রোববার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪, ১৫ বৈশাখ ১৪৩১

বিখ্যাত মুসলিম নারী

তহুরা বেগম
  ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০

আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে ইতিহাসের বিখ্যাত কিছু মুসলিম নারীর সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দেওয়াটা চিত্তাকর্ষক একটা ব্যাপার হবে যাদের সম্পর্কে হয়তো আগে তারা কিছুই জানতেন না। যদিও এম্প্রেস থিওডোরা, এলিয়ানোর অব এ্যাকুইটাইন, জোয়ান অব আর্ক, এ্যান বলেইন, ক্যাটারিনা স্ফরযা এবং এলিজাবেথের মতো এক্সট্রা অর্ডিনারি মহিলারা ইতিহাসের কাছে সুপরিচিত, কিন্তু মধ্যযুগের এবং প্রাথমিক ইসলামী যুগের এদের সমগোত্রীয় কিছু মহীয়সী নারীরা অতটা সুপরিচিত নন ইতিহাসের কাছে। প্রি মডার্ন যুগের কিছু কিছু মুসলিম নারী বিদুষী গবেষক, কবি, সুফিবাদী, শাসক এবং যোদ্ধা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। নিচে তার একটা সংক্ষিপ্ত লিস্ট দেওয়া হলো।

১) খাদিজা বিনতে খুওয়াইলিদ (মৃতু্য ৬২০ খ্রিষ্টাব্দ)-নবী মুহম্মদ (সা.)-এর সঙ্গে তার বিখ্যাত বিয়ের আগেও তিনি একজন সফল ব্যবসায়ী এবং অভিজাত নারী হিসেবে মক্কায় সুপরিচিত ছিলেন। তিনি ইসলামের নতুন বাণীর প্রচার ও প্রসারের সহযোগিতায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন এবং প্রথম মুসলিম হওয়ার বিশেষত্ব লাভ করেন। এটাও বিশ্বাস করা হয় যে, রাসূল (সা.) নিজেই বলেছেন [সহিহ মুসলিমের সনদে বর্ণিত], 'আলস্নাহ আমাকে খাদিজার চেয়ে উত্তম কোনো কিছু দেননি। সে আমাকে তখন গ্রহণ করেছে, যখন সব লোক আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে; যখন সবাই আমার আহ্বানে সন্দেহ পোষণ করেছিল, তখন সে আমাকে বিশ্বাস করেছিল; সে তখন আমাকে সম্পদ দিয়ে সাহায্য করেছে, যখন অন্যরা আমাকে বঞ্চিত করেছে এবং আলস্নাহ শুধু তার দ্বারাই আমাকে সন্তান দিয়েছেন।' আসলেই রাসূল (সা.)-এর কন্যা ফাতিমা খাদিজারও কন্যা এবং তার মাধ্যমেই (বিশেষভাবে তার দুই পুত্র হাসান এবং হুসাইন) রাসূল (সা.)-এর বংশের ধারাবাহিকতা রক্ষিত হয়েছে। এই কারণগুলোই ফাতিমা এবং তার মা খাদিজাকে ইসলামে সবচেয়ে সম্মানিত দুইজন নারী ব্যক্তিত্বের মর্যাদা দিয়েছে।

২) নুসাইবা বিনতে কা'ব আল আনসারিয়্যা (মৃতু্য. ৬৩৪ খ্রিষ্টাব্দ)- তিনি উম্মে আম্মারা নামেও পরিচিত। তিনি বনু নাজ্জার গোত্রের একজন সদস্য ছিলেন এবং মদিনার প্রাথমিক সময় ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে একজন। রাসূল (সা.)-এর একজন সাহাবি হিসেবে তার অনেক গুণাবলি ও বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। তাকে মূলত স্মরণ করা হয় ওহুদ যুদ্ধে (৬২৫ খ্রিষ্টাব্দ) তার অংশগ্রহণের কারণে। যেখানে তিনি ঢাল ও তরবারি নিয়ে কার্যতই মক্কাবাসী যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেন। তিনি রাসূল (সা.)-কে রক্ষার জন্য নিজের শরীরকে ঢাল হিসেবে বেশ কয়েকবার শত্রম্নপক্ষের বর্ষা ও তীরের সামনে পেতে দেন। এটা কথিত আছে, তিনি ১২তম আঘাতের পরে বেহুঁশ হয়ে পড়ে যান এবং যখন জ্ঞান ফিরে আসে (একদিন পরে মদিনায়), তখন জিজ্ঞেস করেন যে,' নবী (সা.) কি বেঁচে আছেন?'

৩) খাওলা বিনতে আল-আজওয়ার (মৃতু্য : খ্রিষ্টাব্দ ৬৩৯)- তিনিও নবী করিম (সা.)-এর সময়কালীন একজন নারী। তিনি ইতিহাসে বহুল পরিচিত ইয়ারমুকের যুদ্ধে (৬৩৬ খ্রিষ্টাব্দে) তার অংশগ্রহণের কারণে। এই যুদ্ধটি ছিল বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ইসলাম বিজয়ী হওয়ার যুগের ন্যারেটিভ অনুযায়ী, তার যুদ্ধের দক্ষতা বিখ্যাত সেনাপতি খালিদ বিন ওয়ালিদের সমপর্যায়ের। তার ব্যাপারে অনেক অতিরঞ্জিত অলংকৃত এবং অস্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায়- যা কিনা পুরো বর্ণনাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করে এবং কিছু কিছু স্কলারের মতে তার অস্তিত্বে থাকার ব্যাপারটি নাকি সন্দেহে নিপতিত! এত কিছুর পর ও অষ্টম ও নবম শতকের স্কলার যেমন আল-ওয়াকিদি এবং আল-আজাদি তাদের লেখায়ও ওইসব যুদ্ধ বিজয়ের ইতিহাসে একজন নারী যোদ্ধার অসাধারণ রণনৈপুণ্যের কথা বর্ণনা করেন। যদি আসলেই তিনি অস্তিত্বে না থাকতেন, তাহলে তো তার চরিত্রটি আরও বেশি লিজেন্ডারি ও চমকপ্রদ হয়ে ওঠে! ...

৪) আয়েশা বিনতে আবু বকর (মৃতু্য : খ্রিষ্টাব্দ ৬৭৮)- তার পরিচিতির জন্য আর কোনো ভূমিকার প্রয়োজন নাই। আয়েশা ছিলেন রাসূল (সা.)-এর স্ত্রী এবং নবী (সা.)-এর মৃতু্যর পর মুসলিম উম্মাহর ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব নারী হিসেবে তিনিই রেখেছিলেন। তিনি তৃতীয় ও চতুর্থ খলিফা উসমান বিন আফফান এবং আলী ইবনে আবী তালিবের রাজনৈতিক বিরোধিতায় কেন্দ্রীয় ভূমিকা রেখেছিলেন, এমনকি আলী ইবনে আবু তালিবের বিরুদ্ধে ৬৫৬ খ্রিষ্টাব্দে বসরায় সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব পর্যন্ত দিয়েছিলেন। যদিও তিনি এই যুদ্ধে পরাজয়ের পরই রাজনৈতিক ভূমিকা থেকে অবসর গ্রহণ করেন। কিন্তু তিনি ইসলামী শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অব্যাহত রাখেন। সুন্নি ট্র্যাডিশন অনুযায়ী তিনি অন্যতম প্রধান একজন হাদিসের রাবি (যারা হাদিস বর্ণনা করেন)। অনেক দিক থেকেই তিনি সবচেয়ে বিতর্কিত নারী চরিত্রও বটে, বিশেষত তার ইসলামী জ্ঞান গবেষণা, রাজনৈতিক কর্মকান্ড পরবর্তী সময়ের 'ইসলামে নারীর ভূমিকা' বিষয়ের কনজার্ভেটিভ ন্যারেটিভের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। আয়শা-এর জীবনী সম্বন্ধে আরও বিস্তারিত জানতে পড়তে পারেন, ডেনিস স্পিলবার্গের রচিত চমৎকার বই, পলিটিকস, জেন্ডার অ্যান্ড দি ইসলামিক পাস্ট : দ্য লিগ্যাসি অফ আয়িশাহ বিনতে আবু বকর (১৯৯৬)।

৫) জয়নাব বিনতে আলী (মৃতু্য : ৬৮১ খ্রিষ্টাব্দ)- তিনি নবী মুহম্মদ (সা.)-এর নাতনি এবং ফাতিমা (মৃতু্য : খ্রিষ্টাব্দ ৬৩৩) এবং তার স্বামী আলী ইবনে আবি তালিব (মৃতু্য : ৬৬১ খ্রিষ্টাব্দ)-এর কন্যা। তিনি আহলুল বায়তের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোচিত ও প্রশংসিত এবং তিনি কারবালা ম্যাসাকার (৬৮০ খ্রিষ্টাব্দ)-এর সময়ে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করেন। কারবালা ম্যাসাকারে হুসাইন ইবনে আলী এবং তার ৭২ জন ভাতিজা ও অন্য ভাইয়েরা নিহত হন উমাইয়্যা শাসকের সেনাপতির হাতে। একটা সময় তিনিই ছিলেন আহলুল বায়তের কার্যকরী নেতৃত্বের অবস্থানে এবং তার ভাইয়ের উদ্দেশ্যের প্রধান রক্ষাকবচ। কুফায় তিনি তার ভাতিজা আলী এবনে আল হুসাইনকে নিশ্চিত মৃতু্যর হাত থেকে রক্ষা করেন, যখন তাদের সবাইকে ইয়াজিদ ইবনে মুয়াবিয়ার দরবারে শাস্তির জন্য তোলা হয়। তিনি সেখানে এমন ধৈর্যশীল এবং জ্বালাময়ী বক্তব্য রাখেন যা খলিফাকে বাধ্য করে তাদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য এবং তাদের কারবালায় ফিরিয়ে আনা হয়। তার শক্তিমত্তা, ধৈর্য এবং জ্ঞান তাকে প্রাথমিক ইসলামিক যুগের একজন গুরুত্বপূর্ণ নারীতে পরিণত করেছে। দামেস্কে তার মাজার এখনো শিয়া ও সুন্নি উভয় শ্রেণির মুসলিমদের কাছে শ্রদ্ধাপূর্ণ জায়গা, যা প্রমাণ করে যে তার লিগ্যাসি আসলে পুরা মুসলিম উম্মাহর কাছেই স্বীকৃত।

৬) রাবি'য়া আল আদাউইয়া মুসলিম ইতিহাসের একজন অন্যতম প্রধান মরমি (সুফি), যিনি দাসত্ব থেকে মুক্ত হওয়ার পূর্বে শৈশবকালের বেশিরভাগ অংশই কাটান দক্ষিণ ইরাকে দাস হিসেবে। তাকে 'স্বর্গীয় ভালোবাসা' নামক সুফি মতবাদের একজন অন্যতম পুরোধা মনে করা হয় যার মৌল বিষয় হলো- 'খোদাকে ভালোবাসতে হবে শাস্তির ভয় বা পুরস্কারের আশায় নয় বরং স্বীয় স্বার্থেই'। যা তিনি তার একটি কবিতায় এভাবেই চয়ন করেছেন-

'হে খোদা! আমি যদি শপি তোমায় দোজখের ভয়ে, পোড়াইও আমায় অগ্নিশিখায়, যদি শপি তোমায় বেহেশতের আশায়, তবে যেন বেহেশত থেকে ত্যাজ্য কর আমায়।

তবে যদি এই প্রার্থনা হয় শুধু তোমারই জন্য।

তব নিত্য সৌন্দর্য হতে আমায় কর না বঞ্চিত।'

যখন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, রাবিয়ার মতো একটি জীবনীকে কেন তার এই আধ্যাতিক জীবনালিপিতে প্রবেশ করানো হলো, তখন ত্রয়োদশ শতাব্দীর পন্ডিত ফরিদুদ্দিন আত্তার (১২২০ খ্রি.) ব্যাখ্যা করেন, 'মহানবী (সা.) নিজে বলেছিলেন, 'স্রষ্টার নিকট তোমার বাহ্যিকতা মূল্যবান নয়। এ বিষয়টি মূলত : ব্যক্তির অন্তর্নিহিত অভিপ্রায়ের ওপরই নির্ভর করে। মানবজাতি তাদের উদ্দেশ্য অনুযায়ী পুনরুত্থিত করা হবে।' আর তাছাড়াও মহান ও পবিত্র সত্তা 'আয়িশা বিনতে আবু বকর (রাদিয়ালস্নাহু আনহুম)-এর মতো একজন নারীর কাছ থেকে যদি দ্বীনের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আমরা গ্রহণ করতে পারি, তবে 'আইশা (রাদিয়ালস্নাহু 'আনহা) এর দাসিসমতুল্য কারও কাছ থেকেও ধর্মীয় নীতিমালা গ্রহণযোগ্য হতে পারে।'

৭. কর্দোবার লুবনা (৯৮৪ খ্রি.) প্রকৃতপক্ষে স্প্যানিশ অঞ্চলের একজন দাসী লুবনা কর্দোবার উমাইয়্যাদ রাজপ্রাসাদের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি খলিফা আব্দুল রাহমান (৯৬১ খ্রি.) এবং তার পুত্র আল হাকাম বিন আব্দুল রাহমানের (৯৭৬ খ্রি.) দুর্গ তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি একজন দক্ষ গণিতবিদ ছিলেন এবং রাজকীয় গ্রন্থাগারের দায়িত্বে ছিলেন যা কি না ৫০০,০০০ বই নিয়ে গঠিত ছিল। বিখ্যাত আন্দালুসি বিশেষজ্ঞ ইবনে বাশকুয়ালের মতে, 'তিনি সাহিত্য, ব্যকরণ এবং কবিতায় পারদর্শিতা হয়ে ওঠেন। গণিতের ওপর তিনি যথেষ্ট জ্ঞান রাখতেন এবং বিজ্ঞানের অন্য শাখায় তার জ্ঞান যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল। উমাইয়্যাদ রাজপ্রাসাদে তার মতো বিজ্ঞ কেউ ছিল না।'

৮. আল-মালিকা আল-হুররা আরওয়া আল-সুলায়হি (১১৩৮ খ্রি.) তার পুরো নাম ছিল আরওয়া বিনতে আহমাদ বিন মুহাম্মাদ আল-সুলায়হি। ১০৬৭ থেকে ১১৩৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত তিনি স্বীয় অধিকার বলে ইয়েমেনের রানী হিসেবে শাসন করেছিলেন। তিনি একজন ইসমাইলি শিয়া ছিলেন এবং বিভিন্ন ধর্মীয় বিজ্ঞান, কোরআন, হাদিস, সাহিত্য এবং ইতিহাসে যথেষ্ট পারদর্শী ছিলেন। পুরাতত্ত্ববিদরা (ঈযৎড়হরপষবৎং) তাকে অসাধারণ জ্ঞানী বলে উলেস্নখ করেছেন। তিনি যে তার নিজের অধিকারবলেই রানী ছিলেন এই মতের ওপর জোর পাওয়া যায় এ কারণে যে, ফাতিমীয় বংশের খলিফা আল-মুন্তাসির বিলস্নাহ-এর নামে পরই শুক্রবারের খুতবায় তার নাম উলেস্নখ করা হতো। ফাতেমীয় খলিফা আল মুন্তাসির, আরওয়াকে ইয়েমেনি ফাতিমীয়দের মধ্যে সর্বোচ্চ ধর্মীয় পদবি (যা হলো হুজ্জা) দেন।। ইতিহাসের প্রথম কীর্তিমান মুসলিম নারী তিনিই ছিলেন যাকে ইসলামের এতো বড় পদমর্যাদা দান করা হয়। তার সময় ইসমাইলি মিশনারিদের পশ্চিম ভারতে পাঠানো হয়েছিল, সেখানকার গুজরাটে একটি বিশাল ইসমাইলি সেন্টার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল (যা ইসমাইলীয় বোহরা বিশ্বাসের শক্তিশালী কেলস্নায় পরিণত হয়)। প্রকৃতপক্ষে, ইয়েমেন ইসমাইলি মুভমেন্টের জন্য শক্তিশালী হয়ে ওঠে। তিনি ১০৯৪-এর ফাতিমীয় মতবিরোধে আল মুস্তা'য়ালি (পরে আল-তায়ি্যব)-কে সমর্থনের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং তার বিশাল প্রভাবের অন্যতম উদাহরণ হলো তার রাজত্বের অধীনে থাকা ইয়েমেন ও ভারতের কিছু অংশ তার মতকেই সমর্থন দান করেন। ফলে তায়ি্যবি ইসমাইলি আন্দোলনের কেলস্নায় পরিণত হয় ইয়েমেন। তার শাসনামলে ইয়েমেনের অবকাঠামোতে অনেক কাঠামোগত নির্মাণকাজ ও উন্নতি ঘটে যা মুসলিম বিশ্বের উন্নতির ইতিহাসে একাঙ্গীভূত করা হয়। তিনি ছিলেন মুসলিম ইতিহাসের একমাত্র এবং মুসলিম রানীর উদাহরণের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।

৯) ফাতিমা বিনতে আবি আল-কাসিম 'আবদ আল-রহমান ইবনে মুহম্মদ ইবনে গালিব আল-আনসারি আল-শাররাত (মৃতু্য : ১২১৬ সাল): তিনি ছিলেন দ্বাদশ শতাব্দীর শেষভাগে এবং ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথমদিকে আল-আন্দালুস (স্পেন) এর সে সময়ের সবচেয়ে জ্ঞানী মহিলা। তার আইনতত্ত্ব ও আইনদর্শন ছাড়াও সুফিবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ততাই প্রমাণ করে যে ইসলামিক বিজ্ঞানে তার জ্ঞানের পরিধি ছিল অনেক বিশাল। তিনি ছিলেন বিশিষ্ট অধ্যাপক আবু আল-কাসিম ইবনে আল-তাইলাসানের মাতা। আন্দালুসি ইমাম আবু জাফর আল-গামাতি (মৃতু্য : ১৩০৯ সাল) এর মতে : 'তিনি তার পিতার তত্ত্বাবধানে অসংখ্য বই মুখস্ত করেছিলেন যার মধ্যে আছে আল-মাক্কি-এর তানবিহ, আল-কুদা'য়ি-এর আল-শিহাব, ইবনে 'উবাইদ আল-তুলাইতালি-এর আল-মুখতাসার। তিনটি গ্রন্থকেই তিনি হৃদয়াঙ্গম করেছিলেন। তিনি আল-কুরআনও মুখস্ত করেছিলেন আবু 'আব্দুলস্নাহ আল-মাদাওয়ারি, যিনি ছিলেন 'আব্দাল' [সুফিবাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ] এর একজন অন্যতম সাধক, তার তত্ত্বাবধানে। তিনি তার পিতার সঙ্গে সহিহ মুসলিম, ইবনে হিশাম রচিত সিরাতুন্নবী, আল-মুবাররাদের আল-কামিল, আল-বাগদাদী-এর নাওয়াদির এবং অন্যান্য গ্রন্থাদি অধ্যয়ন করেছিলেন।

\হ১০) রাজিয়া সুলতান (মৃতু্য : ১২৪০): ১২৩৬ থেকে ১২৪০ সালে দিলিস্নর সুলতানাতের শাসনকর্তা ছিলেন। তার পিতা, শামস আল-দীন ইলতুতমিশ (রাজত্ব : ১২১০-১২৩৬), তার মৃতু্যর আগেই রাজিয়াকে তার সুলতানাতের উত্তরাধিকারী করেছিলেন। তিনি ন্যায়পরায়ণ শাসক এবং শিক্ষার গুরুত্বপূর্ণ পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি অনেক স্কুল ও গ্রন্থাগার নির্মাণ করেছিলেন উত্তর ভারতে। সৈন্যবাহিনী নিয়ন্ত্রণে, রাজসিংহাসনে আরোহণ ও পিতার রাজপোষাক পরিধানসহ সব বিষয়ে, তিনি সুলতানের মতোই ব্যবহার করেছিলেন। চরম সন্ত্রাসপূর্ণ সময়েও তিনি জনসম্মুখে প্রকাশ্যে বের হতেন। ১২৪০ সালে রাজ্যের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির দ্বারা অপসারিত ও নিহত হন যারা একজন নারীর দ্বারা রাজক্ষমতা পরিচালনার বিরোধী ছিলেন।

১১) শাজার আদ দূ (মৃ. ১২৫৭): আইয়ু্যবি সুলতান আল-সালিহ্‌ আইয়ু্যব (রা. ১২৪০-১২৪৯)-এর বিধবা স্ত্রী হিসেবে মিশরের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। খুব সম্ভবত : তুর্কি বংশোদ্ভূত দাস কন্যা হিসেবে আয়ু্যবি রাজদরবারে জীবন শুরু করেন। ১২৫০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মিশরের সুলতানা হিসেবে এর শাসনভার গ্রহণ করেন। তার রাজত্বকালকে সাধারণত মিশরে মামলুক শাসনের সূচনা হিসেবে ধরা হয়। তিনি সপ্তম ক্রুসেডের সময় মিশরের উত্তরাঞ্চল রক্ষার প্রস্তুতি গ্রহণে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। এ সময় (যদিও উনি নিজে অনুপস্থিাত ছিলেন) ক্রুসেডারদের ফারিস্কারের যুদ্ধে (১২৫০ খ্রি.) পরাজিত ও ফ্রান্সের রাজা নবম লুইকে বন্দি করা হয়। তিনি রাষ্ট্রের প্রকৃত প্রধান হিসেবে খুতবায় তার নাম নেওয়া হতো ও মুদ্রায় 'মুসলমানদের রানী' হিসেবে তার নাম খোদাই করা থাকত। রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে একজন মহিলার সরাসরি শাসন মেনে নেওয়া লোকদের জন্য কষ্টকর বিধায় নানারকম চাপের কাছে নতি স্বীকার করে উনি তার সেনাপ্রধান ইজ্‌-আদ দীন আইবকের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন। ইজ্‌-আদ দীন আইবক পরিণত হন প্রথম মামলুক সুলতান এ। এ পরিণয় সত্ত্বেও শাজার আদ দূ তার প্রভাব বজায় রাখতে সক্ষম হন। এমনকি রাষ্ট্রীয় দলিলপত্রে সুলতানের সঙ্গে সঙ্গে তার নামও লেখা থাকত। রাজনৈতিক ও অন্য এক মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে বা আরেক স্ত্রী গ্রহণের সিদ্ধান্তের জন্য (এ ব্যাপারে নিশ্চিত জানা যায় না) ১২৫৭ সাল নাগাদ তিনি ইজ্‌-আদ দীনকে হত্যার মাধ্যমে অপসারিত করেন। এ ব্যাপার প্রকাশিত হলে পরে শাজার আদ দূকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। এভাবে তার রাজত্বের পরিসমাপ্তি ঘটে।

১২) জয়নাব বিন্‌তে আহমদ (মৃ. ১৩৩৯): তাকে চতুর্দশ শতকের সবচেয়ে প্রভাবশালী আলেমদের মধ্যে একজন ধরা হয়। হাম্বলী ফিকাহশাস্ত্রের অনুসারী ছিলেন আর দামেস্কে বসবাস করতেন। তিনি হাদিস শাস্ত্রসহ আরও অন্য ক্ষেত্রে 'ইজাযা' (ডিপেস্নামা বা সার্টিফিকেট) লাভ করেন। চতুর্দশ শতকের প্রথমার্ধে তিনি সহিহ বুখারি, সহিহ মুসলিম, মুয়াত্তা ইমাম মালিক, শামায়েলে তিরমিজি, ইমাম তাহাবির শহে মা'আনী ইত্যাদি গ্রন্থ শিক্ষা দিতেন। তার ছাত্রদের মধ্যে উত্তর আফ্রিকার বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা (মৃ ১৩৬৯), তাজ উদ্‌দীন সুবকি (মৃ ১৩৫৫) আর ইমাম আয্‌ যাহাবীর (মৃ ১৩৪৮) নাম পাওয়া যায়। ইবনে হাজার আসকালানী উলিস্নখিত অনেক ইসনাদে জয়নাব বিন্‌তে আহমদের নাম রয়েছে। মধ্যযুগে মুসলিম বিশ্বের অনেক মহিলা আলেমদের মধ্যেও তিনি ছিলেন অন্যতম।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে