রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ বৈশাখ ১৪৩১

নারী ও আমরা

বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের একাংশের মধ্যে একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে যেখানে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও তার স্ত্রী সোফি গ্রেগরির বিয়েবিচ্ছেদ নিয়ে চর্চা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, 'জাস্টিন ট্রুডোর ক্ষমতায়, বিল গেটসের টাকায়, ফুটবলার হাকিমির জনপ্রিয়তায়, হুমায়ূন ফরিদীর ভালোবাসায়, তাহসানের কণ্ঠে কিংবা হৃতিক রোশানের স্মার্টনেসে কোনো কিছুই নারীকে আটকাতে পারেনি। তাহলে কি কেউ বলতে পারবেন নারী আসলে কীসে আটকায়?
সোহাগ সরকার
  ২৯ আগস্ট ২০২৩, ০০:০০

'ক'দিন থেকে নারী কীসে আটকায়' শীর্ষক অনেক পোস্ট চোখে পড়ল কিছুটা বাধ্য হয়ে, কিছুটা বিরক্ত হয়ে পড়তে হলো, কিছুটা অতিরঞ্জিত, কিছুটা হেয়ালি মিশ্রিত পোস্টেও চোখ গেল অনিচ্ছাকৃত। অতঃপর ভাবলাম আমিও গা ভাসাই ভার্চুয়াল স্রোতে।

বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের একাংশের মধ্যে একটি পোস্ট ভাইরাল হয়েছে যেখানে কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ও তার স্ত্রী সোফি গ্রেগরির বিয়েবিচ্ছেদ নিয়ে চর্চা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, 'জাস্টিন ট্রুডোর ক্ষমতায়, বিল গেটসের টাকায়, ফুটবলার হাকিমির জনপ্রিয়তায়, হুমায়ূন ফরিদীর ভালোবাসায়, তাহসানের কণ্ঠে কিংবা হৃতিক রোশানের স্মার্টনেসে কোনো কিছুই নারীকে আটকাতে পারেনি। তাহলে কি কেউ বলতে পারবেন নারী আসলে কীসে আটকায়? এই পোস্টটির পক্ষে-বিপক্ষে নেটিজেনদের নানা প্রতিক্রিয়া ও মতামত দেখা গেছে। নারী কি শুধুই আটকানোতেই সীমিত নাকি আরও অনেক গুরুত্ববহ স্বত্বাধিকারী, আসুন দেখি মহা মনিষীরা কি বলেন? তারপর না হয় আমি আমার কথা বলি?

স্বর্ণ-রৌপ্যভার,

নারীর অঙ্গ-পরশ লভিয়া হয়েছে অলঙ্কার।

নারীর বিরহে, নারীর মিলনে? নর পেল কবি-প্রাণ

যত কথা তার হইল কবিতা, শব্দ হইল গান।

রাজা করিতেছে রাজ্য শাসন, রাজারে শাসিছে রানী,

রানীর দরদে ধুইয়া গেছে রাজ্যের যত গস্নানি।

পুরুষ-হৃদয়হীন,

মানুষ করিতে নারী দিল তারে অর্ধেক হৃদয় ঋণ।

দ্রোহের কবি, প্রেমের কবি, সাম্যের কবি, জাতীয় কবি নজরুলের সাম্যের গান গাই কবিতার মধ্যাংশ হতে নেয়া দুটো পঙ্‌ক্তি দিয়েই অবতারণা করি নারী আদতে পূজার আধাধ্যের। কারণ এই নারী-ই ভগ্নি, যায়া ও জননী।

ভাগ্যের দরবারে দু'হাত পেতে, চাই না পুণ্য ফলে স্বর্গে যেতে, ওই স্বর্গকে ধরে ফেলি হাতের মুঠোয়, যদি একবার হাতখানি রাখো এই হাতে।

পুলক বন্দোপাধ্যায়ের কথায় মান্নাদের গাওয়া এই গানটি শুনেই নারী কতটা আরাধ্য একটা পুরুষের কাছে তা অনুমেয়।

স্বপ্নবিলাসী কেউ কেউ বলেন যে, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। হ্যা... আমিও সহমত, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। নারী ও তো মানুষ তারও তো স্বপ্ন আছে, স্বাদ আছে, আকাঙ্ক্ষা আছে। মেয়েদের আটকে যাওয়া আর ছেড়ে যাওয়ার কাহিনীগুলো ঠিক এই স্বপ্ন থেকেই শুরু হয়।

কেন শোনেননি? আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে সাত সাগর আর তের নদীর পাড়ে?

মেয়েদের মনস্তাত্ত্বিক অধ্যায় জটিল তা সবারই জানা? লোকে বলে, নারীর মনস্তাত্ত্বিক অধ্যায়

বোঝার ক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তা নিজেই নাকি দ্বিধান্বিত। কথাটা শুনতে খারাপ লাগলেও এটির হয়তো যুক্তিক ব্যাখ্যা আছে, যদি এখানে এক তরফা মেয়েদের ছেড়ে যাওয়ার গল্প আসে, তাহলে চলুন, গল্পটা ভিন্ন আঙ্গিকে উপস্থাপন করি।

মিল্টন খন্দকারের কথায় শিল্পী আরিফুল ইসলাম মিঠুর গাওয়া গানটি শুনেছেন কি?

চাঁদেরও ঈর্ষা হবে তোমায় দেখে?

বাগিচায় ফুটলে গোলাপ দলে দলে,

তুমি কাছে এলে যে হয় ম্স্নান সকলে।

বিধাতা বিভোর হবে সৃষ্টি দেখে,

ও তনুর বাহার দেখে।।

১৬ বছর বয়েসে পৃথিবীর মানুষকে চেনার আগেই, শারীরিক হরমন প্রতিক্রিয়ার ফলে নারীর চিন্তাভাবনা ও জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি হয় আকাশে উড়ানো রঙিন ঘুড়ির মতো, আবেগী এবং ভুলে ভরা। এই বয়সের মেয়েদের শুধু মায়া, যত্ন আর ভালোবাসা দিয়ে আটকে রাখতে পারবেন। তবে তা শুধু ১৮ বছর বয়স পর্যন্ত।

রবি ঠাকুরের উক্তি মনে আছে তো তাই না? ওলো সই আমার ভীষণ ইচ্ছে করে তোর মতো এমনি করেই মনের কথা কই।

১৯ বছরে এসে কিছুটা বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হয়ে উঠে মেয়েরা। তার স্বপ্ন বড় হতে থাকে। এখন শুধু মায়া, ভালোবাসা আর যত্ন নয়, সঙ্গে সম্পর্কের ভেতরের বিশেষ গুণগুলোকেও সে বুঝতে শেখে, পড়তে শেখে।

সঙ্গে যোগ হয় সম্মান ও বিশ্বস্ততা।

একইভাবে মেয়েদের মৌলিক চাহিদার আকারও বৃদ্ধি পেতে থাকে ক্রমেই।

তখন একটা মেয়ে বা নারী তার অধিকার বুঝে নিতে চায় এবং নিজের ওপরে আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠে। তার শিক্ষা এবং অভিজ্ঞতার প্রস্ফুটন হতে থাকে এখান থেকেই।

তাই এই বয়সের নারীদের আটকাতে ভালোবাসা, সম্মান, যত্ন, বিশ্বস্ততা, মর্যাদা এবং একটি পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যকর শারীরিক সম্পর্কের পাশাপাশি প্রয়োজন হয় অর্থেরও। ২৮ বছর পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতায় নারীকে আটকাতে পারবেন। আর তখনই তৈরি হয় একটা আত্মিক মেলবন্ধন- যাকে আমরা সম্পর্কের সেতুবন্ধন রূপে দেখি, তৈরি হয় নিগূঢ় নিবিড় ও পরিচর্যা পরিমন্ডিত একটা বিশ্বস্ত সমান্তরাল সম্পর্ক।

এবার আসেন মেয়েদের বয়স যখন হয় ৩০। এই বয়সে একজন নারী হয়ে ওঠে সিংহিনীর ন্যায়। হিংস্র কিন্তু মায়াবী যত্নবান আর দায়িত্বশীল।

এত বছরের লম্বা পথ পরিক্রমায় বিদগ্ধ হয়ে এবার সব থেকে সুন্দর মুহূর্তে এসে পৌঁছে গেছে সে। নারী এ সময় নিজেকে বোঝার অদম্য প্রয়াস চালাতে থাকে। এই বয়সে নারী নিজের আত্মসম্মান ও ভালোবাসাকে হিমালয় পাহাড়ের থেকে ও উচ্চতর স্থানে নিয়ে যায়। এখন আর কেউ তার কাছে দর কষাকষি করতে পারবে না।

এই নারীকে আটকাতে গেলে অনন্ত হিমালয়সম হৃদয় নিয়ে তার সামনে দাঁড়াতে হবে। সঙ্গে নাম, যশ, খ্যাতি তো থাকতেই হবে। আগের চাহিদাগুলো এর সঙ্গে যুক্ত হতে হবে। তাই বুঝি মহাকবি ওমর খৈয়াম বলেন,

ওগো নারী, শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি তুমি অবনীর, গোলাপে গঠিত যেন ভিতর বাহির! মাঝে মাঝে সবিস্ময়ে তাই মনে হয়, তুমি তো গোলাপ ছাড়া অন্য কিছু নয়!

সুতরাং নারী কে অবজ্ঞা বা অবহেলা নয়, নারীকে ভালোবেসে, গুরুত্ব দিন, সম্পর্কের মাঝে ছোট-খাটো বিষয়গুলোতে আরো যত্নশীল হোন। ছোট ছোট সুখ স্মৃতি সম্পর্কের সেতুবন্ধন তৈরি করে।

কবির ভাষায়,

প্রাণকে নারী পূর্ণতা দেয়, এই জন্যই নারী মৃতুুকেও মহীয়ান করতে পারে।

আপনি/আমি/আমরা সবাইকেই মনে রাখতে হবে আর কিছু থাক বা না থাক পাঁচটি মৌলিক উপাদান থাকা আবশ্যক।

\হবিশ্বাস।

\হত্যাগ।

\হদায়িত্ববোধ।

সম্মান।

ভালবাসা।

একমাত্র তবেই একজন নারী আপনার জীবনসঙ্গী হয়ে আজীবন আপনারই পাশে থেকে যাবে নির্ভরতায় ভালোবাসায় আষ্টেপৃষ্ঠে।

পরিশেষে মাওলানা রুমীর উদৃতি দিয়ে যবনিকাপাত করি, তিনি বলেন,

নারী বিধাতার ছায়া, সে নহে কামিনী।

নহে সে যে-সে সৃষ্টি, তারে স্রষ্টা অনুমানী।

নারীকে ভালোবেসেই ভালোবাসার মেলবন্ধনের সূচনা হউক যা পাথর ক্ষয়ে যাওয়া কাল অবধি অমর অঝোর অক্ষয় হউক।

ভালোবাসার সাম্পানে প্রেমের দরিয়া প্রমত্তা পদ্মা কিংবা অশান্ত প্রশান্ত মহাসাগর

পাড়ি দিয়ে কুল পাক প্রেমিক যুগল। বর্তমান সময়ের রিলেশনগুলো কেন টিকে না জানেন? কারণ একে অন্যকে ছাড় দেয়ার প্রবণতাটা কম থাকে।

ফলে এক সময় সম্পর্কটা একে অন্যের কাছে ভারী মনে হয়। আটলান্টার বরফ গলার মতো ইমোশন হ্রাস পেতে থাকে। বেড়ে ওঠার জন্য যেমন অক্সিজেন গুরুত্বপূর্ণ তেমনি একটা রিলেশন টিকিয়ে রাখার জন্য স্পেস দরকার। স্পেস দিন বেড়ে ওঠার। দেখবেন রিলেশনেরর ভিত মজবুত হবে। নারীকে ভোগ আর লালসার চোখে নয়, সম্মান আর মর্যাদায় চোখে দেখুন। তার বুদ্ধিবৃত্তিক মতামতের মূল্যায়ন করুন। বিখ্যাত ইংরেজ লেখক, কবি এবং সাহিত্যিক, রুডইয়ার্ড কিপলিং বলেছিলেন,

নারীর অনুমান পুরুষের নিশ্চয়তার চেয়ে অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য।

সুতরাং ভরসা রাখুন নিজের প্রতি এবং নিজের প্রিয় মানুষটির প্রতি। দেখবেন দিনশেষে আপনি ওই পৃথিবীর সেরা সুখী মানুষের একজন।

সবার জন্য অনেক অনেক শুভেচ্ছা সম শুভ কামনা।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে