিক ৪টি হয়েছে। ২০২১ সালে এই হার ছিল প্রতি হাজারে ০ দশমিক ৭টি। শহরের তুলনায় গ্রাম এলাকায় এই বিয়ে বিচ্ছেদের হার বেড়েছে। যা খুবই আশঙ্কাজনক। বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি।

নানা মানুষের নানা মত থাকলেও সমাজ নারীকে ও নারীর ক্ষমতায়নকেই এই সমস্যার মূল কারণ হিসেবে বিবেচনা করে। সমাজ মনে করে, নারী শিক্ষিত হলে, কর্মজীবী হলে বিয়ে বিচ্ছেদের ঘটনা বেড়ে যায়। নারীর আত্মনির্ভরতাই বিয়ে বিচ্ছেদের প্রধান কারণ। তবে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীর সঙ্গে ঘটা ঘটনাগুলো তারা স্বীকার করতে চায় না। যৌতুকসহ নানা বিষয়ে নারীর ওপর নির্যাতনের কথা এক প্রকার মাটির নিচেই চাপা পরে থাকে।

সাইবার অপরাধ ও নারী

পূর্বে নারীর ওপর নির্যাতন করা হলে নারী তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হতো শিক্ষা ও যোগ্যতার অভাবে। কিন্তু সময় এখন বদলেছে। নারী দিন দিন শিক্ষিত হচ্ছে, যোগ্য করে গড়ে তুলছে নিজেকে। নিজেকে আত্মনির্ভর করে গড়ে তোলার ফলে এখন সে আর পুরুষের নির্যাতন সইতে বাধ্য হয় না। নারীর প্রতি নির্যাতনের পদক্ষেপ সে নিতে প্রস্তুত থাকে এবং নিচ্ছে।

তবে দিন দিন কেন এত বিয়েবিচ্ছেদ হচ্ছে? তা নিয়ে সমাজবিজ্ঞানীদের ধারণা, বৈবাহিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে নৈতিকতার পতন, মূল্যবোধের অবক্ষয়, নারী-পুরুষের মনস্তাত্ত্বিক চাপের পাশাপাশি পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা ও বিশ্বাসের জায়গা আজ ঠুনকো হয়ে দাঁড়িয়েছে। সমাজের মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অভাব। মেনে নেওয়া, মানিয়ে নেওয়ার প্রবণতাও দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। ক্ষমার সদিচ্ছা নেই বললেই চলে। এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন নাটক সিনেমায় চোখ ধাঁধানো কৃত্রিম সম্পর্ক দেখে নিজের বাস্তব জীবনে তা খুঁজে না পাওয়ার ঘটনাও বৈবাহিক সম্পর্কে ফাটল ধরার অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচনা করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর ফাতেমা রেজিনা ইকবালের মতে, বিয়ে বিচ্ছেদ বেড়ে চলার অন্যতম কারণ হচ্ছে- 'সমাজে সহিষ্ণুতা কমছে। নগরজীবনের চাপ, ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, সঙ্গীর পছন্দ-অপছন্দ, জৈবিক চাহিদা পূরণ না হওয়া ইত্যাদি বিষয় দাম্পত্য সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলছে। নারীরা সংসারে নিজের মর্যাদা না পেয়ে বিচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।'

তাছাড়া বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কও দিন দিন বেড়েই চলছে। একজন পুরুষ গোপনে অনেকজন নারীর সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক গড়ে তুলছে। তেমনিভাবে নারীও সম্পর্ক গড়ছে অন্য পুরুষদের সঙ্গে। অনলাইনের যুগে এ অবস্থা পানির মতো সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর ফলে বিচ্ছেদ বেড়েই চলছে। ভেঙে পড়ছে সমাজ। ক্রমাগত এই বিচ্ছেদ ঘটতে থাকলে অচিরেই সমাজ তার ভারসাম্য হারাবে। দেখা দেবে বিশৃঙ্খলা ও নৈতিকতার অবক্ষয়।

তবে আশার কথা হচ্ছে, যেই সমাজে হাজারটা সম্পর্ক অনায়াসে বিচ্ছেদ ঘটে, সেই সমাজেই আবার একই ছাদের তলায় মানুষ একসঙ্গে কাটায় আজীবন। এটা তাদের পক্ষেই সম্ভব যারা বৈবাহিক সম্পর্কে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ, ভালোবাসা ও বিশ্বাসের সহিত সম্পর্কের যত্ন নেয়। ভুলত্রম্নটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখে সঠিক কর্ম চেষ্টা অবলম্বন করে সম্পর্ক টিকিয়ে রাখে। তাই আমাদের সবার এ বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। আদর্শ সমাজ গঠনে ভূমিকা পালন করতে হবে।