রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

সরকারি চাকরিতে নারী

নারীরাও নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করে প্রতিষ্ঠিত হতেও বেগ পাচ্ছে না। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে উদ্যোক্তা তৈরিতে নারীদের অংশগ্রহণ নজরকাড়া। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নারীদের অবস্থান দৃষ্টিনন্দন। ৬৫% নারীর বিপরীতে ৩৫% পুরুষ। সত্যিই এক ঈর্ষণীয় সাফল্য। যে ব্যবসাবাণিজ্যে নারীদের অংশগ্রহণ এক যুগ আগেও ছিল হাতে গোনার অবস্থায়। সেখানে শিক্ষকতা, চিকিৎসক হওয়ার বাসনাই ছিল প্রবল।
নাজনীন বেগম
  ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান ধারায় ক্রমান্বয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য সত্যিই চমকপ্রদ একজন নারী পড়াশোনা শেষ করছেন কৃষি অর্থনীতিতে কিন্তু তিনি যখন পরীক্ষায় বসছেন সেখানে বিষয়ভিত্তিক নয় বরং সাধারণ জ্ঞান উপস্থিত বুদ্ধির যে প্রশ্ন সামনে আসে সেখানেও পড়তে হয় কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থায়। যেখানে বিষয়ভিত্তিক চিকিৎসক প্রকৌশলীর পরীক্ষায় এখনো নারীরা সমান তালে এগিয়ে চলার দৃশ্যও প্রতিবেদনে উঠে আসে, সেখানে একজন কৃষি অর্থনীতির শিক্ষার্থীকে দেওয়া হচ্ছে পুলিশ সুপারের দায়িত্ব বাংলাদেশ উন্নয়নের ক্রমবর্ধমান ধারায় ক্রমান্বয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য সত্যিই চমকপ্রদ। সমসংখ্যক নারীরাও নিজেদের যোগ্য প্রমাণ করে প্রতিষ্ঠিত হতেও বেগ পাচ্ছে না। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে উদ্যোক্তা তৈরিতে নারীদের অংশগ্রহণ নজরকাড়া। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে নারীদের অবস্থান দৃষ্টিনন্দন। ৬৫% নারীর বিপরীতে ৩৫% পুরুষ। সত্যিই এক ঈর্ষণীয় সাফল্য। যে ব্যবসাবাণিজ্যে নারীদের অংশগ্রহণ এক যুগ আগেও ছিল হাতে গোনার অবস্থায়। সেখানে শিক্ষকতা, চিকিৎসক হওয়ার বাসনাই ছিল প্রবল। শুধু কি তাই? সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে আসীন হওয়া বর্তমান সময়ের এক অভাবনীয় অর্জন। তবে এটাও অনস্বীকার্য যে, সংখ্যায় নারীদের অবস্থান এত অপ্রতুল সামগ্রিক অর্থে তা মূলত এখনো লড়াই করার দুরবস্থায়। পাশাপাশি শারীরিক ও অপেক্ষাকৃত মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়া নারীরা বিভিন্নভাবে সামাজিক অপসংস্কার, পারিবারিক হরেক কর্মযোগে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত না করার ব্যর্থতার চিত্রও কম নয়। সম্প্রতি এ রকম এক নেতিবাচক দৃশ্য উঠে আসে। সরকারি কর্মযোগে প্রবেশ করার প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা বিসিএসে অর্ধাংশ নারীর সমসংখ্যক পুরুষের তুলনায় পেছনে পড়ে যাওয়া। পাবলিক সার্ভিস কমিশন (পিএসসি) এক গবেষণালব্ধ তথ্যে উপস্থাপন করে বিসিএস পরীক্ষায় নারীদের সমান অংশগ্রহণ থাকলেও কৃতকার্যতায় তারা কিছুটা হলেও পিছু হটছে। বিশেষভাবে গত পাঁচ বছরের তথ্য-উপাত্ত নির্দেশ করে ৩৭ থেকে ৪২তম বিসিএস পরীক্ষায় নিয়োগের জন্য ১৬ হাজার ২৭২ জনের মধ্যে ৯ হাজার ৬৯২ জনই পুরুষ প্রার্থী।

তবে বিশেষ বিসিএসে নারী প্রতিযোগীরা সামাল দিতে পারলেও সাধারণ কার্যক্রম থেকে পিছিয়ে পড়াও হতাশাব্যঞ্জক। মোট জনগোষ্ঠীতে সমান সমান থাকার পরও প্রতিযোগিতামূলক অংশগ্রহণে তার সংখ্যা কম হওয়া মোটেও স্বস্তিদায়ক নয়। আবেদনের ক্ষেত্রে সংখ্যা কাছাকাছি হলেও কৃতকার্যতায় কেমন যেন পিছু হটছে। সংশ্লিষ্ট গবেষণা প্রতিবেদন উলেস্নখ করতে পিছপা হয়নি যে, যোগ্যতা অযোগ্যতা ছাড়াও নারীদের মানসিকভাবে পিছিয়ে থাকাও বড় কারণ হিসেবে মেনে নিতে হয়। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অভিমত ব্যক্ত করছেন- আরও একটা কারণ পরিবার। প্রথমত শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় বিয়ের পিঁড়িতে বসা।

যা ছাত্রদের বেলায় মূলত দেখাও যায় না। লেখাপড়ার মাঝখানে বিয়ে নামক যে সামাজিক সংস্কারটি ব্যবচ্ছেদ ঘটায় সেখান থেকে মুক্ত পরিবেশে বের হয়ে আসাও কঠিনতম পর্যায়। শুধু কি বিয়ে? মাতৃত্বও এখানে অনেক বড় বিষয় হয়ে যায়। সন্তান দেখাশোনার দেখভাল প্রচলিত রীতি অনুযায়ী মাকেই করতে হয়। এমন ব্যত্যয় অল্প বিস্তর ঘটলেও মূল সমস্যা এখানেই জিইয়ে থাকে। তারপরেও থাকে পরীক্ষার পর কোনো একটি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগপত্র পাওয়া। সেটাও যে কখন কোথায় পর্যন্ত গড়ায় তাও এক অসহনীয় পরিস্থিতি। আবার অনেকে মনে করছেন পর্যাপ্ত সুযোগ পেলেও নারীদের পেছনে পড়ে থাকা আটকানো যাচ্ছে না। হরেক প্রতিবন্ধকতার জালে আটকা পড়ে অবশ্যই নারীরা। সেখানে পুরুষ প্রতিযোগীরা নির্দ্বিধায়, নির্বিঘ্নে তার পেশাগত জীবনকে চালিয়ে নিতে কোনো প্রকার অব্যবস্থাপনার শিকারও হয় না। আরও একটি কারণ উলেস্নখ করা সমুচিত।

সরকারি চাকরি মানেই বদলির একটা বিষয় যেন সম্পৃক্ত হয়ে থাকে। সেখানে ভুগতে হয় স্ত্রী কিংবা মাকে। কোলের সন্তান নিয়ে বদলির চাকরি সত্যিই অসহনীয়। কোনো মা সন্তানকে পিতার কাছে রেখে অন্য জায়গায় চলে যাবে তা প্রচলিত তো নয়ই বরং দুর্ভেদ্য এক বাধা- যা অতিক্রম করা অসাধ্য। বিভিন্ন সামাজিক, মানসিক এবং মানবিক কারণ তো রয়েছেই। তার ওপর আছে চিরায়ত বঙ্গ ললনার সহজাত মূল্যবোধ। মা নিজেই তার সন্তানের স্পর্শকাতর সময়ে ছেড়ে যেতেও এক প্রকার অনীহা ভেতরের বোধে জিইয়ে রাখে। এভাবে কত সম্ভাবনাময় গৃহিণী ও মা তার স্বপ্নের পেশা থেকে ক্রমান্বয়ে দূরে সরে যায় তাও অসহনীয় মর্মবেদনা।

সম্প্রতি প্রকাশিত পিএসসির বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২-এ উলেস্নখ থাকে ৩৭তম বিসিএস-এ ৭৫.৪০ শতাংশ পুরুষ চাকরিতে নিয়োগের জন্য সুপারিশ পায়। সেখানে নারীদের সংখ্যা দুঃখজনক মাত্র ২৪.৬০ শতাংশ। এভাবে ৪২তম বিসিএস পর্যন্ত গত ৫ বছরে নারীর পেছনে পড়ে যাওয়া কোনোভাবেই সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের অনুকূল নয়।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন বিসিএস কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপে জানা যায় সমস্যা আরও গভীরে। বর্তমানে বিভিন্ন উচ্চপদে আসীন বিসিএস নারী কর্মকর্তার অভিমত পরীক্ষার প্রস্তুতি এবং পরীক্ষায় বসার জন্য প্রায়ই বছরখানেক সময় ব্যয় হয়। নারীদের অতখানি সময় কোথায়? বিয়ে, সন্তান এবং সংসার নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়। অবশ্যই নিজের তাগিদে। পারিবারিক জীবনকে কোনোভাবেই পাশ কাটানো ভাবনার অতীত। তাই বিসিএসের জন্য আবেদন করে পরীক্ষায় বসা পর্যন্ত এক রকম। পরবর্তী সময়ে যা হয় তাতো সংবাদ মাধ্যমে চলে আসছে। একজন সরকারি কলেজের নারী শিক্ষকের মতে এখনো মেয়েরা শিক্ষকতার পেশাকেই বেছে নিচ্ছে সাবলীলভাবে কর্মজীবন চালানোর জন্য। কিন্তু যারা প্রশাসনিক কিংবা আইনশৃঙ্খলায় সম্পৃক্ত হন তাদের সমস্যা বহুবিধ।

প্রশাসনিক দপ্তরের দায়-দায়িত্ব অত সহজসাধ্য নয়। তবে কঠিন বলাও যাবে না। সার্বক্ষণিক তদারকি আর নজরদারিতে সময় সংকুলান সম্ভবও হয় না। এখানেও নারীদের কমবেশি অস্বস্তি হয়ই। ফলে শুধু পরীক্ষায় বসলে তো হবে না- তার জন্য মানসিক প্রস্তুতি শারীরিক সক্ষমতা অনেক কিছুতেই নারীদের পিছিয়ে পড়ার দৌর্বল্য দৃষ্টিকটু হলেও এটাই বাস্তব। আর শিক্ষকতার পদও তো সীমিত। সবার পক্ষে তা পাওয়া সম্ভব হয় না। তবে অনেক নারীর নিজের ভেতরেই জিইয়ে থাকে প্রশাসনিক কর্মকর্তার সম্ভাবনাময় পেশা। কিন্তু বাস্তব প্রেক্ষাপটে তা সব সময় মেলানো যায় না।

সবার আগে ভাবতে হবে একজন নারী নিজেই তার পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। নিজের কোলের সন্তান কারও হাতে দিতে না পারাও এক প্রকার নারীর এগিয়ে যাওয়ার চরম প্রতিকূলতা। যা পুরুষদের ক্ষেত্রে তেমন কোনো বালাই থাকে না। এমন সব মান্ধাতা আমলের অপসংস্কার থেকে বের হতে না পারলে আধুনিক সময় এবং পেশাকে ধরতে পারা আসলেই মুশকিল।

একজন নারী পড়াশোনা শেষ করছেন কৃষি অর্থনীতিতে কিন্তু তিনি যখন পরীক্ষায় বসছেন সেখানে বিষয়ভিত্তিক নয় বরং সাধারণ জ্ঞান উপস্থিত বুদ্ধির যে প্রশ্ন সামনে আসে সেখানেও পড়তে হয় কিছুটা অপ্রস্তুত অবস্থায়। যেখানে বিষয়ভিত্তিক (চিকিৎসক প্রকৌশলীর পরীক্ষায় এখনো নারীরা সমান তালে এগিয়ে চলার দৃশ্যও প্রতিবেদনে উঠে আসে। সেখানে একজন কৃষি অর্থনীতির শিক্ষার্থীকে দেওয়া হচ্ছে পুলিশ সুপারের দায়িত্ব। সঙ্গত কারণে শুধু প্রতিযোগিতায় ঝরে পড়া নয় আরও বেশি করে কর্মজীবনেও পদে পদে হোঁচট খাওয়া। সব মিলিয়ে সাধারণ বিসিএসে নারীদের শুধু প্রতিযোগিতায় হেরে যাওয়াই নয় পেশাগত জীবনেও সাফল্য পেতে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। এমন সব কারণও নারীদের বেলায় সবিশেষ প্রযোজ্য। সুতরাং, পরীক্ষায় বসলেও আগ্রহ এবং উৎসাহ হারাচ্ছে প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টিও।

সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পারিবারিকভাবে একটা সুস্থ ও নিরাপদ পরিবেশ জরুরি। যাতে সন্তানের জন্য মাকে বেশি ভাবতে না হয়। এই সময়ের একক পরিবারও নারীদের চাকরির ক্ষেত্রকে বাধাগ্রস্ত করছে। সেজন্য প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র গড়ে তোলাও সময়ের দাবি। যেহেতু বিসিএস পরীক্ষা একেবারে সরকারি কর্মযোগ সেখানে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষই পারেন যথাযথ সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনায় নারীদের কর্মজীবনকে অবারিত ও স্বাচ্ছন্দ্য করে দিতে। প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় যাতে নারীদের অংশগ্রহণ আরও নজরকাড়া হয়। সফলতা আসতেও সময় লাগবে না।

কাজের সুষ্ঠু ও মানসম্মত পরিবেশ ছাড়াও সাংসারিক কাজকর্ম ভাগ করে নিয়ে স্বামী-স্ত্রী দু'জনকেই সমানভাবে তার পেশাগত জীবনের দায়ভার পালন করাও এক প্রকার সচেতন মনোসংযোগ। সমাজের অর্ধেক অংশ যদি ক্রমাগত পেছনে পড়তে থাকে তাহলে সামগ্রিক উন্নয়ন অধরা থেকে যাবে। উন্নয়নশীল বাংলাদেশ নানামাত্রিক সফলতায় বিশ্বে মাথা উঁচু করে টিকে আছে। সেখানে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে যেন লিঙ্গ বৈষম্যও স্থান করে নিতে না পারে। বাংলাদেশের নারী সমাজও অনেক ক্ষেত্রে দৃষ্টিনন্দনভাবে সামনে চলার পথ অবারিত নির্বিঘ্ন করে এগিয়ে চলছে। প্রাইমারি থেকে মাধ্যমিক উচ্চ মাধ্যমিকে ছাত্রীদের অংশগ্রহণ সত্যিই বিমুগ্ধ হওয়ার মতো। তবে ২ বছরের করোনার চরম বিপর্যয়ে শিক্ষার্থী ঝরে পড়াও এক দুঃসহ ক্রান্তিকাল।

\হসেখানে ছাত্রীরা পড়েছে বাল্যবিয়ের কোপানলে আর ছাত্ররা সম্পৃক্ত হতে বাধ্য হয়েছে অপরিণত শিশুশ্রমে। দুটোই থামানোর মহাসন্ধিকাল এখনই। পরিবারই সমাজের আদি ও অকৃত্রিম চিরায়ত প্রতিষ্ঠান। সেই গুহাবাসী মানুষের জীবন থেকেই যা আধুনিক সময়ের ও এক অপ্রতিরোধ্য শক্তিশালী সামাজিক সংগঠন। সেখান থেকে সব মানুষের যাত্রা নিশ্চিত আর নির্বিঘ্ন করতে পরিবারেই সবকিছু শুরু করাও সময়ের অনিবার্য দাবি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে