রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

নারীর উন্নয়ন ও কিছু সীমাবদ্ধতা

মনন-সৃজনশীলতায় পরিবার ও কর্মক্ষেত্রসহ সব স্তরে নারীরা অনেক দূর এগিয়ে গেলেও নারী নির্যাতন হ্রাসের বিপরীতে নির্যাতনের ধরন বদলে প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে নিত্যনতুন অপরাধ। রাস্তাঘাট গণপরিবহণ-শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্মস্থলেও নারীরা ব্যাপক হারে নির্যাতিত হচ্ছে। ঘর থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে নারীরা নানামুখী মৌখিক সহিংসতার শিকারে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হওয়ার দৃষ্টান্তও নেহায়েত কম নয়।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী
  ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

সমগ্র বিশ্ববাসীসহ দেশের আপামর জনগণ সম্যক অবগত আছেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার টানা তিন দফায় পরিচালিত সরকারের নারী উন্নয়নে অভূতপূর্ব অর্জন শুধু দেশে নয়, বিশ্ব পরিমন্ডলেও উঁচুমাত্রিকতায় সমাদৃত। একান্ত নিজস্ব ব্যক্তিত্ব ও বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল দেশরত্ন শেখ হাসিনা দেশের অদম্য উন্নয়ন অগ্রগতি পরিক্রমায় নারী উন্নয়নে প্রণিধানযোগ্য গুরুত্বারোপ অব্যাহত রেখেছেন। বৈশ্বিক লিঙ্গ সমতা বৈষম্যের সমীকরণের সঙ্গে যথার্থ ভারসাম্য রক্ষায় ইতোমধ্যেই আকাশচুম্বী বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। নারী নির্যাতন-নারীর প্রতি সহিংসতা এবং নানামুখী অসংযত পর্যায়সমূহ সংহার করে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় তার উদ্যোগ সমধিক প্রশংসিত। দৃঢ় নেতৃত্ব-সুদূরপ্রসারী চিন্তা ও প্রজ্ঞার অপূর্ব সম্মিলনে দেশের নারী সমাজের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নে প্রধানমন্ত্রী অনন্য নজির স্থাপন করেছেন। দল-সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে স্থানীয় প্রশাসন ও তৃণমূল পর্যন্ত তিনি অবিরাম নারী উন্নয়নের প্রসার ঘটিয়েছেন। নারী শিক্ষার বিকাশ-নারীকে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করা, নারী সুরক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আইন প্রণয়ন এবং কর্মক্ষেত্র-রাজনীতিতে নারীর অবাধ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ ও বাস্তবায়নে তার কর্মযজ্ঞ অতুলনীয়। অতিসম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত ১৫তম ব্রিকস শীর্ষ সম্মেলনে আগত রাষ্ট্র-সরকার প্রধানদের সম্মানে আয়োজিত মধ্যাহ্নভোজে প্রদত্ত বক্তব্যে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এই অঞ্চলের নারী ও বালিকাদের পরিবর্তনের কারিগর হিসেবে গড়ে তোলার জন্য গেস্নাবাল সাউথ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে পাঁচ দফা প্রস্তাব পেশ করেন। প্রস্তাবনাগুলো হচ্ছে- নারী ও মেয়েদের পুষ্টি-স্বাস্থ্য-নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে চলমান খাদ্য-শক্তি-আর্থিক সংকটের বিরূপ প্রভাব প্রশমিত করা, মেয়েদের স্কুলে রাখতে; তাদের সাইবার অপরাধ থেকে সুরক্ষিত রাখতে ও তাদের ক্রমবর্ধমান ডিজিটাল বিভাজন কমানোর জন্য প্রচেষ্টা চালানো, নারীদের লাভজনক কর্মসংস্থান-শালীন কাজ-মজুরি সমতা ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির সুযোগ বাড়ানো, সক্রিয় ও টেকসই রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের জন্য নারীদের লেভেল পেস্নইং ফিল্ড তৈরি করা এবং জলবায়ু প্রভাবের কারণে নারীদের সুক্ষা ও টিকে থাকার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া। বক্তব্যে তিনি লিঙ্গ সমতার দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি নেতাদের প্রতি অনুপ্রাণিত বোধ করছেন বলেও মন্তব্য করেন। এছাড়াও নারী মাস উদযাপনের জন্য তিনি সব দক্ষিণ আফ্রিকাবাসীকে অভিনন্দন জানান। বস্তুতপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে দেশে নারী উন্নয়নের নবতর অধ্যায় নির্মিত হয়েছে। বিগত সময়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে এবং বর্তমান সরকারে শিক্ষা, শ্রম ও কর্মসংস্থান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে নারীকে অধিষ্ঠিত করে তিনি দেশের ইতিহাসে যুগান্তকারী মাইলফলক স্থাপন করেন। তার হাত ধরেই মহান জাতীয় সংসদে প্রথম নারী সংসদ উপনেতা ও স্পিকার পদে নারী নিয়োগপ্রাপ্ত হন। ইতোমধ্যে তিনি বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ সময়ের জন্য দায়িত্ব পালনকারী বিশিষ্ট মহিলা নেত্রীর তালিকায় স্থান পেয়েছেন। মার্কিন অর্থ ও বাণিজ্যবিষয়ক সাময়িকী ফোর্বসের ২০২২ সালের বিশ্বের প্রভাবশালী ১০০ নারীর তালিকায় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ৪২তম অবস্থানে। নারী উন্নয়ন-ক্ষমতায়ন-অধিকার প্রতিষ্ঠায় নানামুখী পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে নারী সমাজকে এগিয়ে নেওয়ার স্বীকৃতিস্বরূপ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করতে কোনো জামানত ছাড়াই সর্বোচ্চ ২৫ লাখ টাকা এসএমই ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করাসহ তার নেতৃত্বেই একটি যুগোপযোগী জাতীয় নারীনীতি প্রণয়ন করা হয়েছে। দুস্থ-অসহায় নারীদের জন্য ভিজিএফ, ভিজিডি, দুস্থ ভাতা, বয়স্ক ভাতা, মাতৃত্বকালীন ও গর্ভবতী মায়েদের ভাতা, অক্ষম মা ও স্বামী পরিত্যক্তাদের জন্য ভাতা, বিধবা ভাতা, কাজের বিনিময়ে খাদ্য কর্মসূচিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি নারী উন্নয়নে বিশেষ অবদান রেখে চলেছে। সৃজনশীল মেধাকর্ম হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে গৃহ-ভূমিহীন পরিবারের নারীদের সামাজিক নিরাপত্তায় বিরল দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রতিভাত। সর্বক্ষেত্রে সন্তানের পরিচয় ও নিবন্ধনে বাবার নামের পাশাপাশি মায়ের নাম যুক্ত করা এবং শিক্ষার বিনিময়ে ছাত্রছাত্রীদের সরকারি উপবৃত্তির টাকা মায়ের মোবাইলে এসএমএসের মাধ্যমে পাঠানোর ব্যবস্থাও উলেস্নখযোগ্য। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবাহিনীসহ সামরিক বাহিনীতে নারীদের অধিক অংশগ্রহণ এবং গুরুত্বপূর্ণ- উচ্চ পদগুলোতে নারীদের নিয়োগে প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগ বিশ্বস্বীকৃত। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য, উচ্চ আদালতের বিচারপতি ও প্রতিরক্ষা বাহিনীতে ঊর্ধ্বতন পদে নারীর পদায়ন নারীর ক্ষমতায়নকে বিশেষ মর্যাদায় সমাসীন করেছে। রাজনীতি-দেশ পরিচালনায় নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত নারী আসন ৪৫ থেকে বাড়িয়ে ৫০ এ উন্নীত করেন। স্থানীয় সরকার পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়নে ইউনিয়ন পরিষদে নারী জনপ্রতিনিধিকে সরাসরি ভোটে নির্বাচনের এবং বাল্যবিয়ে রোধ, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন ও নির্যাতনকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা নারী উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রীর অসাধারণ কর্মকৌশলকে অধিকতর সুদৃঢ় করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধান, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ নারী উন্নয়নে দেশের অবস্থানের ভূয়সী প্রশংসা চলমান। গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিশ্বব্যাংক, অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউট (ওআইআই) এবং ই-পস্ন্যাটফর্মের সমীক্ষামতে, আনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। প্রথম অবস্থানে আছে ভারত। বাংলাদেশের পরে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, ফিলিপাইন ও যুক্তরাজ্য। এসব কাজে পুরুষদের ঘণ্টায় ২১ দশমিক ৫৭ পাউন্ড আয়ের বিপরীতে নারীদের আয় ২২ দশমিক ৪৩ পাউন্ড। রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) তথ্যমতে, করোনাভাইরাস মহামারির মধ্যেও বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড প্রায় ৪ হাজার কোটি ডলার পৌঁছেছিল। সংস্থাটির প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনাকালীন নারীশ্রমিকরা পাঠিয়েছেন মোট বৈদেশিক মুদ্রার ৬৯ শতাংশ আর পুরুষ কর্মীরা পাঠিয়েছেন মাত্র ৩০ শতাংশ। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডবিস্নউইএফ) সর্বশেষ প্রতিবেদনের ১৬তম সংস্করণের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালের 'গেস্নাবাল জেন্ডার গ্যাপ' প্রতিবেদনে বিশ্বের ১৪৬টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৭১। লিঙ্গ সমতায় ২০১৪ সাল থেকে দক্ষিণ এশিয়ার সব দেশ থেকে এগিয়ে আছে। রাজনীতিতে নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান নবম। অর্থনীতিতে নারীর অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ গতবারের ১৪৭তম অবস্থান থেকে ছয় ধাপ এগিয়ে ১৪১তম অবস্থানে উঠে এসেছে। শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১২৩তম। নারীদের স্বাস্থ্য সেবাপ্রাপ্তিতে ২০২১ সালের ১৩৪ থেকে বর্তমানে ১২৯তম স্থান অর্জন করেছে। মনন-সৃজনশীলতায় পরিবার ও কর্মক্ষেত্রসহ সব স্তরে নারীরা অনেক দূর এগিয়ে গেলেও নারী নির্যাতন হ্রাসের বিপরীতে নির্যাতনের ধরন বদলে প্রতিনিয়ত সংঘটিত হচ্ছে নিত্যনতুন অপরাধ। রাস্তাঘাট-গণপরিবহণ-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান-কর্মস্থলেও নারীরা ব্যাপক হারে নির্যাতিত হচ্ছে। ঘর থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে নারীরা নানামুখী মৌখিক সহিংসতার শিকারে শারীরিক ও মানসিকভাবে নির্যাতিত হওয়ার দৃষ্টান্তও নিহায়েত কম নয়। \হবিজ্ঞজনদের দাবি, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আমাদের অবাধ বিচরণ নারী নির্যাতন অনেকগুণ বাড়িয়েছে। সমাজে নারী নির্যাতনের বিষয়টি বিরূপ ধারণার বশবর্তী হচ্ছে। প্রায় প্রতি বছরই নারী নির্যাতনের ঘটনা কয়েক শতাংশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যান অনুযায়ী, করোনা মহামারির মধ্যে ২০২০-২১ সালে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের পরিমাণ প্রায় ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ৫ জুলাই ২০২৩ সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ছয় মাসে দেশে দেড় হাজারের বেশি নারী ও শিশু নির্যাতনের শিকার হয়েছে। তন্মধ্যে শুধু জুন মাসেই ২৬৫ জন নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছে। উলেস্নখ্য, পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে যে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন মাস পর্যন্ত শারীরিক ও মানসিকসহ বিভিন্নভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১ হাজার ৫২০ নারী ও কন্যাশিশু। এর মধ্যে ২২৩ জন কন্যাশিশুসহ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৩২৬ জন। দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৬০ জন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২১ কন্যাশিশুকে। জুনে নির্যাতিত হওয়া নারী ও কন্যাশিশুর মধ্যে ধর্ষিত হয়েছে ৫৩, সংঘবদ্ধ ধর্ষণ ১৩ এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৩ জনকে। এছাড়াও ২০১২ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে মোট নির্যাতিত হয়েছে ৪৮ হাজার ৭৯২ জন নারী ও কন্যাশিশু যার মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৯ হাজার ৮৫০ জন। ৬ মার্চ, ২০২৩ আন্তর্জাতিক নারী দিবস-২০২৩ উপলক্ষে বেসরকারি সংস্থা লাইট হাউস আয়োজিত 'মিডিয়া অ্যাডভোকেসি' শীর্ষক অনুষ্ঠানে উপস্থাপিত তথ্য-উপাত্ত মতে, ২০২২ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে ৯ হাজার ৭৬৪ জন নারী সহিংসতার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৪ হাজার ৩৬০ জন এবং ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৪৫০ জনকে। যৌতুকের কারণে মারধর করা হয়েছে ২ হাজার ৬৭৫ জনকে এবং যৌতুক না পেয়ে হত্যা করা হয়েছে ১৫৫ জনকে। অপহরণ করা হয়েছে ১ হাজার ৮৭০ জনকে। এসব ঘটনার মামলা হয়েছে ১৭ হাজার ২৭টি। মানবাধিকার কর্মীদের ভাষ্য মতে, নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার হয়ে আইনের দারস্থ হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অপরাধীরা ক্ষমতাবান-প্রভাবশালী হওয়ায় ভুক্তভোগীরা সঠিক বিচার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আসামিরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাওয়ায় নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা-নির্যাতনের ভয়াবহতা দিন দিন বেড়েই চলেছে। এছাড়া অনেক ঘটনাই অপ্রকাশিত থেকে যাচ্ছে। নারী নির্যাতন সংক্রান্ত মামলায় ৯০ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট জমার আইন থাকলেও তা মানা হয় না। এমনকি অনেক পাবলিক প্রসিকিউটরও উদাসীনতা দেখান। থানা পুলিশ এবং বিচার প্রক্রিয়ায় ভুক্তভোগীকেই নানাভাবে দোষারোপ করা হয়। ফলে, ভুক্তভোগীর পরিবারের চাপেই ঘটনা ধামাচাপা দেওয়া হয়। তাই বেশির ভাগ সহিংসতার ঘটনা অপ্রকাশিত থেকে যায়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মালেকা বানু গণমাধ্যমে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, 'যথাযথ আইনের অভাবে অপরাধীকে শাস্তি প্রদান ও সহিংসতার শিকার নারীরা ন্যায়বিচার পান না। তাই আইন সংস্কার জরুরি।' সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২০১৮ সাল থেকে প্রতি বছরেই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা বৃদ্ধি পেয়েছে। এর মধ্যে করোনা মহামারি অতিক্রান্তকালে অর্থাৎ ২০২০ সালে সবচেয়ে বেশি ৩৯ শতাংশ এবং ২০২১ সালে ৩৬ শতাংশ বেশি মামলা হয়। ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২২ সালে মামলা বেড়েছে ৫ শতাংশ। পুলিশ সাইবার সাপোর্ট সেন্টার ফর উইমেনের (পিসিএসডবিস্নউ) তথ্য অনুসারে, অপরাধীরা নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে অনলাইন মাধ্যমে সহজেই নারীদের তথ্য সংগ্রহ করে। পরে তাদের নানাভাবে হয়রানি করে। নারীদের নামে ভুয়া আইডি খুলে এবং তাদের আইডি হ্যাক করে বস্ন্যাকমেলিং করার পাশাপাশি মোবাইল ফোনেও আপত্তিকর কনটেন্ট ছড়ানোর অভিযোগ পাওয়া যায়। সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন পরিচালিত 'বাংলাদেশ সাইবার অপরাধ প্রবণতা-২০২২' শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন মতে, নারীরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে হয়রানি এবং পর্নোগ্রাফির শিকার বেশি হচ্ছেন। সংগঠনটির সভাপতি বলেন, 'ভুক্তভোগীদের বেশির ভাগই সাইবার বুলিংয়ের শিকার। এর মধ্যে রয়েছে ছবি বিকৃত করে সামাজিক মাধ্যমে অপপ্রচার, পর্নোগ্রাফি কনটেন্ট এবং অনলাইন-ফোনে মেসেজ পাঠিয়ে মানসিক নির্যাতন ইত্যাদি।' 'ঘরের শত্রম্ন বিভীষণ' বা নারীর বিরুদ্ধে নারী-পরিবার-সমাজ সর্বত্রই নারীবিরোধ অতিশয় দৃশ্যমান। শিক্ষা-সংস্কৃতি-বিনোদন-ছায়াছবিসহ প্রায় প্রতি ক্ষেত্রে নারীদের অন্তর্দ্বন্দ্ব-কলহ এত বেশি মাত্রায় উপস্থাপিত হচ্ছে; উন্নয়ন অর্জনকে ম্স্নান করতে এসব দৃশ্যপট প্রচন্ড কার্যকর। বর্ণচোরা-ছদ্মবেশী-ছলচাতুরী-লবিং-তদবির বাণিজ্যে পারঙ্গম ও অনৈতিক লেনদেনে সিদ্ধহস্ত মেধাশূন্য-অযোগ্য-অদক্ষ ধান্দাবাজ নারী নেতৃত্বের বিকাশ এবং উচ্চশিক্ষা থেকে প্রায় প্রতিষ্ঠানে এর পদায়ন-প্রভাব দেশব্যাপী বৈরী মনোভাব তৈরির প্রবল জনশ্রম্নতি রয়েছে। পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে সত্য-বস্তুনিষ্ঠ তদন্ত সাপেক্ষে সততা-যোগ্যতা-মেধার সমাহারে নারী নেতৃত্বের পরিপূর্ণ উন্মেষ সমাজকে অতিশয় উপকৃত করবে। প্রধানমন্ত্রীর সমুদয় উদ্যোগগুলো যাতে ধুরন্ধর নারীদের অপকৌশল-অপকর্মে কলুষিত না হয়, সেদিকে মনোযোগ দেওয়া সবারই পবিত্র দায়িত্ব বলে মনে করি। প্রধানমন্ত্রীর একার পক্ষে প্রত্যেকের জীবনবৃত্তান্ত-সামাজিক ও রাজনৈতিক সংযোগ-প্রতিষ্ঠান বা দেশের ভাবমূর্তিকে ভূলুণ্ঠিত করতে পারে- এমন সব বিষয়ে নিগূঢ় তদারকি সম্ভব নয়। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-নিয়োগ ও তদন্ত সংস্থাসহ সম্মিলিত প্রচেষ্টায় নারী উন্নয়ন উদ্যোগকে সফল করার ব্রত গ্রহণ সময়ের দাবি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে