রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

নারী জীবনের করুণ অধ্যায় বিয়ে বিচ্ছেদ

ববি বড়ুয়া
  ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

বিচ্ছেদ নয়, আসুন সংযুক্তির উপায় খুঁজি; অবসরে বউ-শাশুড়ি কিংবা মা-মেয়ের গল্পে শোনা হয় তাদের নিজেদের জীবনের কত শত অব্যক্ত গল্প- যার অধিকাংশই থাকে পাওয়া, না পাওয়ার, না মেলানো হিসাবের খাতার আনকোরা ধ্বংসাবশেষ। না মেলানো হিসাবের খাতার প্রতিপাদ্য একটিই- 'কী করবি, অন্তত সন্তানদের মুখের দিকে তাকিয়ে হলেও সবকিছু সয়ে-বয়ে নে।' আর এভাবেই জীবনগতি চলতে থাকে অচল ঠেলাগাড়ির গতিতে। একটি সময় ওই 'সয়ে-বয়ে' নিতে নিতে জীবন গল্পের শেষপ্রান্তেও এসে পৌঁছায়। তবে এ কথা ঠিক যে, সয়ে-বয়ে নেওয়ার গল্পে নিজের জীবন যেমনই হোক না কেন- সন্তানরা পিতা-মাতা, আত্মীয়-পরিজনের সান্নিধ্যে এক রকম সুন্দরভাবে আলোর মুখ দেখে; আলোর মুখ দেখে মা নামক 'সয়ে-বয়ে' নেওয়া যন্ত্রের কঙ্কালের ওপর ভর করে। সব হয় ঠিকই কিন্তু শেষ জীবনে এসেও তার যে সয়ে-বয়ে নেওয়ার গল্পের ইতি আর হয় না। শুরু হয় সন্তানদের হাতে সয়ে-বয়ে নেওয়ার গল্প। এই তো বাঙালি নারীদের 'সয়ে-বয়ে' নেওয়ার অনাদিকালের জীবনপ্রবাহ।

হঠাৎ এত কথা মনে উদ্রেক সৃষ্টি করার কারণ হলো, সম্প্রতি দেশের জাতীয় দৈনিকে 'ঢাকায় প্রতি ৪০ মিনিটে ১টি তালাক' শিরোনামের খবর প্রকাশিত হয়। ৬ সেপ্টেম্বর দৈনিক আমাদের সময়ের শিরোনাম 'বিয়ে বিচ্ছেদ বেশি চান নারীরা'। এই সংবাদগুলো যেন বুকের ভেতরটা আন্দোলিত করে অজানা সংশয়ে। এমনই যদি চলতে থাকে, তা হলে অচিরেই ভেঙে যাবে বাঙালির 'পারিবারিক বন্ধন' শব্দের অহঙ্কার; ভঙ্গুর পরিবার থেকে পাওয়া যাবে ভঙ্গুর মানসিকতার প্রজন্ম। পারিবারিক দৃঢ়তায় বেড়ে ওঠা প্রজন্ম এগিয়ে চলে মেধা-মননের শৈল্পিক প্রকাশে কোমল-মানবিক মানুষ হিসেবে; দেশ পায় একটি দৃঢ় চেতনার আগামী। কিন্তু আজ কেন যেন সুন্দর আগামী হুমকির মুখে। এই সংবাদগুলো তারই ঈঙ্গিত বহন করে। গত শুক্রবার চট্টগ্রাম মহানগর মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি হাসিনা মহিউদ্দিনের সঙ্গে এই বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলেন, 'আমার কাছে এ ধরনের সমস্যা আসছে প্রতিনিয়ত। অনেক ক্ষেত্রে সচ্ছল পরিবারের স্বাবলম্বী নারীর ক্ষেত্রে যা হচ্ছে আবার অসচ্ছল পরিবারের পড়াশোনা কম জানা নিজের পায়ে দাঁড়াতে না পারা মেয়েদের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা। বারবার সমঝোতার চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত আর টিকিয়ে রাখা সম্ভব হয় না। আসলে আজকাল নারী-পুরুষ উভয়েরই সহনশীলতার অভাব। নারীদের স্বাবলম্বী হওয়া পুরুষতান্ত্রিক সমাজের পুরুষরা যেমন মেনে নিতে পারেন না, তেমনি নারীদেরও সহনশীলতার অভাবে সংসার আর বেশি দূর এগোয় না।' বিয়ে বিচ্ছেদের সংখ্যা রাজধানীতে সবচেয়ে বেশি। গত বছর ঢাকায় প্রতি ৪০ মিনিটে ১টি করে তালাক হয়েছে। আর এটি যে শুধু ঢাকার চিত্র, তা নয়; বরং সারাদেশেই এর সংখ্যা বাড়ছে উলেস্নখযোগ্য হারে। আর এই বিচ্ছেদের আবেদন করছেন নারীরা বেশি। নির্যাতন-নিপীড়ন থেকে আত্মমর্যাদাবান নারীরা বিচ্ছেদকেই স্বস্তির একমাত্র উপায় ভাবছেন। বিচ্ছেদের আবেদনের পর সমঝোতা হয়েছে খুবই কম- যা ৫ শতাংশের নিচে। ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ও জেলা রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিয়ে বিচ্ছেদের এই চিত্র পাওয়া গেছে।

পরিসংখ্যান বিবেচনায় ঢাকার দুই সিটি মেয়রের কার্যালয়ের তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে তালাকের আবেদন এসেছিল মোট ১৩ হাজার ২৮৮টি। এর মধ্যে ছিল দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৭ হাজার ৬৯৮টি আর উত্তর সিটিতে ৫ হাজার ৫৯০টি। এই হিসাবে রাজধানীতে প্রতিদিন ভেঙে যাচ্ছে প্রায় ৩৭টি দাম্পত্য সম্পর্ক অর্থাৎ তালাকের ঘটনা ঘটছে ৪০ মিনিটে একটি করে। ২০২০ ও ২০২১ সালেও রাজধানীতে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদনের সংখ্যা ছিল ১২ হাজারের বেশি। ঢাকার দুই সিটির মেয়রের কার্যালয়ের তথ্য অনুসারে এ দুই বছরে আবেদন জমা পড়েছে যথাক্রমে ১২ হাজার ৫১৩ ও ১৪ হাজার ৬৫৯টি। গত চার বছরে তালাক হয়েছে ৫২ হাজার ৯৬৪টি। আর চট্টগ্রামের দিকে তাকালে সর্বশেষ পাঁচ বছরে প্রতি বছরই তালাকের ঘটনা বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বিচ্ছেদ হয়েছে ২০২২ সালে- ৫ হাজার ৯৭৬টি। চট্টগ্রামের নারী-পুরুষের পৃথক বিচ্ছেদের সুস্পষ্ট সমীক্ষা পাওয়া না গেলেও রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের তথ্যে বিয়ে বিচ্ছেদের আবেদন বেশি আসতে দেখা যাচ্ছে স্ত্রীদের পক্ষ থেকে। প্রতি ১০টি আবেদনের প্রায় ৭টি করেছেন স্ত্রী। ২০২২ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে মোট তালাক হয়েছে ৭ হাজার ৬৯৮টি। এর মধ্যে স্ত্রীরা আবেদন করেছিলেন ৫ হাজার ৩৮৩টি- যা মোট আবেদনের ৭০ শতাংশ। ঢাকা উত্তরের চিত্রও একই। ২০২২ সালে সেখানে তালাক আবেদনের ৬৫ শতাংশই ছিল নারীর।

মা-বাবার বিয়ে বিচ্ছেদের সবচেয়ে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে সন্তানের ওপর। তারা একটা মানসিক টানাপড়েনের মধ্যে দিয়ে যায়। মা-বাবার ডিভোর্সের পর সন্তান কার কাছে থাকবে, এ বিষয়েও তাকে প্রভাবিত করা হয়। ফলে পিতা-মাতার প্রতি একটি বিরূপ ধারণা নিয়ে সন্তান বড় হতে থাকে। ভেঙে যাওয়া পরিবারের সন্তানরা এ অবস্থায় বিষণ্নতা থেকে মাদকদ্রব্য গ্রহণ ও বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গে জড়িত হয়ে পড়তে পারে। গবেষকরা মনে করেন, সুস্থ ও সম্পূর্ণ পরিবারের সন্তানদের থেকে অসুস্থ এবং ভাঙা পরিবারের সন্তানরা সর্বক্ষেত্রেই পিছিয়ে থাকে। সব দিক বিবেচনায় বিয়ে বিচ্ছেদের বিষয় আতঙ্ক ও উৎকণ্ঠা সৃষ্টি করলেও এর পেছনে সুস্পষ্ট কারণ কম নয়। একটি সময় ছিল- যখন নারী শিক্ষার হার ছিল অতিমাত্রায় নিচে। ফলে তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও ছিল শূন্যের কোটায়। নিজের অধিকারের বিষয়ে ছিল উদাসীনতা। ফলে পুরুষ কিংবা শ্বশুরবাড়ির লোকদের নির্যাতন নীরবে সহ্য করা ছাড়া উপায়ও ছিল না। কিন্তু তাদের মনে যে একেবারেই শৃঙ্খল ভাঙার সুর বাজত না, তা নয়। এখন নারীরা শিক্ষিত হচ্ছেন, স্বাবলম্বী হচ্ছেন; নিজেদের আত্মসম্মানের জায়গায় সচেতন হচ্ছেন। তারা অবহেলা, অপমান আর সহ্য করতে প্রস্তুত নন। আবার অপর পিঠে পুরুষতান্ত্রিক পরিবারের বেড়ে ওঠা পুরুষরাও নারীর এমন স্বাধীনতা মেনে নিতেও অক্ষম। তারা এখনো নারীকে ব্যবহারের বস্তু হিসেবে ভাবতেই অভ্যস্ত। এ জন্য বাড়ে সংঘাত ও দ্বন্দ্ব। এ ছাড়া এখন নানারকম আসক্তিতে নিমজ্জিত হচ্ছেন নারী-পুরুষ। তথ্যপ্রযুক্তির সহজলভ্যতা মোবাইল ফোন, ফেসবুকসহ নানা প্রযুক্তি মানুষের হাতের মুঠোয়। তাই আজকাল নারী-পুরুষের পরকীয়া সম্পর্ক গড়ে তোলা অনেক সহজ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরকীয়া যেন সেই বহমান নদীর মতো 'এ কূল ভাঙে ওই কূল গড়ে'; একজনের সুখের সংসার ভেঙে তছনছ করে আরেকটি চোরাবালিতে যেন পা দেওয়ার মতো।

অন্যদিকে, অল্প বয়সে বিয়ে, শারীরিক সমস্যা, বিয়ের ক্ষেত্রে ভুল মানুষকে নির্বাচন করা, ক্যারিয়ার অ্যাডভান্সমেন্ট, বৈবাহিক জীবনে অসুখী, অবজ্ঞা, গৃহস্থালির কাজে স্বামীর অসহযোগিতা, পারিবারিক কলহ, শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, যৌতুক, মাদকসেবন করে নির্যাতন, প্রবাসী স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা, যৌন অক্ষমতা, সন্দেহ, উদাসীনতা, ব্যক্তিত্বের সংঘাত ইত্যাদি। এ কারণগুলো বরাবরের মতোই প্রাচীন। তা স্বত্ত্বেও মানুষের আঙুল ওঠে শুধু নারীর দিকেই। তাদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অর্থনৈতিক সক্ষমতাকেই বারবার আসামির কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। যদিও আমরা এ ক্ষেত্রে বারবার পুরুষকেই দায়ী করি, তবুও পরিবারে থাকা নারীরাই- যারা নিজেদের জীবন নিয়ে যেখানে অপ্রাপ্তির রোগে ভোগেন, তারাও নারীদের সহযোগিতায় অনড়। তারাই সবার আগে আঙুল তোলেন নারীর দিকে। তারাই মেনে নিতে পারেন না নারীদেরও ব্যক্তিস্বাধীনতা, আত্মসম্মানবোধ আছে; তারাও মানুষ, তাদেরও নিজের জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আছে। এর বৈপরীত্য যে নেই, তা নয়। স্ত্রীর অতিরিক্ত লোভ, শ্বশুর-শাশুড়ি কিংবা স্বামীর পরিবারের সদস্যদের প্রতি অশ্রদ্ধা, সংসারের প্রতি উন্নাসিকতা, উচ্চাকাঙ্ক্ষা অনেক সময় সহ্যতীত হয়ে গেলে স্বামী বিচ্ছেদকে সঠিক পথ হিসেবে বেছে নেন। দুঃখের বিষয়- কখনই কারোরই বোধের উদয় হয় না যে, একটা সংসার নারী-পুরুষ উভয়ের। উভয়ের পারস্পরিক সহযোগিতা, পারস্পরিক সম্মান প্রদর্শন, পারস্পরিক শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় একটা পরিবার সুখের হতে পারে। কারণ বিয়ে মানে শুধু দুইজন মানুষের নয়, দুটি পরিবারের সবাই জড়িত। সম্পর্কগুলোকে যত্ন নেওয়া, উভয়ের ছাড় দেওয়ার মানসিকতা, একটু সহনশীলতা বাঁচিয়ে রাখতে পারে অনায়াসে একটা দাম্পত্য জীবন; বাঁচিয়ে রাখতে পারে অনিশ্চিত আগামী থেকে পরিবারে বেড়ে ওঠা আগামী প্রজন্মকে।

পরিশেষে একটাই কামনা, বিচ্ছেদে ইতি না হোক স্বর্ণালি স্বপ্নে আঁকা কোনো সম্পর্কের। মাতা-পিতা, আত্মীয়-পরিমন্ডলে বেড়ে উঠুক আমাদের আগামী প্রজন্ম। বিচ্ছেদে নয়, আসুন সংযুক্তির উপায় খুঁজি; গড়ি বর্ণিল, সুখময়, প্রেমের সুতায় গাঁথা সুন্দর বিয়ে বন্ধন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে