রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

বাড়ছে মাদকাসক্ত নারী

মাদকাসক্তদের তালিকায় রয়েছে নারীরাও। পারিবারিক কলহ, নানা প্রকার হতাশা, সামাজিক নিপীড়ন ও নির্যাতন থেকে নারীরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। বাংলাদেশের মাদকবিরোধী সংস্থা মানস বলছে, দেশে প্রায় ৭০ লাখ মাদকাসক্তের ১৬ শতাংশই নারী। ঢাকায় আহছানিয়া মিশনে মেয়েদের জন্য একটি আলাদা মাদক নিরাময়কেন্দ্র রয়েছে। ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সি নারীদের মধ্যে ১৫ শতাংশ নারী নানা ধরনের মাদকে আসক্ত বলেও সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে। আর এদের মধ্যে আবার ৪৩ শতাংশ নারী সেবন করছেন ইয়াবা। গবেষকরা বলছেন, ইয়াবার সহজলভ্যতার কারণেই এর দিকে ঝুঁকে পড়ছেন নারীরা।
নূর কামরুন নাহার
  ২৯ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

২০০০ সালের প্রথম দিকে আব্বা ধলপুর এলাকায় বাসা নিয়েছিলেন। আমার ছোট ছেলের বয়স ছয় মাস। আব্বা হঠাৎ বেশ অসুস্থ হয়ে পড়লেন। আব্বার বাসায় কিছু দিন থাকার জন্য এলাম। অদ্ভুত এলাকা এই ধলপুর। দিনেদুপুরে এখানে প্রকাশ্যে হেরোইনের ব্যবসা চলে। সন্ধ্যার পর এলাকার চেহারা একেবারে অন্যরকম হয়ে যায়। কেমন একটা সুনসান ভাব। বাতাসে উড়তে থাকে শুধু মাদকের গন্ধ। চারপাশে কী এক ফিসফিসানি। মাঝেমধ্যে চলে যায় পুলিশের টহল দেওয়া গাড়ি। সে সময় একদিন সকালে বাসার গেট খুলে বাইরে যাব। গেট খুলতেই পায়ের ওপর লুটিয়ে পড়ল একজন মানুষের দেহ। আমি আঁতকে উঠে চিৎকার দিলাম। আশপাশের দোকানদাররা ছুটে এলেন। আমার পায়ের ওপর থেকে টেনে তুললেন দেহটা। না, সেটা কোনো মানুষের দেহ নয়। সেটা তখন একটা মানুষের লাশ। সবাই চিৎকার করে বলল হেরোইনসি মারা গেছে। আপনাদের গেটের কাছে মারা গেছে। লোকটার শরীরের ঠান্ডা স্পর্শ তখনও আমার পায়ে লেগে আছে। আমি বিস্ময়ে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। সারা শরীর আমার অবশ হয়ে আসে। সে সময় আমি দেখেছি হেরোইনে আসক্ত নর-নারীদের। দেখেছি বেশ কিছু তরুণ ছেলেমেয়েকে। তরুণ ছেলের সংখ্যা যেমন, তেমনি তরুণীদের সংখ্যাও কম নয়। এদের বয়স পনেরো থেকে শুরু করে চব্বিশ-পঁচিশের মধ্যেই বেশি। এসব মেয়েকে দেখলেই বোঝা যায় এরা ভালো পরিবার থেকে এসেছে। কিন্তু সর্বগ্রাসী মাদক তাদের সব কেড়ে নিয়েছে। কিছু কিছু মেয়ে দেখি প্রথমে যখন তারা আসে বেশ ভালো কাপড়চোপড় পরা। ধীরে ধীরে তাদের বেশবাস এত মলিন হয়ে যায় যে বোঝাই যায় না যে তারা কোনো একদিন ভালো কোনো পরিবারের সন্তান ছিল। তাদের পোশাক এবং চেহারার মালিন্য দেখে মনে হয় তারা নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে। খোঁজ নিয়ে জানতে পারি হেরোইনের টাকা জোগাড় করার জন্য তারা তাদের দামি পোশাক-আশাকও বিক্রি করে দেয়। মাদকসেবী এসব মেয়ে ও নারী শেষ পর্যন্ত অসামাজিক কার্যক্রমে জড়িত হয়ে রাস্তার নারীতে পরিণত হয়।

এসব কাহিনী অনেক আগের কিন্তু এ চিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি বরং মাদকে নারীর অংশগ্রহণ আরও বেড়েছে। দেশে বর্তমানে মাদকাসক্তের সংখ্যা নিয়ে নানা পরিসংখ্যান ও বিতর্ক থাকলেও বলা যায় প্রায় ৭০ লাখ। এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ তরুণ। আর মাদকসেবীদের ৮০ শতাংশই এখন মরণনেশা ইয়াবায় আসক্ত। বিশেষজ্ঞদের মতে খোলা চোখে যা দেখা যাচ্ছে বাস্তবে মাদকাসক্তের সংখ্যা এর চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।

মাদকাসক্তদের এ তালিকায় রয়েছে নারীরাও। পারিবারিক কলহ, নানা প্রকার হতাশা, সামাজিক নিপীড়ন ও নির্যাতন থেকে নারীরা মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন। বাংলাদেশের মাদকবিরোধী সংস্থা মানস বলছে, দেশে প্রায় ৭০ লাখ মাদকাসক্তের ১৬ শতাংশই নারী। ঢাকায় আহছানিয়া মিশনে মেয়েদের জন্য একটি আলাদা মাদক নিরাময়কেন্দ্র রয়েছে। ১৫ থেকে ৩৫ বছর বয়সি নারীদের মধ্যে ১৫ শতাংশ নারী নানা ধরনের মাদকে আসক্ত বলেও সাম্প্রতিক গবেষণায় উঠে এসেছে। আর এদের মধ্যে আবার ৪৩ শতাংশ নারী সেবন করছেন ইয়াবা। গবেষকরা বলছেন, ইয়াবার সহজলভ্যতার কারণেই এর দিকে ঝুঁকে পড়ছেন নারীরা।

সরকারি হিসাব অনুযায়ী রাজধানীর কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের বহির্বিভাগে প্রায় তিন দশক আগে মাদকাসক্ত পুরুষের সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৯৬৪। সে সময় কোনো নারীই মাদকাসক্ত ছিলেন না। কিন্তু ২০১৬ সালে এসে পুরুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়ায় ৯ হাজার ১১৪-এ। তবে এ সময় মোট ৪৩ নারী মাদকাসক্তের কথা উলেস্নখ করা হয়। এই হিসাবে পুরুষ মাদকাসক্তদের মতো নারী মাদকাসক্তেরও মাদক নিরাময়ে চিকিৎসার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু খোদ সরকারের মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণাধীন কেন্দ্রীয় মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রের আন্তঃবিভাগে পুরুষদের চিকিৎসার জন্য ৪০টি আসন থাকলেও নারীদের জন্য কোনো আসনই নেই। অথচ শিশুদের জন্যও এখানে ১০টি আসন আছে। অর্থাৎ সরকারিভাবে নারী মাদকাসক্তদের চিকিৎসার জন্য কোনো ব্যবস্থা নেই! বিশেষজ্ঞরা জানান, বাংলাদেশে এখন অধিকাংশ নারীর মাদকাসক্তির বিষয়টি 'সুপ্ত' অবস্থায় আছে। আবার নারী মাদকাসক্তদের পরিবারও তাদের চিকিৎসায় অনাগ্রহী। বেসরকারিভাবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কাছ থেকে লাইসেন্স নিয়ে ঢাকায় ৬৩টি মাদক নিরাময়কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে। মূলত এগুলোতেই বেশির ভাগ সেবাগ্রহীতা চিকিৎসা নিচ্ছেন। কিন্তু সামাজিকতা ও লোকলজ্জার কারণে এ কেন্দ্রগুলো নারী মাদকাসক্তদের চিকিৎসাসংক্রান্ত তথ্যও লুকিয়ে রাখে। ফলে সেই নারীরা আসলে কোন ধরনের চিকিৎসা পাচ্ছেন তা জানা যাচ্ছে না। আবার পারিবারিক ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার ভয়ে অনেক নারীই চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

চিকিৎসক ও সংশ্লিষ্টরা জানান, নারী মাদকাসক্তদের চিকিৎসায় মূল বাধা হচ্ছে তার পরিবার। এ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীকে চিকিৎসার ব্যাপারে পরিবার কোনো সহযোগিতা করে না। অন্যদিকে, পরিবারের সদস্যদের অনাগ্রহের পাশাপাশি মাদকাসক্ত নারী নিজেও চিকিৎসার ব্যাপারে আগ্রহী নন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাদক গ্রহণের পর শরীর যখন আর সহ্য করতে পারে না এবং অনিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন শুরু করেন, তখন নারীরা চিকিৎসা নেন।

মাদকাসক্ত নারী যেমন বাড়ছে তেমনি মাদক ব্যবসায় জড়িত নারীর সংখ্যাও বৃদ্ধি পাচ্ছে। তালিকায় শীর্ষে থাকা মরণনেশা ইয়াবার ভয়াবহ বিস্তারে নারী ও শিশুদের ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। মাদক ব্যবসায়ীরা ইয়াবার আমদানি, সরবরাহ ও কেনাবেচার জন্য নিরাপদ হিসেবে নারী ও শিশুদের বেছে নিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে পুরুষরা ব্যর্থ হওয়ায় তাদের পরিবারের ও ভাড়া করা নারী-শিশুদের নামাচ্ছে এ ব্যবসায়। একজন নারী মাদক ব্যবসায়ী তার চুলের খোঁপায় প্রায় ৬০টি ইয়াবা বহন করতে পারে। এ ছাড়া সালোয়ার, কামিজ, বস্নাউজ, পেন্টি ও ব্রার ভেতরে সহজেই শত শত ইয়াবা বহন করা যায়। একইভাবে সামান্য কিছু টাকা দিয়ে শিশুদের স্কুল ব্যাগে করেও পাচার করা হচ্ছে মরণনেশা ইয়াবার ছোট-বড় চালান।

এক পরিসংখ্যানে বলা হয় 'দেশে যে কোনো ধরনের অপরাধের তুলনায় মাদকের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় নারীর। মোট মাদক কারবারির ২০ থেকে ৩০ শতাংশই নারী। তবে তাদের মধ্যে মাদক বাহকের সংখ্যাই বেশি। বাকিরা মাদকের নারী গডফাদার। দেখা যাচ্ছে নানাভাবেই নারী মাদকের সঙ্গে জড়িয়ে যাচ্ছে। নারী জড়িয়ে যাচ্ছে বলেই শিশুরাও জড়িয়ে যাচ্ছে। মাদকের সঙ্গে নারীর এই জড়িয়ে পড়ার কারণ বহুবিধ হলেও মূলত নারীর সামাজিক অবস্থান ও নারীর অসহায়ত্ব একটি মূল কারণ। নানাভাবেই নারী বৈষম্যের শিকার সেটি যেমন পারিবারিকভাবে, তেমনি সামাজিকভাবেও। এই বৈষম্য তাদের ভেতর যে হতাশা আর ক্ষোভের জন্ম দেয় তা থেকে তারা মাদক গ্রহণ করে থাকে। এ ছাড়া দেখা যায় কখনো নারী মাদক গ্রহণ করছে তার স্বামীর কারণে, একইভাবে মাদক ব্যবসায়ও জড়িয়ে পড়ছে তার স্বামীর কারণে। নারীর অসহায়ত্বের সুয়োগ নিয়ে নারীকে ব্যবহার করা হচ্ছে মাদক ব্যবসায়।

মাদক গ্রহণ এবং মাদক ব্যবসায় নারীর অংশগ্রহণ দুটোই মারাত্মকভাবে সমাজে বিপর্যয় ডেকে নিয়ে আসছে এবং ভবিষ্যতে এটির ফলাফল আরও ভয়াবহ। নারী মাদকসেবী সামাজিকতার ভয়ে ও পরিবারের সুনাম রক্ষায় এসব অজুহাতে সঠিক চিকিৎসা ও সেবা পায় না। ফলে তাদের নিজের জীবন যেমন বিপর্যয় হয়ে পড়ে তেমনি তারা জাতির জন্য হয়ে পড়ে বোঝাস্বরূপ। অনেক সময় বিকৃত বা বিকলাঙ্গ সন্তান জন্ম দিয়ে তারা সমাজের জন্য আরও বোঝা সৃষ্টি করে। ফলে নারীর মাদক গ্রহণ শুধু তাদের নিজের জন্য নয়, আগামী প্রজন্মের জন্য মারাত্মক বিপদ ডেকে আনে।

একটি সুস্থ-সুন্দর জাতি ও সমাজ গঠন করতে হলে অবশ্যই সে সমাজের নারীর প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। কোনো দেশই উন্নত হতে পারবে না যদিও না সে দেশের নারীদের যথার্থভাবে উন্নয়ন ঘটানো হয়। নারী যদি মাদকাসক্ত হয়ে পড়ে, তবে তা জাতির উন্নয়নের মারাত্মক প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবে। তাই নারীকে মাদক থেকে মুক্ত করতে হবে। তার সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সামাজিক বৈষম্য দূর করতে হবে। নারীকে আত্মনির্ভরশীল করে তুলতে হবে। তবেই নারী মাদকমুক্ত হবে, আমাদের আগামী প্রজন্ম মাদকের ঝুঁকি থেকে বাঁচতে পারবে এবং আমরা একটা সুন্দর দেশ গড়তে পারব।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে